কেন আমাদের এখনও পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন হয়?
২৯ সেপ্টেম্বর ফিনিক্স রোডের পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে জড়ো হওয়া প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাসানুল হক। তাদের একজন সংগঠক মো. সাইফ আহমেদের মতে, ২৬তম সার্জেন্ট এবং ৪০তম পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) নিয়োগ পরীক্ষার পুলিশ ভেরিফিকেশন বা যাচাইয়ের সময় তাদের বাদ দেওয়া হয়, কারণ তাদের পরিবারের সঙ্গে একটি "রাজনৈতিক দল" বা "বিএনপি"-র সংশ্লিষ্টতা ছিল।
হাসানুল বলেন, "আমি রাজশাহীতে তিন দিন প্রচণ্ড রোদের মধ্যে শারীরিক পরীক্ষায় অংশ নিই। সেখানে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমাকে লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়। লিখিত পরীক্ষার পর আমাদের কম্পিউটার পরীক্ষা নেওয়া হয়। কম্পিউটার পরীক্ষার আগে আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ জানার জন্য পুলিশ পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়।"
তিনি আরও বলেন, "শুধু যারা আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত, তাদেরই এই ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে চাকরির জন্য সুপারিশ করা হয়।"
রাজবাড়ী সরকারি কলেজের স্নাতক হাসানুলের মতে, তিনি কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমে অংশ নেননি এবং তার পরিবারের সদস্যরাও এ ধরনের কোনো কার্যক্রমে অংশ নেননি।
তিনি বলেন, "আমার চাচা বিএনপিকে সমর্থন করতেন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতেন।"
এখন তারা সরকারের পক্ষ থেকে পুনরায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ওই পদে নিয়োগের জন্য অপেক্ষা করছেন।
এ বছরের ২৪ অক্টোবর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, যে কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য (যার মধ্যে সম্প্রতি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগও অন্তর্ভুক্ত) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তিনি বলেন, এই সংগঠনগুলোর যেসব সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছেন, তাদেরও বাদ দেওয়া হবে।
তবে ওই ঘোষণার এক মাস পর, ১৯ নভেম্বর পুলিশ সংস্কার কমিশন বিশেষ করে চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে প্রার্থীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পরীক্ষা করার প্রথা বন্ধ করার সুপারিশ করেছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তিনি বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশন অব্যাহত থাকবে, তবে "প্রার্থীর বা তাদের পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক সম্পর্ককে বিবেচনায় নেওয়া হবে না। জাতীয় পরিচয়পত্রকে যাচাইয়ের জন্য মূল দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হবে।"
পুলিশ ভেরিফিকেশন সাধারণত প্রার্থীর দেওয়া ঠিকানায় স্থানীয় থানার পুলিশদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তারা প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে যাচাই করেন প্রার্থী সত্যিই ওই ঠিকানায় বসবাস করছেন কি না। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে তার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হয়।
এটি আমাদের দেশে শুধু চাকরির নিয়োগের জন্য নয়, বরং পাসপোর্ট আবেদনেও ব্যবহৃত হয়। যখন স্থানীয় পুলিশ স্টেশন থেকে কেউ বাড়িতে যাচাই-এর জন্য যায়, তখন অনেকেরই 'চা-পানি' চাওয়ার অর্থাৎ ঘুষ চাওয়া কুখ্যাতি রয়েছে।
এটি একটি নতুন প্রথার জন্ম দিয়েছে – স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে চরিত্র সনদ প্রদান।
সাবেক আইজিপি (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ) মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, এই প্রথাগুলো রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশরা এখানে প্রবর্তন করেছিল। ১৯২০-এর দশকে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং স্বদেশী আন্দোলন তুঙ্গে ছিল এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তারা আক্রমণের শিকার হচ্ছিল, তখন তারা চাকরির নিয়োগে 'পুলিশ ভেরিফিকেশন' চালু করেছিল; যাতে নিশ্চিত হওয়া যায়, প্রার্থীর কোনও ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক বিশ্বাস বা ভাঙচুরের সাথে সম্পর্ক নেই।
"রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা উপমহাদেশের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ ভারতের সময় এবং পরে পাকিস্তান আমলেও কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল," বলেন হুদা।
তিনি যোগ করেন, "যারা এই দলগুলোর সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হতো না। পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞা উঠানোর পর এটি আর সমস্যা ছিল না।"
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া, যা ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৯২৯ সালের দিকে ব্রিটিশরা দলটিকে নিষিদ্ধ করে। ১৯৪২ সাল যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ পক্ষের সাথে যুক্ত হয়, তখন নিষেধাজ্ঞাটি উঠিয়ে নেওয়া হয়।
পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিকে ১৯৫৪ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সরকারের উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়। এই সময়গুলোতে, বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হতো না।
এখন সেই নিষেধাজ্ঞা না থাকায়, 'বামপন্থিরা' বা সেই দলের সদস্যরা সরকারি পাবলিক সেক্টরে যোগ দিতে পারছেন।
তবে এই প্রথা বাংলাদেশে এখনও বজায় রয়েছে, যেখানে পুলিশ যাচাই করে দেখে, আবেদনকারী কোনো 'বিধ্বংসী' কার্যকলাপে বা জাতির সরাসরি মূলনীতির বিপরীত কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত কিনা।
"কারণ এই ধরনের মানুষদের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদে আসতে দেওয়া উচিত নয়, জাতির কল্যাণের জন্য। তাদের নিয়োগ দেওয়া মানে ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা," বলেন সাবেক আইজিপি।
পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে, স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের চরিত্র সনদ নেওয়া প্রয়োজন, যা অন্যান্য কাগজপত্রের সাথে জমা দিতে হয়।
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন কার্ড সংগ্রহের জন্যও এই চরিত্র সনদ প্রয়োজন। এসব সনদে বলা থাকে, কমিশনার বা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আপনাকে চেনেন এবং নিশ্চিত করেন, আপনার চরিত্র 'ভালো' এবং আপনি কোনো অপরাধমূলক বা বিধ্বংসী কার্যকলাপে জড়িত নন।
কিন্তু কমিশনার বা চেয়ারম্যান এই ব্যক্তিকে কীভাবে চেনেন? এর উত্তর জানার জন্য আমরা ঢাকার ২ নং ওয়ার্ড কমিশনার আতিকুল ইসলামের অফিসে যাই। তবে তিনি অফিসে ছিলেন না। সেখানে আমরা তার সচিব মো. সাইফুলের সঙ্গে কথা বলি, যিনি আমাদের প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেন।
সাইফুল বলেন, "আমরা কাউকেই এমনিতেই সনদ দিয়ে দেই না। আপনাকে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং তার কপি, জন্ম সনদের কপি এবং আপনার বাসস্থানের বিদ্যুৎ বা গ্যাস বিল আনতে হবে। এছাড়া, আমরা আপনার বাসার মালিক এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তথ্য যাচাই করি, তারপর সনদ প্রদান করি।"
তারা মূলত পরীক্ষা করেন, ব্যক্তি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত কি না বা বাসার মালিক এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কোনো আপত্তি আছে কি না। যখন আমরা তাদের কাছে জানতে চাইলাম তারা কি অর্থের বিনিময়ে সনদ দেন– সাইফুল তা অস্বীকার করে বলেন, তারা চরিত্র সনদ বিক্রি করেন না।
তবে, এই ডিজিটাল যুগে, যেখানে প্রত্যেকেরই নানা প্ল্যাটফর্মে ডিজিটাল ট্রেস রয়েছে, চরিত্র সনদের জন্য আবেদন করা কতটা যুক্তিযুক্ত? স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে মোবাইল সিমের জন্য বায়োমেট্রিক নিবন্ধন– প্রত্যেকটি পদক্ষেপেরই একটি ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট রয়েছে, যা ডিজিটালি দেখা যেতে পারে।
এ বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম বর্তমানে হেইডেলবার্গে থাকা আইটি বিশেষজ্ঞ নাঈম রেজার সাথে। তিনি বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, "জার্মানিতে এটি 'সার্টিফিকেট অব কনডাক্ট' নামে পরিচিত, যা 'পুলিশ চেক', 'ব্যাকগ্রাউন্ড চেক' বা 'ক্রিমিনাল রেকর্ড চেক' নামে অভিহিত হয়। এটি একটি অফিসিয়াল কাগজ, যা একটি বিশেষ সবুজ কাগজে ছাপানো হয় এবং এটি দেখায়, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে পূর্বে কোন অপরাধমূলক মামলা রয়েছে কিনা।"
নাইম বলেন, "এই সার্টিফিকেটটি যদি আপনি একটি নতুন চাকরি শুরু করতে চান, অথবা কোনো পাবলিক অথরিটির অনুমতি প্রয়োজন হয়, যেমন ট্যাক্সি লাইসেন্সের জন্য আবেদন, অথবা দুর্বল মানুষের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী কাজ করার জন্য, তখন এটি প্রয়োজন হয়।"
"আমরা এটির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে পারি একটি জার্মান পরিচয়পত্র দিয়ে, যা অনলাইনে ব্যবহারের জন্য সক্রিয় করা থাকে এবং স্মার্টফোনে এনএফসি প্রযুক্তি সহ একটি অ্যাপ যেমন জার্মান সরকারের ফ্রি পরিচয়পত্র অ্যাপ ২ [AusweisApp2] ব্যবহার করে। যাচাইয়ের পর, আমরা এটি স্থানীয় নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ থেকে অথবা সরাসরি ফেডারেল অফিস অব জাস্টিস ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করতে পারি। পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে করা যায়," রেজা বলেন।
তিনি আরও বলেন, "যদি আপনি এই সিস্টেমটি বাতিল করতে চান তাহলে এটি রাজনৈতিক সম্পর্কিত যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত, কারণ ছাত্ররা শিক্ষাজীবনে রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত হতে পারে, যা অবশ্যই তাদের বর্তমান মতাদর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কিন্তু পুলিশের যাচাই আজও প্রয়োজন। যদি তারা বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে অথবা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধে জড়িত থাকে, তাহলে তা অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত।"
সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, "ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষী থেকে শুরু করে অফিস সহায়ক পর্যন্ত সবারই কাজ গুরুত্বপূর্ণ। কখনও কখনও কেউ নাম বা পরিচয় বদলে চাকরি পেতে পারে। পরে সে অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি।"
তিনি মনে করেন, "আপনার হয়ত রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু আপনাকে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে হবে না।" এবং তিনি বিশ্বাস করেন, কাউকে না কাউকে এই তথ্য যাচাই করতে হবে।
নুরুল হুদা বলেন, "হয়ত আরও উন্নত প্রযুক্তির যাচাই ব্যবস্থার জন্য একদিন এই ব্যবস্থা আর প্রয়োজন হবে না। তবে এখন প্রার্থী যে তথ্য দেয়, তা যাচাই করার জন্য কাউকে না কাউকে প্রয়োজন। এবং এটি স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ওয়ার্ড কমিশনারকে দেওয়া হয়, কারণ তার মাধ্যমে সঠিকভাবে তদন্ত করা সম্ভব।"