‘ইন্টারন্যাশনাল’ হলের ‘ন্যাশনাল’ ইন্টারেস্ট
'বিয়ে করে নে, ইন্টারন্যাশনাল হলে সিট পাবি!' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমন কথা হরহামেশাই শোনা যায়। বন্ধুদের আড্ডা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক গ্রুপগুলোতে এটি এক মজার আলাপ। আর এমন আলাপ থেকেই শিক্ষার্থীদের মনে জমে কৌতূহল! অন্যান্য হলের করুণ দশা যেন এ কৌতূহলকে আরও উসকে দেয়।
'কেমন হল এটি? কারাই বা থাকেন এখানে?'—এমন প্রশ্ন উঁকি দেয় মনে। সব মিলিয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মিত এ 'ইন্টারন্যাশনাল' হল নিয়ে 'ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট' যে খুব কম নয়, তা বলা চলে।
১৯৬০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস। শুরুতে এটি শুধু ইন্টারন্যাশনাল হল হিসেবেই পরিচিত ছিল। ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্যের নামে হলটির নামকরণ করা হয় স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের মতো এ হলটি আবাসিক হলেও এর আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। ক্যাম্পাসের সবার কাছে তো বটেই, খোদ হলপাড়ার শিক্ষার্থীদের কাছেই হলটি এক রহস্য। ক্যাম্পাসজুড়ে নানা ধরনের গুঞ্জনও রয়েছে এ নিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলগুলোর সঙ্গে এর পার্থক্য নিয়েও চলে নানাবিধ আলোচনা। তার ওপর আছে হলকেন্দ্রিক প্রচলিত গালগল্পের ফোয়ারা।
ইন্টারন্যাশনাল হল নিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহের অন্যতম কারণ এর ভিন্নতর পরিবেশ। যেখানে অন্যান্য হলগুলো মূলত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ, সেখানে ইন্টারন্যাশনাল হলে কেবল বিদেশি শিক্ষার্থীরাই থাকার সুযোগ পান।
অনেকের মধ্যে ধারণা রয়েছে যে, স্থানীয় শিক্ষার্থীরাও কেউ কেউ এ হলে থাকেন। আবার কেউ কেউ ভাবেন, ঢাবির বিবাহিত শিক্ষার্থী দম্পতিরাও এখানে থাকার সুযোগ পান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শাহনাজ পারভীনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, 'শুনেছি এ হলে নাকি দুজন স্টুডেন্ট বিয়ে করলেই থাকতে পারে। তবে সেটা থার্ড ইয়ার থেকে।'
তিনি আরও জানান, 'মজার কথা হলো, এটা শুনে আমার এক বন্ধু বিয়ে করে সেখানে থাকার পরিকল্পনা করেছিল এবং আবেদন করেছিল। কিন্তু তাদের আবেদন গ্রহন করা হয়নি।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী দিলোরা জাহান বলেন, 'আমি অনেকের কাছে শুনেছি এখানে অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীও থাকতে পারে। এমন কিছু উদাহরণও শুনেছি।'
শাহনাজ বা দিলোরার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী হলটি নিয়ে এভাবেই ভাবেন। অনেকে এ ধরনের শোনা কথার ভিত্তিতে হলে থাকার জন্য বিয়ের আবেদনও করে বসেন। কিন্তু তারা কি সফল হন? আসলেই কারা এখানে থাকেন? এ বিষয়ে আরও জানতে হলের আবাসিক শিক্ষক এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
শোনা কথাগুলো কতটা সত্য?
দুজন শিক্ষার্থীর বিয়ে করে থাকার প্রসঙ্গে হলের আবাসিক শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, বিবাহিত শিক্ষার্থী মাত্রই যে এখানে থাকতে পারবেন, এটি পুরোপুরি সত্য নয়। এছাড়া এ হলে কেবল পুরুষ শিক্ষার্থীরাই থাকতে পারেন।
বিদেশি নারী শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য আলাদা বন্দোবস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারা থাকেন রোকেয়া, কুয়েত মৈত্রি বা সুফিয়া কামাল ইত্যাদি হলে।
ড. ইলিয়াস ব্যাখ্যা করেন, 'দুজন শিক্ষার্থী বিয়ে করে থাকতে পারেন, তবে কিছু শর্তও রয়েছে। উভয়কেই ঢাবির শিক্ষার্থী হতে হবে এবং অবশ্যই বিদেশি হতে হবে। এ নিয়ম স্থানীয় শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।'
তিনি আরও জানান, দুজন বিদেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে দুজনকেই অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা এর অধিভুক্ত কোনো ইনস্টিটিউট অথবা সংযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হতে হবে। অর্থাৎ, যদি একজন ঢাবির শিক্ষার্থী হন এবং অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে আসা হন, তাহলে তারা হলের আবাসিক সুবিধা পাবেন না। একইভাবে, দুজন বিদেশি হলেও যদি একজন শিক্ষার্থী না হন, তাহলে তারা হলে থাকার অধিকার পাবেন না।
শিক্ষার্থী ছাড়া আরও যারা থাকেন
ফজলুর রহমান (ছদ্মনাম) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। একসময় ছাত্ররাজনীতি করতেন বলে ক্যাম্পাসে এখনো তার বেশ প্রভাব রয়েছে। তিনি মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে এলে ইন্টারন্যাশনাল হলে এক বন্ধুর কক্ষে এসে থাকেন। আগস্ট মাসে সরকার পরিবর্তনের পর অবশ্য আর আসেননি।
প্রশ্ন হলো, বিদেশি শিক্ষার্থীদের হলে দেশি মানুষ কীভাবে থাকতে পারেন?
জানা যায়, বিদেশি শিক্ষার্থী ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিবাহিত শিক্ষকদের জন্যও এখানে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অনেক শিক্ষক পরিবার নিয়েও এখানে থাকেন বলে প্রচলিত কথা রয়েছে।
হলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সৈয়দ আবদুল্লাহ ইবনে হাসান জানান, 'প্রথমে আমরা ব্যাচেলর শিক্ষক হিসেবে থাকার অনুমতি দিই। পরে তারা বিয়ে করলে স্ত্রী নিয়ে থাকতে পারেন, যা সিন্ডিকেট অনুমোদিত।'
তিনি আরও জানান, এখানে শিক্ষকদের জন্য রুম পাওয়ার ক্ষেত্রে সিরিয়াল মেনে চলতে হয়। অর্থাৎ যার সিরিয়াল আগে থাকবে, তিনি আগে কক্ষ পাওয়ার সুযোগ পান।
হলে মোট ১১৬টি কক্ষ আছে। এর মধ্যে শিক্ষকদের জন্য ৫৩টি, অফিসারদের জন্য ৩টি এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ৬০টি কক্ষ। এছাড়া আরও অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী হলের সঙ্গে সংযুক্ত, যারা বাইরে থাকেন এবং অনাবাসিক তালিকাভুক্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত মেডিকেলসহ অন্যান্য ইন্সটিটিউটের বিদেশি শিক্ষার্থীরা এখানে থাকার জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে ঢাবির শিক্ষার্থীরা সিট পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান।
বর্তমানে এ হলে ঢাবির ২৮ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। বাকিরা অন্যান্য ইন্সটিটিউটের। ঢাবির শিক্ষার্থীদের সিট দেওয়ার পর অবশিষ্ট সিট থাকলে অন্যদের থাকা সম্ভব। এছাড়া অ্যাটাচড মেডিকেল শিক্ষার্থীরাও সিট খালি থাকার সাপেক্ষে এখানে থাকতে পারেন।
কী আছে ভেতরে?
অনেকের কৌতুহল, কী রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল হলে? কী কী সুবিধা বেশি পান বিদেশি শিক্ষার্থীরা? হলের ভেতরে কী এমন আহামরি সুযোগ-সুবিধা আছে? এসব বিষয়ে কথা বললেন দায়িত্বরত কর্মকর্তা ইবনে হাসান।
তিনি বললেন, 'ইন্টারন্যাশনাল হলের সুরক্ষা ও সুবিধা অন্যান্য হলের তুলনায় বেশ উন্নত। এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য সবকিছু বিশেষভাবে করা হয়েছে। এমনকি ওদের এমন খাবার দেওয়া হয় যা স্বাস্থ্যগুণ যথাযথভাবে নিশ্চিত করে। পড়াশোনা করার জন্য আছে স্টাডি রুম, যেখানে তাদের গাদাগাদি করে বসতে হয় না। ছাত্ররা কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধাসহ একটি লাইব্রেরিও ব্যবহার করছে। খেলাধুলার জন্য ইনডোরেও সুব্যবস্থা রয়েছে।'
এ হলের কক্ষগুলোও বেশ গোছালোভাবে সজ্জিত। প্রতিটি রুমের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ওয়াশরুম। যেখানে অন্যান্য হলে একটি রুমে ৭-৮ জন শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়, সেখানে ইন্টারন্যাশনাল হলে দু'জন শিক্ষার্থীর জন্য বরাদ্দ থাকে একটি কক্ষ।
ইবনে হাসান আরও জানালেন, শিক্ষার্থীদের জন্য এখানে আলাদা ক্যান্টিন রয়েছে, যেখানে শুধু তারাই খেতে পারেন। কোনো দেশি শিক্ষার্থীর খাওয়ার অনুমতি নেই সেখানে। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী রান্না করা হয়। প্রতিটি কক্ষেই রয়েছে ফাইল কেবিনেট, দুটো টেবিল, এবং স্টিলের বেড। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে প্রতিটি কক্ষের আয়তন ১৪ ফিট। এসি লাইব্রেরির পাশাপাশি রয়েছে একটি জিমনেসিয়ামও।
হলের পরিবেশ নিয়ে কথা হলো নেপালি শিক্ষার্থী ওয়াসিম আখতার আনসারির সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি বিভাগে পড়ুয়া ওয়াসিম জানান, আরেকজন আবাসিকের সঙ্গে তিনি একটি কক্ষ শেয়ার করেন, কিন্তু এত সুবিধার পরেও বার্ষিক ফি বেশি নয়।
তিনি বলেন, 'প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য হল ফি বছরে মাত্র ৭,২০০ টাকা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য এ টাকা একেবারেই বেশি নয়, যদি সুবিধার কথা চিন্তা করি। তাছাড়া ২৪/৭ নিরাপত্তা প্রদান করা তো রয়েছেই।'
প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. এমদাদুল ইসলাম জানান, বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল হলের শিক্ষার্থী সংখ্যা নব্বইয়ের আশপাশে। এর মধ্যে নেপালি শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৩৫-৩৬ জন। এছাড় ভুটান, মালেশিয়া, ফিলিস্তিন, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ভারতসহ মোট ৮-৯টি দেশের শিক্ষার্থী আছেন হলটিতে।
মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢাবির শিক্ষার্থী আছেন ২৮ জন। তাদের অধ্যয়নরত বিভাগ হলো, ফার্মেসি, কম্পিউটার সায়েন্স, মর্ডান ল্যাংগুয়েজ। এর মধ্যে ফার্মেসি এবং কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীই সবচেয়ে বেশি বলে জানান এমদাদুল ইসলাম।
তার হিসেব মতে, আগের চেয়ে শিক্ষার্থী অনেক বেড়েছে। গত ৮ বছরে এত শিক্ষার্থী ছিল না। তবে একদম আগে, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে অনেক শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসতেন। বর্তমানে ঢাবির শিক্ষার্থীর চেয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি বলে জানালেন তিনি।
নেই রাজনীতি, তেমন অসুবিধা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে এক আতঙ্কের নাম ছিল গেস্টরুম-গণরুম। প্রতিটি হলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে রুম দখল এবং শিক্ষার্থীদের গণরুমে বাধ্য করে রাখার মতো ঘটনাগুলো ঘটে এসেছিল বিগত সরকারগুলোর আমলে। তবে ইন্টারন্যাশনাল হল বরাবরই রাজনীতিমুক্ত।
হলের আবাসিক শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, 'কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এখানে দেখানো যায় না। এমনকি জোর খাটিয়েও কেউ থাকতে পারে না।' তিনি আরও বলেন, 'জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে আমরা এখানে অনেক নারী শিক্ষার্থীকে আশ্রয় দিয়েছি এবং কারও কোনো সমস্যা হয়নি।'
সব সুবিধার পরেও কিছু অসুবিধা রয়েছে বলে জানান নেপালি শিক্ষার্থী আনসারি। তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই হলে বসবাস করায় দুটি দলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় এবং যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি হয়। একমাত্র স্টাডি রুম শিক্ষকদের জন্যও বরাদ্দ হওয়ায় পড়াশোনার সুযোগ কমে যায়। অন্য হলের ছাত্ররা রাত ১২টায় বাইরে যেতে পারেন, যা আমরা পারি না; রাত ১২টায় গেট বন্ধ হয়ে যায়।'
ছোটখাটো কিছু অসুবিধা থাকলেও ইন্টারন্যাশনাল হল নিয়ে সন্তুষ্ট এখানকার শিক্ষার্থীরা। দেশি শিক্ষার্থীরাও আশা করেন, এ হলের ইতিবাচক দিকগুলো অন্য হলগুলোতে যুক্ত করলে সবারই উপকার হবে।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদ পল্লব বলেন, 'আমাদের হলের ডাইনিংয়ে খাবার কেন উন্নত করা যায় না? ইন্টারন্যাশনাল হলের পলিসি থেকে আমাদের শিখতে হবে। বিদেশি শিক্ষার্থীরাদের জন্য যে-সব ব্যবস্থা, আমাদের হলগুলোতেও তা করা গেলে আমাদের উপকার হতো।'
তাই আফসোস নয়, গালগল্পও নয়, ইন্টারন্যাশনাল হলের ইতিবাচক দিকগুলোর দিকেই নজর শিক্ষার্থীদের।