ছাতিমের শহর রাজশাহী: ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে নগর
'অপু বলিল, কী ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে, না দিদি? তাহাদের মা বলিল, তাহাদের জ্যেঠামশায়ের ভিটার পিছনে ছাতিম গাছ আছে, সেই ফুলের গন্ধ। তাহার পর সকলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। রাত্রি গভীর হয়। ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাসে হেমন্তের আঁচলাগা শিশিরাদ্র নৈশবায়ু ভরিয়া যায়। মধ্যরাতে বেনুবনশীর্ষে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের ম্লান জ্যোৎস্না উঠিয়া শিশিরসিক্ত গাছপালার ডালে পাতায় চিকচিক করছে।'
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে ছাতিম ফুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন, তার আবেশ কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে রাজশাহীর রাতের শহরে। নগরীর রাতের বাতাস এখন এমনই তীব্র ছাতিম ফুলের মিষ্টি সুবাসমাখা। ছাতিমের এমন মনমাতানো তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ যেন নগরবাসী আগে কখনো পাননি। ছাতিমের এতো ফুলও আগে কখনো দেখেননি নগরবাসী। হালকা সবুজাভ সাদা ফুলে ভরে উঠেছে ছাতিম গাছগুলো— যা দিনের বেলায় রৌদ্রে ঝলমল করে শোভা বাড়ায় শহরের।
কোনো শহরে বেড়াতে গেলে প্রাচীন বৃক্ষ হিসেবে দু-একটা ছাতিম গাছের দেখা মিলেই যায়; যা হয়তো যত্রতত্র বেড়ে উঠেছে অনাদরে, অযত্নে ও অপরিকল্পিতভাবে। কিন্তু রাজশাহী শহরের কথা একদম ভিন্ন। এই নগরে সড়কের দুই ধারের ফুটপাতে একটির পর একটি ছাতিম গাছ লাগানো হয়েছে একেবারে পরিকল্পনা করে। দেশের রাজশাহী শহরেই বোধহয় এমন পরিকল্পিতভাবে ছাতিম লগনো হয় প্রথম এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তা সংখ্যায়ও যেকোনো জায়গার তুলনায় অনেক বেশি।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে বলা হচ্ছে, গত কয়েক বছরে নগরীর বিভিন্ন চওড়া ফুটপাতে প্রায় ৫৬০টি ছাতিম গাছ লাগানো হয়েছে। এরমধ্যে নগরীর রেলগেট থেকে সিঅ্যান্ডবি মোড় পর্যন্ত সড়কের ফুটপাত, সিপাইপাড়া জেলখানার পিছনের সড়কের ফুটপাত, উপশহর, সপুরাসহ বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতে এসব ছাতিম গাছ লাগানো হয়েছে।
এরমধ্যে শুধু রেলগেট থেকে সিঅ্যান্ডবি মোড় পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়কের দু'পাশের ফুটপাতে লাগানো হয়েছে ৩৫০টি ছাতিম গাছ। এসব গাছ এখন ভরে উঠেছে ফুলে ফুলে।
তবে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলায় বহরমপুর ঘোড়া চত্বর থেকে বর্নালী মোড় পর্যন্ত সড়কে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়িতে এলাকাটি ধুলায় আচ্ছাদিত হয়ে থাকায় এ এলাকার ফুটপাতে মনোযোগ দিয়ে না দেখলে ছাতিম গাছ চোখে পড়া কষ্টকর।
নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার চা বিক্রেতা আব্দুর রশিদ বললেন, "সন্ধ্যার পর থেকে ছাতিম ফুলের এমন তীব্র মিষ্টি গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যা মন ভালো করে দেয়। এই গাছের কারণে অনেক মানুষজন রাতে এই সড়কে ঘুরতে আসেন। বাতাস থাকলে দূর থেকে গন্ধ পাওয়া যায়।"
আরেকজন চা বিক্রেতা মোহাম্মদ জীম বলেন, "এই গাছগুলো অনেক বছর ধরে লাগানো হয়েছে, কিন্তু এত ফুল কখনো ধরেনি। বিকেলের পর থেকে ফুলের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে ছবি তোলেন। অনেকে সন্ধ্যার পর রাতে এসে এখানে আড্ডা দেন, চা খান।"
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক সুমাইয়া শাম্মী বলেন, "রাতে ছাতিমের এত তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, লক্ষ্মীপুরে যেতে হয়না; মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তায় বের হলেই দূর থেকে নাকে এসে লাগে। তবে দিনের বেলায় কেবল গাছের কাছে গেলেই গন্ধ পাওয়া যায়।"
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালের পর থেকে শহরের বিভিন্ন পথের ধারে ফুটপাতে ছাতিমগাছ লাগাতে শুরু করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় স্থায়ী-অস্থায়ী ও মৌসুমী ফুলের বিভিন্ন বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা সেই ২০০৯ সালের। 'জিরো সয়েল প্রজেক্টের' মাধ্যমে রাজশাহী সিটির সড়ক বিভাজক ও ফুটপাতে লাগানো শুরু হয় এসব গাছ।
যখন ছাতিম গাছগুলো সড়কে রোপণের পরিকল্পনা করা হয়, তখন সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন আশরাফুল হক। তিনি বলেন, "২০০৯ সালে সিটি করপোরেশনে এলাকায় ব্যাপক বৃক্ষরোপণের জন্য জিরো সয়েল প্রজেক্ট গড়ে তোলা হয়। এই প্রজেক্টের পার্টনারশিপে ছিল 'একলি সাউথ এশিয়া' নামের একটি আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন এবং নরওয়ের একটি প্রতিষ্ঠান।"
"বৃক্ষরোপণের জন্য তারা বেশকিছু ফান্ডিং করেছিলেন। এছাড়া, সরকারি টাকা ও সিটি করপোরেশনের টাকা দিয়ে প্রতিবছর বড় বড় পরিকল্পনা নিয়ে গাছ লাগাতাম," বলেন তিনি।
তবে কী কী ধরনের গাছ লাগানো হবে, এরজন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিটি করপোরেশনের পরিবেশ উন্নয়ন স্থায়ী কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করা হয় বলে জানান এই প্রকৌশলী।
তিনি বলেন, "কমিটির সভায় প্রধানত কী কী ধরনের বৃক্ষ, কোন কোন এলাকায় রোপণ করা হবে তা নির্ধারণ করা হতো। পলিসি লেভেলের মিটিং হতো। একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর পরিবেশ স্থায়ী কমিটির প্রধান হতেন।"
আশরাফুল হক আরও বলেন, "আমরা গাছ রোপণের সময় মূলত প্রাধান্য দিতাম এই অঞ্চলের আবহাওয়া। যে গাছ এই আবহাওয়ায় টিকবে, আর নগরবাসীকেও স্বস্তি দেবে। তারপর গুরুত্ব পেত ফুটপাতে যে গাছ লাগানো হবে, তা টেকসই হবে কি না। কারণ ফুটপাতে গাছের ওপর খুব নির্যাতন হয়, নির্যাতন সয়েও যে গাছটি টিকতে পারবে, আমরা তেমন গাছ ফুটপাতে রোপণ করার চেষ্টা করেছি। এদিক থেকে দিয়ে ছাতিম গাছ সেরা।"
"শহরের সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে রেলগেট পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার সড়কের দুইপাশে টানা ৩৫০টি ছাতিম গাছ রোপণ করা হয়েছে— দেশের আর কোথাও এমনটি নেই।"
তিনি বলেন, আমরা যখন সিদ্ধান্ত নিলাম এই সড়কটির ফুটপাতে ছাতিম গাছ রোপণ করবো, তখন ছাতিমের চারা সংগ্রহ করাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়লো। কারণ বাংলাদেশের কোনো নার্সারীতে একসাথে এত ছাতিম গাছ আমরা পাইনি। পরে ঢাকার আগারগাঁও সবুজ নার্সারী থেকে আমরা চারাগুলো সংগ্রহ করি।"
"গাছগুলো রোপণের সময়ও আমাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। ফুটপাত কেটে গাছগুলো বসাতে হয়েছে। তারপর অনেকটা সময় পর্যন্ত গাছগুলো বাঁশের বাখারির বেড়া দিয়ে রাখতে হয়েছে যাতে কেউ নষ্ট করতে না পারে।"
"ছাতিম গাছ পথতরু হিসেবে লাগানো হয়েছে। কারণ এটি কষ্ট সহিষ্ণু, সবচেয়ে বেশি নির্যাতন সয়ে বেড়ে উঠতে পারে, ঝাঁকড়া হয়ে ছায়া দেয় ও লম্বায় ৪০ ফুট উঁচু হয়।"
"হেমন্তকালে ফুল ফুটলে এর গন্ধ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। যাতে পথচারীরা এর গন্ধ পেয়ে নগর জীবনের অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করতে পারে," যোগ করেন তিনি।
সিঅ্যান্ডবি মোড়েই ছাতিম গাছের নিচে ডাব বিক্রি করেন আজাদ আলী। তিনি বলেন, "রোদের নিচে ডাব রাখলে গরম হয়ে যায়। তাই এই গাছের নিচে দাঁড়িয়েছি। রোদ থেকেও বাঁচা যাচ্ছে, আবার ডাবও বিক্রি করা যাচ্ছে।"
তার একটু দূরে আরেকটা ছাতিম গাছের নিচে সবজি বিক্রি করছেন শ্রী রতন নামের আরেক দোকানদার। তিনি জানান, প্রতিদিন সকাল ৯টা বিকেল ৬টা পর্যন্ত তিনি এই গাছের নিচে বসে সবজি বিক্রি করেন। এক বছর ধরে তিনি এখানেই বিক্রি করছেন। বললেন, "কাঁচা জিনিস রোদে রাখলে শুকিয়ে যায়। এই গাছ থাকায় সুবিধা হয়েছে।"
আরেক গাছের নিচে গার্মেন্টসের দোকান দিয়েছেন ফুটপাত ব্যবসায়ী আরিফ। দুই বছর ধরে এখানেই ব্যবসা করছেন তিনি। তার সোজাসাপ্টা উত্তর, "ছাতিম গাছ না থাকলে এই রোদে টিকতে পারতাম না।"
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মোহাম্মদ শহিদুল আলম জানান, "ছাতিম গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। সেখানে ছাতিম গাছ ফিরিয়ে এনে আবার রোপণ করাটা নিঃসন্দেহে আশার কথা। কারণ ছাতিম গাছ ভেষজ উদ্ভিদ এবং বারিন্দ অঞ্চলের জন্য খুবই দরকারি। এটি পরিবেশের জন্য সহায়ক।"
পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনা করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন ২০১৯ সালে পরিবেশ শাখা নামে একটি সম্পূর্ণ নতুন শাখা স্থাপন করে। একজন কর্মকর্তাসহ প্রায় ৮০ জন দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মীর নিবিড় তত্ত্বাবধান ও পরিচর্যায় রাজশাহী মহানগরীর পরিবেশ উন্নয়নমূলক ও সবুজায়ন কার্যক্রম নিয়মিত হয়ে আসছে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পরিবেশ শাখা প্রধান ও পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ উল ইসলাম জানান, ছাতিম গাছ দ্রুত বর্ধনশীল। তীব্র রোদে মানুষকে ছায়া দেয়। আবার এ সময় এর মিষ্টি গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
"এক কিলোমিটার দূর থেকেও এই ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। ফুল ঝরে যাওয়ার পর এর বীজ আমরা সংগ্রহ করি। পরে বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা হয়," যোগ করেন তিনি।