‘এখন দেখি যখন-তখন ওভারটেক করতে পারছি না! রং সাইডে শর্টকাট মারতে পারছি না!’
জেন-জি প্রজন্মের বিদ্রোহে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার 'স্বাধীনতা' পায় ৫ আগস্ট। এরপর তিন দিন দেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। এখনও বলতে গেলে নেই কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যক্রম। এর মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মেগা সিটি ঢাকার লাখ লাখ যানবাহন এখন রাস্তায়। এ সময় স্বাভাবিকভাবেই রাস্তায় বিশৃঙ্খলা ঘটে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারত, কারণ রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। তবে এমনটি হচ্ছে না। যারা আন্দোলন সফল হতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে, তারাই আবার শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রাস্তায় নেমেছে।
সপ্তাহখানেক ধরে দেশের রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা এতটা নিবেদনের সঙ্গে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করছেন যে একজন মজা করে ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দিয়ে বসেন, 'ওভারটেক করতে পারছি না! রং সাইডে শর্টকাট মারতে পারছি না! এমন স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলাম?'
শুধু ঢাকা নয়, দেশের অন্যান্য বড় বড় শহরেও শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে। চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, বরিশাল—দেশের প্রায় সর্বত্র শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি। শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া আন্দোলনে কারণে দেশে যত জায়গায় আবর্জনা জমেছে তা পরিষ্কার করার জন্য মাঠে নেমেছেন। গণভবন আর সংসদ ভবনে তারা চালিয়েছেন পরিচ্ছন্নতা অভিযান। এছাড়াও ধ্বংস হওয়া বিভিন্ন স্থাপনা সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিচ্ছেন তারা। দেশের জনগণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভাবে যেন না ভোগে, সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
কেমন যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দিনগুলো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গিয়েছিলাম সরেজমিনে উত্তরার দুই ব্যস্ততম সড়ক জমজম টাওয়ার মোড় ও খালপাড় মোড়ে।
দশে মিলে করি কাজ
সময় দুপুর ৩টা। উত্তরার খালপাড় মোড়ে একদল সাদা পাঞ্জাবি পরা কিশোর হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এরা সবাই দারুল আরকাম আল এহসানিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। তাদের কয়েকজনকে দেখলাম রিকশাগুলোকে এক লাইনে আনছে। আবার কয়েকজন গাড়ি আর বাইকের আলাদা লেন বানিয়ে রেখেছে। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য নির্ধারিত লেন দিয়ে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স।
আমার রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলাম, গত কয়েকদিন ধরে এখানকার অবস্থা দেখে কী মনে হচ্ছে? তিনি বললেন, 'মামা! আগে আমরা যেইদিক দিয়ে পারতাম রিকশা ঢুকায়ে দিতাম। যেখানে মন চায় দাঁড়ায়ে যাইতাম। আর এখন তারা আমাদের জন্য রিকশা স্ট্যান্ড বানায়ে দিছে। ওইখানে ছাড়া দাঁড়াইতে দেয় না। লেন ছাড়া চলতে দেয় না। সুন্দর করে বুঝায়ে আইন অনুযায়ী চলতে বলে। আইন মাইনা চলতে যে এত ভালো লাগে, এটা আমি আগে জানতাম না। সবচেয়ে ভালা ব্যপার হইলো এখন আর চান্দা (চাঁদা) দেয়া লাগে না পুলিশরে! আগে প্রতিদিন চাঁদা নিত।'
কথা বলতে বলতে রিকশা নিয়ে এগোতে থাকলাম জমজম টাওয়ার মোড়ের দিকে। ১২ নম্বর সেক্টরের মোড়ে দেখলাম আবার কয়েকজন দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে। আমার রিকশাসহ বাকি সব রিকশা এক লাইন বরাবর চলছে। বামে মোড় নিয়ে কেউ যদি পাশের মোড়ে ঢুকতে চায়, তাদের জন্য আলাদা লেন। সেই লেন আটকানো হয় না। এর পাশের সব লেন নিয়ম মেনে দাঁড়াচ্ছে। এই মোড়ের দায়িত্বে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কয়েকজনকে দেখলাম।
জমজম টাওয়ার মোড়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রিকশা দাঁড়াল। এত বড় মোড়ে প্রতি মিনিটে শত শত গাড়ি যাওয়া-আসা করছে চারদিক থেকে। চৌরাস্তার মোড়ও বলা হয় এই জায়গাকে। একদম মাঝখানে ট্রাফিক আইল্যান্ড। সেখানে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছে একদল শিক্ষার্থী। আর চারদিকেই রাস্তার উভয়পাশে অনেক শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে নিয়োজিত। পথচারীদেরকে রাস্তা পার হওয়ার জন্য জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করতে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীরা।
সবার গলায় নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড ঝোলানো। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, এখানে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নেই। একসাথে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম, সেখানে শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, উত্তরা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা টাউন কলেজ, আইইউবিএটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, টঙ্গী সরকারি কলেজ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, মাইলস্টোন কলেজ, রাউজক উত্তরা মডেল কলেজ, নবাব হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গাজীপুর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, দারুল আজহার মাদ্রাসা, মাহনাতুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন, উত্তরা ক্যাডেট কলেজ ও ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা একসাথে কাজ করছে। এদের মধ্যে আগে কোনো পরিচয় না থাকলেও এখন একসাথে এমন গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে সবার মধ্যে হয়ে গিয়েছে দারুণ বন্ধুত্ব। একজনের কাছ থেকে জানলাম কয়েকজনের মধ্যে শুধু বন্ধুত্ব না, প্রেমও হয়ে গেছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে এসে!
অম্ল-মধুর স্মৃতি
'প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ট্রাফিকের কাজ করছি আমরা শিফট করে করে। প্রায় সবাই আমাদের কাজে সন্তুষ্ট। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন এসে আমাদেরকে পানি, খাবার ও বিভিন্ন উপহার দিয়ে যাচ্ছে। আমরা তো আগে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের নিয়ম জানতাম না। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে সব শিখছি। যানবাহনের মানুষরাও আমাদেরকে সহায়তা করছেন। কিন্তু অল্প কিছু খারাপ অভিজ্ঞতাও হচ্ছে আমাদের। সেদিন একজন নারী অবৈধ জায়গায় পার্কিং করলে আমরা সুন্দর করে তাকে বলেছিলাম গাড়ি সরিয়ে পার্কিং স্পটে রাখার জন্য। তিনি কথা তো শুনলেনই না, বরং তেড়ে আসলেন আমাদের দিকে! কয়েকজন পথশিশু আমাদের সাথে কাজ করছিল। তারা ওই মহিলার গাড়ির কাঁচের ওপর ময়লা ফেলে দেয়। পরে আমরাই আবার সে ময়লা পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম। তারপরেও উনি আমাদের সাহায্য করলেন না! এখন আমাদের কাছে তো আইন প্রয়োগ করার মতো ব্যবস্থা নেই যে আমরা ওনার জরিমানা করব। কেউ ট্রাফিক আইন অমান্য করলে বা হেলমেট না পরলে আমরা তাদেরকে দাঁড় করিয়ে আমাদের সাথে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগিয়ে রাখি ২০ মিনিটের মতো। এটাই আমাদের শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া,' বলছিলেন আইইউবিএটির শিক্ষার্থী সুমাইয়া তাবাসসুম। তিনি ৬ আগস্ট থেকে প্রতিদিন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে, সবার জন্য সবুজ নিরাপত্তা ভেস্ট দেওয়া হয়েছে।
২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় দেশবাসী দেখেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। এখন আবার তারা মাঠে নেমেছে। এই শিক্ষার্থীদের যেন কষ্ট না হয়, সেজন্য আশপাশে প্রায় সব রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। পানি, জুস, তেহারি, মোরগ পোলাও, খিচুড়ি, ফ্রাইড রাইস প্ল্যাটার, বিস্কিট, আইসক্রিম, শিঙাড়া, মিষ্টি—একটু পরপরই কেউ না কেউ এসে খাবার দিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের জন্য। এত বেশি খাবার দেওয়া হয়েছে যে তারা খেয়ে শেষ করতে পারছে না। মোড়ের ট্রাফিক বক্সে জমিয়ে রাখা হয়েছে বেঁচে যাওয়া খাবার। কোনো পথশিশু বা ভিক্ষুক এসে চাইলে, তাদেরকেও খাবার দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
মোরশেদা বেগম থাকেন উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে। তিনি বাসা থেকে প্রায় ১০০ বক্স খিচুড়ি আর মুরগির মাংস রান্না করে এনেছেন শিক্ষার্থীদের জন্য। তাকে এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে বলেন, 'আমাদের বাচ্চারা এত কষ্ট করে আমাদের সুখের দিন ফিরিয়ে এনেছে আবার। তারা এখন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কোনোরকম অর্থলাভের আশা বাদ দিয়ে রাস্তায় কাজ করছে। তাদের জন্য এতটুকু করতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। যতদিন এরা কাজ করবে, প্রতিদিন আমি এভাবে রান্না করে খাওয়াতে চাই ওদেরকে। এটা ওদের প্রাপ্য।'
পরিবর্তনের প্রত্যাশা
শুধু উত্তরা না, ঢাকার প্রায় প্রতিটা ব্যস্ততম সড়কের চিত্র এটি। মহাখালী, বাড্ডা, বনশ্রী, বিজয় সরণী, ফার্মগেট, শাহবাগ, কমলাপুর, মোহাম্মদপুর, মিরপুর—প্রায় সর্বত্রই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে গ্রুপ করে সময় অনুযায়ী রাস্তায় নেমে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বাসের রুট অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক শিক্ষার্থীরা নামছেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে। যেমন, চৈতালী বাসে যাতায়াতকারী শিক্ষার্থীরা মিরপুরে নেমেছেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য, ফাল্গুনী বাসের যাত্রীরা মহাখালী আর বাড্ডায়, আনন্দ বাসের যাত্রীরা যাত্রাবাড়িতে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থাকেও দেখা গেছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে। বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটের সদস্যরা রাস্তায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে নিয়োজিত আছেন। এছাড়াও ফায়ার সার্ভিস ও আনসারের সদস্যরাও দাঁড়াচ্ছেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
ঢাকার কয়েকটি জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অল্পবিস্তর অভিযোগও শোনা গেছে। একটি মোড়ে একসাথে আট-দশজন শিক্ষার্থী ট্রাফিকের কাজ শুরু করে বিশৃঙ্খলা হওয়ার কথা শোনা গেছে। কয়েকজন আবার ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীর সঙ্গে অতিরিক্ত খারাপ ব্যবহার করে বসছে বলে অভিযোগ আসছে। এগুলো ঠিক করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন রাস্তায় চলাচলকারীরা।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও এখন রাস্তায়। সবাই ব্যস্ত নতুন দেশকে নিজেদের মতো দারুণ করে গড়ে নেয়ার জন্য। তাদের এই নজিরবিহীন ব্যস্ততা হয়তো একদিন ফুরাবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস শুরু হবে একদিন। রাস্তায়ও ফিরে আসবেন ট্রাফিক পুলিশরা। কিন্তু তারা আইন রক্ষা করার জন্য যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলো, তা যেন বজায় থাকে এটাই সবার আশা।