খেরোখাতা: ডায়েরি, খাতা আর স্কেচবুকের গল্প
ভার্চুয়াল যুগে মানুষ যত যান্ত্রিক হয়েছে, ততই কমেছে খাতা-কলমের সঙ্গে সংযোগ। সবকিছু ডিজিটালাইজ করার তাড়নায় আমরা কবিতার খাতাকেও মুক্তি দিইনি। খাতার বদলে ফোনের নোটপ্যাড কেড়ে নিয়েছে কবিদের খাতায় টুকটাক কাটাকুটির সেই পুরোনো দিনগুলো। যে কাটাকুটি দিয়ে রবিঠাকুর এঁকে ফেলতেন ছবি, সেই কাটাকুটি অদৃশ্য হয়েছে ব্যাকস্পেসের চাপে। এখন আর রাফখাতা বলে কিছু হয় না। আমরা অনেকেই হয়তো খেরোখাতার নামগন্ধ জানি না। ডায়েরির যুগে খেরোখাতা শব্দটা খানিকটা অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে বটে। তবে এ প্রচলিত খেরোখাতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাঙালির নস্টালজিয়া।
'খেরো' শব্দটি বাংলায় এসেছে হিন্দি শব্দ 'খেয়া' বা 'ডেয়া' থেকে। এই খেরো বলতে এক ধরনের মোটা কাপড় বোঝানো হয়, যেগুলো বালিশ বা গদি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। খেরো দিয়ে লম্বা ধরনের হিসেবের খাতা বাঁধানোর চল ছিল একসময়। সেই থেকে এই হিসাবের খাতাগুলোকে খেরোখাতা বলার প্রচলন। মোটা লাল কাপড় দিয়ে বাঁধানো খাতায় জড়ানো থাকত লাল সুতো। বাংলা নববর্ষে বাংলার ব্যবসায়ীরা এই খেরোখাতার হিসেবনিকেশ মেটাতেই করতেন হালখাতার আয়োজন। ধারবাকির হিসেব চুকিয়ে নতুন বছরে শুরু হতো নতুন খেরোখাতার পাতা।
ব্যবসায়ীদের হিসেবের খাতা থেকে খেরোখাতা কবে যে শিল্পী কিংবা লেখকদের আঁকিবুকি, লেখালেখির আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল, সে ইতিহাস নাহয় না-ই বা লিখলাম। খেরোখাতা বাঙালি ব্যবসায়ীদের হিসেবনিকেশ পেরিয়ে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার একখানা মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের খেরোখাতার কথা শুনেছেন নিশ্চয় — যে খাতায় ৮টি চিত্রকর্মের পাশাপাশি শিল্পাচার্যের লেখায় ফুটে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র — যাকে আজকের যুগে কেউ কেউ বলেন ডায়েরি, কেউবা বলেন নোট খাতা।
মুদি বাজারের ফর্দ কিংবা বইয়ের তালিকা — সবকিছুতেই বাঙালির এই টুকে রাখার স্বভাবটা বেশ পুরোনো। এখন যা মোবাইল ফোনের নোটপ্যাডে টুকে রাখা হয়, আগে তা টুকে রাখা হতো এক টুকরো কাগজে। সেই টুকরো টুকরো কাগজই খেরোখাতা।
আমার বিভাগের এক সহপাঠী আঁকিবুঁকি করতে পছন্দ করে। ওকে কার্টুনিস্ট বললেই বোধ করি গুণীকে মান দেওয়া হয়। ক্লাস লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে ওর খাতার দিকে চোখ পড়লেই নানা ক্যারিকেচার দেখা যায়। এমনই একদিন কার্টুনিস্ট বন্ধুটির হাতে একটা বাক্সসদৃশ খাতা চোখে পড়লো। পাতাগুলো হলদেটে, খাতার আকার বেশ বড় — যেন এক আজব বাক্স। খাতার মধ্যে আঁকিয়ে এঁকে চলেছে স্টিল লাইফ।
সন্ধানে জানলাম, এ খেরোখাতা, ইংরেজিতে যাকে কেউ কেউ স্কেচবুক বলেন। খেরোখাতা কিনেছে 'খেরোখাতা' থেকে। এরপর সেই খেরোখাতার খোঁজে আমিও ছুটলাম দোকান 'খেরোখাতা'য়।
ঢাকার শাহবাগ মোড় থেকে পিজি হাসপাতালের দিকে কিছুটা এগোলেই আজিজ সুপার মার্কেট। মার্কেটের সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠতেই পাবেন এই দোকান। দোকানের বাইরে বড় বড় হরফে লেখা 'খেরোখাতা'। খুঁজে পেতে বেগ পেতে হবে না। তবে যেদিন যাবেন না, সেদিনটি হচ্ছে মঙ্গলবার। কেননা নীলক্ষেতের মতো আজিজ সুপার মার্কেটও মঙ্গলবার বন্ধ থাকে। সপ্তাহের অন্য দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে খেরোখাতার দরজা।
চলে তো এলাম। এবার ঘুরে দেখা যাক দোকানটা।
ছোটো পরিসরের একটা চৌকো ঘর। চারপাশে বুকশেল্ফ জুড়ে ডায়েরি আর স্কেচবুক। লাল, নীল, কালো কিংবা গোলাপি পাতার ডায়েরি। ডায়েরির ওপর বিভিন্ন ধরনের নকশা। সাদামাটা কিন্তু সাধারণ নয়, আছে নতুনত্বের ছোঁয়া। লালন শাহের গান, রবি ঠাকুর কিংবা তারাপদ রায়ের কবিতার লাইনের টুকরো দিয়ে মোড়া খেরোখাতার মলাট। কোনো কোনো ডায়েরির কভার জুড়ে কাজী নজরুল ইসলামের ছবি। আবার সেই পয়লা বৈশাখের স্মৃতিজড়িত খেরোখাতাও রয়েছে। বাংলাদেশের ডাকটিকিট, মানচিত্রখচিত পতাকার ছবি ঠাঁই পেয়েছে কিছু খেরোখাতার মলাটে। বেশিরভাগ ডায়েরিই ট্যাবলয়েড সাইজের, কিছু কিছু রয়েছে পকেট নোটবুক।
কাগজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। যেমন মোলায়েম, তেমনি লিখতে আরাম। খাতা, কলম, বই, ডায়েরিপ্রেমীর সংখ্যা ঢাকা নগরীতে একেবারে কম নয়। সে-সব ক্রেতাদের কাছে 'খেরোখাতা' এক নতুন আবিষ্কার। খাতা-ডায়েরির ভিড়ে নতুন রঙের অন্যরকম গন্ধে ঘোর লাগতে বাধ্য। কাস্টমাইজড ডিজাইনগুলো দেখলে মনে হবে, 'এ তো আমার জন্যেই তৈরি। ওরা জানল কেমন করে?' এমন সব অদ্ভুত সুন্দর খেরোখাতা দেখতে দেখতে চোখ আটকালো খানিক অন্যরকম বাঁশপাতার কাগজের একখানা ডায়েরিতে — ডায়েরির ওপর জয়নুল আবেদিনের আঁকা সাঁওতাল দম্পতির ছবি। স্কেচবুকও রয়েছে অনেক, নানা আকারের ও ডিজাইনের।
২০০৬ সাল থেকে কলম ও নোটবুক নিয়ে যাত্রা শুরু করে 'গ্রাসহপার্স' নামের একটি স্টেশনারি দোকান। দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী শুরুতে যেমনটা ভেবেছিলেন, তার থেকেও বেশি সাড়া পেতে শুরু করেন। সুতরাং, তিনি আস্তে আস্তে ব্যবসা বাড়ানোর কথা ভাবতে থাকেন। ডায়েরি, নোটবুক, স্কেচবুক ও খাতা নিয়ে গ্রাসহপার্সের আরেকটি সেকশন শুরু করার পরিকল্পনা করেন। এভাবেই ২০১২ সালে শুরু হয় 'খেরোখাতা'। খেরোখাতার পেছনে যেমন একটি ব্যবসায়িক চিন্তা আছে, তেমনি একটি নান্দনিক সত্তাও যে আছে, তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। প্রতিটি ডায়েরির পাতা থেকে মলাট, ডিজাইন কাস্টমাইজেশনে আছে নান্দনিকতার ছোঁয়া, রয়েছে রুচির পরিচয়।
দোকানের পণ্যগুলোর প্রোডাকশন থেকে ডিজাইনিংয়ের সমস্ত কাজ একা হাতে সামলান খেরোখাতার স্বত্বাধিকারী। চা খেতে খেতে তার সঙ্গে আলাপ হলো। প্রথম আলাপ হলেও আন্তরিকতায় মনে হলো কতদিনের চেনা। গল্পচ্ছলে অনেক কথা হলো।
তিনি জানালেন, ডায়েরির মলাটে থাকা বিভিন্ন ধরনের দার্শনিক উক্তি, কবিতা বা গানের চরণের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের চাহিদা ও রুচির ব্যাপারটাকে মাথায় রাখার চেষ্টা করেন। এই চাহিদার ভিত্তিতেই ৫ থেকে ১০ শতাংশ পণ্য পুনরুৎপাদন করা হয়। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে ডিজাইন বদলানো হয় প্রতি মাস অন্তর। নতুনত্বের দিকে সর্বোচ্চ নজর দেয়া হয়। এজন্য কিছুদিন পর এলে আগের ডিজাইনের সেই পণ্যটি হুবহু পাওয়ার আশা কম থাকে।
'খেরোখাতা' তাদের ডিজাইন কাস্টমাইজেশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় দেশপ্রেম এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে। খেরোখাতার আলাদাভাবে কোনো প্রোডাকশন হাউজ নেই। সুযোগ-সুবিধা এবং চুক্তিভিত্তিতে কখনো নীলক্ষেত, কখনো পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ডায়েরি, খাতা কাস্টমাইজেশনের কাজ করেন দোকানটির মালিক।
একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি খেরোখাতার অন্যতম কাস্টমার বলে জানাচ্ছিলেন স্বত্বাধিকারী। বাংলাদেশ থেকে যারা বাইরের দেশে পড়তে যান বা কর্মসূত্রে বসবাস করেন, তারা উপহার হিসেবে এসব দেশীয় পণ্য কিনতে চান।
খেরোখাতার একজন নিয়মিত ক্রেতা শেখ অহোনা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসের ফাঁকে সুযোগ পেলেই মাঝে মাঝে খেরোখাতায় ঢু মারেন। অহোনার ভাষ্য, 'খেরোখাতায় যতবারই আসি, সবকিছু কিনে ফেলতে ইচ্ছে করে। প্রতিবারই সব নতুন মনে হয়। আমি শিল্পবিশারদ নই, তবু চোখে যা সুন্দর লাগে, সেটা ধরতে পারি। এত সুন্দর খাতা, ডায়েরি দেখে কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনব, বাছতে হিমশিম খেতে হয়।'
এই দোকানটি মূলত অফলাইনে বেচাকেনা করে। যদিও কোভিডের সময় স্বল্প পরিসরে অনলাইন বিক্রি শুরু হয়েছিল, যা এখনো সীমিত পরিসরে অব্যাহত আছে। ক্রেতারা অনলাইন পেজ এবং হোয়াটসঅ্যাপে মতামত জানানোর সুযোগ পান। ক্রেতার কোনো সুপরামর্শ বা অভিযোগের ক্ষেত্রে খেরোখাতা যথেষ্ট আন্তরিক।
তবে আপনি যদি খাতা, ডায়েরি বা স্কেচবুকপ্রেমী হন, তাহলে খেরোখাতায় এসে কেনাকাটা করাটাই একটি অ্যাডভেঞ্চারের মতো হবে। দোকানে বিশেষ কোনো শোভা নেই, তবু পণ্যগুলোই দোকানটির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ।
শিক্ষার্থীদের কাছে ডায়েরি ও কলম অন্যতম প্রিয় কিছু জিনিস। আজকের যুগেও কেউ কেউ কাগুজে ডায়েরি লেখেন, কারো আবার জার্নালিংয়ের শখ আছে। দিনপঞ্জি লেখার অভ্যাস কমে গেলেও একেবারে উবে যায়নি। তবে, দুর্মূল্যের বাজারে শখের জিনিসের দাম লাখ টাকা, সবার সেই শখ পূরণ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে খেরোখাতায় শুধু চোখের শান্তি নয়, পকেটেরও খানিকটা সাশ্রয় হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা কিছু টাকা জমাতে পারলে ছোটে খেরোখাতায়। বর্তমান প্রজন্ম এখনো নোটখাতা কিনছে এবং ধীরগতিতে হলেও নোটখাতার ব্যবহার বাড়ছে। তারা এসব নোটবুক বা ডায়েরি প্রিয়জনকে উপহার দিচ্ছে, রাঙিয়ে তুলছে তাদের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে। আর সেইসব মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকছে 'খেরোখাতার' মতো ডায়েরির দোকানগুলো।
ছবি: টিবিএস