গুলিস্তানের টাকার বাজারে একদিন
সাত্তার আলী হাতিরপুল বাজারে মাছ বিক্রি করেন। প্রতিদিন হাজার হাজার টাকার লেনদেন হয় তার হাতে দিয়ে। সাত্তার আলী সাথে দেখা হলো গুলিস্তানের টাকার বাজারে। এখানে এসেছেন ছেঁড়া-ফাটা টাকা পরিবর্তন করে নতুন টাকা নেওয়ার জন্য।
"সবাই ভাবে ছেঁড়া টাকাটা নিয়ে মাছ বাজারে চালায়ে দেই। কিন্তু সেই টাকা তো কেউ নেয় না আমার থেকে। আমি কীভাবে চলবো? সেজন্যই সপ্তাহে একদিন গুলিস্তানে এসে টাকা বদলায়ে নতুন টাকা নিয়ে যাই," বললেন তিনি।
গুলিস্তানের এই টাকার হাটে পাওয়া যায় ২ টাকা থেকে ১০০০ টাকার নতুন নোট। যে কেউ চাইলেই এখানে এসে ছেঁড়া বা পুরাতন নোট বদলিয়ে নতুন নোট কিনে নিয়ে যেতে পারেন। অনেকে আবার বড় টাকার নোটের বিনিময়ে ভাংতি টাকার নতুন বান্ডিলও কিনে নেন। এছাড়াও এখানে পাওয়া যায় অনেক দেশের নতুন ও পুরাতন টাকা-মুদ্রা। শখের সংগ্রাহকরা নিয়মিত এখান থেকে মুদ্রা ও টাকা সংগ্রহ করেন। আবার এখানে প্রাইজ বন্ডও কিনতে পাওয়া যায়।
গুলিস্তানের পাতাল মার্কেটের মুখে সারি ধরে বসেন এই টাকার কারবারিরা। টাকার বাজারের বয়স ৫০ বছরেরও বেশি। স্বাধীনতার আগে তারা বসতেন পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে। স্বাধীনতার পর থেকে তারা গুলিস্তান আর সদরঘাটে বসেন নতুন টাকার পসরা সাজিয়ে। এখানে একেকজন বিক্রেতা ৩০-৪০ বছর ধরে টাকা কেনাবেচার কাজ করছেন। আবার অনেকেই নতুন করে শুরু করছেন এই কাজ। এই টাকার বাজারের বৃত্তান্ত জানতেই একদিন চলে গেলাম গুলিস্তান; কোনো ছেঁড়া-ফাটা নোট না নিয়েই!
যেভাবে চলে টাকার বাজার
প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেই থাকে ছেঁড়া-ফাটা বা অচল টাকার নোট বদলিয়ে নতুন নোট নেওয়ার ব্যবস্থা। এতে কোনো বাড়তি টাকা খরচ হয় না। তবুও কেন মানুষ ব্যাংকে না গিয়ে গুলিস্তানের টাকার বাজারে আসেন?
এ প্রশ্ন করলে টাকার কারবারি শহীদ মিয়া বলেন, "সময়! মানুষ সময় বাঁচাতে এখানে আসেন। ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে না থেকে লোকজন এখানে এসে মুহূর্তেই ছেঁড়া টাকা বদলিয়ে নতুন টাকা নিয়ে যেতে পারেন। ব্যাংকে অনেক সময় বেশি ছেঁড়া টাকা নিতেও চায় না। কিন্তু আমরা মোটামুটি সবই নেই।"
৩০-৩৫ জন বিক্রেতা টেবিল নিয়ে বসেন গুলিস্তানের পাতাল মার্কেটের বাইরে। সবার সামনে থরে থরে সাজানো নতুন টাকার নোট। কেউ আবার নতুন টাকা ভাঁজ করে ফুলের তোড়ার মতো সাজিয়ে রেখেছেন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য। ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ এবং ১০০০— সব মানের টাকারই নতুন বান্ডিল। কোথা থেকে আসে এত এত নতুন টাকা প্রতিদিন? জিজ্ঞেস করে জানা গেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আছে তাদের এজেন্ট। যারা প্রতিদিন সকালে নতুন টাকার বান্ডিল সরবরাহ করেন গুলিস্তানের টাকা বিক্রেতাদের কাছে। আবার সেই এজেন্টরাই পুরাতন আর ছেঁড়া-ফাটা নোটগুলো কিনে নেন।
এখানে ছেঁড়া বা অচল টাকা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে কিনে নেন বিক্রেতারা। বিনিময়ে দেন নতুন নোট। ধরা যাক, কেউ ৫০০ টাকার একটি ছেঁড়া নোট নিয়ে এসেছেন বদলানোর জন্য। এখন সে নোটটি কী পরিমাণে ছেঁড়া আছে তা বিচার করেন টাকার বাজারের লোকেরা। এরপরে ৫০০ টাকার বিনিময়ে ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা ফেরত দেন ক্রেতাকে। এই লাভ দিয়েই চলে টাকার বাজার। আর নতুন নোটের বান্ডেল বিক্রি করেন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে। ২০ টাকার ১০০টি নতুন নোটের বান্ডেলে ২০০০ টাকা থাকে। এই বান্ডেল নিতে ক্রেতাকে দিতে হবে ২১০০ টাকা। ৫০ টাকা, ১০০ টাকা ও ৫০০ টাকার নতুন নোটের বান্ডেলও এখানে পাওয়া যায় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৮০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি খরচ করলে।
এই টাকার বাজারে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা অদল-বদল হয়। তবে বিভিন্ন মৌসুমে তা বেড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকাও হয়ে থাকে। দুই ঈদে, আর নববর্ষের হালখাতার সময় ব্যবসা হয় সবচেয়ে রমরমা। তখন নতুন নোটের বান্ডেলের দামও বেড়ে যায়। ৫ টাকার ১০০০ টাকার বান্ডেলের দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত লাভে বিক্রি হয় রোজার ঈদে।
"সবাই চায় বাচ্চাকাচ্চাকে নতুন টাকা দিয়ে সালামি দিতে। তাই চাহিদা বেশি থাকায় দামও বেশি পড়ে তখন," বলেন শহীদ মিয়া।
শখের সংগ্রাহকদের স্বর্গ
টাকার বাজারে সবার কাছেই নতুন টাকার বান্ডিল থরে থরে সাজানো। আর অচল নোটগুলো সুতায় ঝুলিয়ে সামনে দিয়ে লাগিয়ে রাখা। ক্রেতাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য নতুন টাকার ফুলের তোড়া রাখা। তবে আরেকটি জিনিসও প্রায় প্রতিটি টেবিলেই রাখা, যা যেকোনো মানুষের নজর কাড়তে বাধ্য। তা হলো নানান দেশের টাকা ও মুদ্রা।
শহীদ মিয়ার মতে তাদের এখানে বিশ্বের প্রায় সব দেশের মুদ্রা ও টাকা পাওয়া যায়। অনেক শখের সংগ্রাহকরা এখান থেকে নিয়মিত এগুলো সংগ্রহ করেন।
পাতাল মার্কেটের মুখের এ মাথা থেকে ও মাথা একবার হেঁটেই গুণে গুণে ৭৫টি দেশের মুদ্রা পাওয়া গেল। আর কাগুজে নোট ২৬ দেশের। সব মহাদেশের দেশের মুদ্রাই এখানে আছে। উল্লেখযোগ্য কিছু হলো— ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, মিশর, লিবিয়া, কাতার, দক্ষিণ আফ্রিকা, সেনেগাল, জিম্বাবুয়ে, ইংল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, চীন, জাপান, আমেরিকা, কানাডা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, উরুগুয়ে ইত্যাদি।
এই মুদ্রা আর নোটগুলো তারা পান বিভিন্ন সংগ্রাহকের কাছ থেকে। অনেকেই তাদের সংগ্রহে অতিরিক্ত জিনিস থাকলে এসে বিক্রি করে দিয়ে যান। বিদেশি নোট বা মুদ্রা নানান দামে বিক্রি হয়। এর কোনো নির্দিষ্ট দাম নেই। যে যার মর্জিমতো দামাদামি করে কেনাবেচা করেন। কানাডা, সিঙ্গাপুর আর অস্ট্রেলিয়ার তিনটি মুদ্রা আলাদা করে দাম জিজ্ঞেস করায় চাইলেন ৬০ টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মায়িশা মালিহা ছোটবেলা থেকেই বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। তিনি বললেন, "আমি কয়েক বছর আগে গুলিস্তানের এই টাকার বাজার সম্পর্কে জানতে পারি। এখানে এসে আমি এতো দেশের মুদ্রা আর নোট দেখে অবাক হয়ে যাই! এখানকার ব্যবসায়ীরা নিজেরাই একটা জাদুঘর খুলে বসতে পারবেন। আমি এখন নিয়মিত এখান থেকে নানান দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করে নিজের কালেকশনে রাখি। মোটামুটি কম দামেই পাওয়া যায় অনেক দুর্লভ কয়েন আর নোট।"
এছাড়াও এখানে পাওয়া যায় অনেক পুরান আমলের মুদ্রা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগের টাকা ও পয়সার প্রায় সবগুলোই এখানে আছে। একজন বিক্রেতা জানান খুঁজে দেখলে ব্রিটিশ আমলের কয়েনও পাওয়া যাবে এখানে। পাকিস্তান আমলের নোট প্রায় সব দোকানেই আছে।
এছাড়া, নানান সময়ে বের হওয়া বাংলাদেশের প্রায় সকল স্মারক নোট ও কয়েন কিনতে পাওয়া যায় এখানে। সবমিলিয়ে গুলিস্তানের এই টাকার বাজার শখের সংগ্রাহকদের জন্য স্বর্গ হয়ে উঠেছে।
নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
শহীদ মিয়া ২৫ বছর ধরে টাকার কারবার করেন। তার দুই সন্তানের কাউকে এই পেশায় আসতে দেবেন কি-না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "নাহ, এই ব্যবসার কোনো ভবিষ্যৎ নাই। আমার বাবাকে দেখে আমি এই কাজ শিখছি। কিন্তু আমার ছেলেদেরকে আমি এই কাজে আসতে দেব না। যত দিন যাচ্ছে, লাভ কমছেই। মানুষজন ব্যাংকের মতো সার্ভিস চায় এখানে এসে। ব্যাংকের মতো সার্ভিস দিলে আমাদের পেট চলবে কেমনে?"
সবারই নতুন টাকার চাহিদা আছে। অনেক ব্যবসায়ী পুরান টাকা নিয়ে বিপাকে পড়ে এখানে টাকা বদলাতে আসেন। দেশের অর্থনৈতিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কখনোই স্বীকৃতি পাননি তারা। আগের সরকারের আমলে বসার জন্য নিয়মিত চাঁদা দিতে হতো সবার। এখন সে অবস্থা না থাকলেও কতদিন চাঁদা ছাড়া বসতে পারবেন, তা নিয়ে নিশ্চিত নন গুলিস্তানের টাকার ব্যবসায়ীরা।
প্রতিদিন এত টাকা নিয়ে খোলা অবস্থায় বসে থাকেন তারা। নেই কোনো বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। গুলিস্তানের মতো একটি জনবহুল এলাকা, যেখানে হরদম পকেটমার বা ছিনতাই হয়ে থাকে। টাকার বাজারে কখনো চুরি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা কী হয়নি? যে কারো মনে এ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক।
এ ব্যাপারে শহীদ মিয়া জানান, বিক্রেতাদের অসাবধানতার কারণে হয়তো কেউ টাকা নিয়ে সরেছে দুই-একবার। কিন্তু বড় আকারের চুরি বা ছিনতাই কখনো হয়নি। এখানকার স্থানীয়রা সবাই আমাদের বিশ্বস্ত।