এআই রোবটরা কি মহাকাশে নভোচারীদের বিকল্প হতে যাচ্ছে?
বড়দিনের আগের রাতে নাসার একটি স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান সূর্যের সবচেয়ে কাছ দিয়ে উড়ে যায়। পার্কার সোলার প্রোব নামের এই যানটি সূর্যের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে এবং এটি পৃথিবীর আবহাওয়ায় কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা বুঝতে কাজ করেছে। এর আগে কোনো মানবসৃষ্ট বস্তু সূর্যের এত কাছে যেতে পারেনি।
এই ঘটনা মানবজাতির জন্য বড় সাফল্য হয়ে থাকবে। তবে এতে সরাসরি কোনো মানুষ যুক্ত ছিল না। মহাকাশযানটি সূর্যের কাছে থাকাকালীন পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রক্ষা করা ছাড়াই নিজের পূর্বনির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করেছে।
গত ৬০ বছর ধরে রোবোটিক যানগুলো এমন সব জায়গায় গেছে, যেখানে মানুষের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। এই অভিযানে পার্কার সোলার প্রোব ১ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করেছে।
তবে এই স্বয়ংক্রিয় যান এবং উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাফল্য ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানে মানুষের ভূমিকা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
মহাকাশে মানব নভোচারী পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী।
যুক্তরাজ্যের মহাকাশবিদ লর্ড মার্টিন রিস বলেন, "রোবট দ্রুত উন্নতি করছে, আর মানুষ পাঠানোর যুক্তি দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। আমি মনে করি, কোনো করদাতার টাকা দিয়ে মানুষকে মহাকাশে পাঠানো উচিত নয়।"
তিনি মানুষের জন্য সম্ভাব্য বিপদের কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "মানুষ পাঠানোর একমাত্র কারণ হলো, এটি একটি অভিযান, ধনীদের জন্য একটি অভিজ্ঞতা। আর সেটা বেসরকারি খাতের তহবিল থেকে করা উচিত।"
লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু কোয়েটসও এ বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, "জটিল মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য আমি রোবটকেই বেশি পছন্দ করি। এগুলো অনেক দূর যেতে পারে এবং আরও অনেক কিছু করতে পারে।"
কোয়েটস বলেন, "এরা (রোবট) মানুষের তুলনায় সস্তা। আর এআই-এর উন্নতির সাথে রোবট আরও বুদ্ধিমান হতে থাকবে।"
মহাকাশের রোবট বনাম মানবজাতি
রোবটিক মহাকাশযানগুলো সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ, অনেকগুলো গ্রহাণু এবং ধূমকেতু পরিদর্শন করেছে। তবে মানবজাতি এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি স্থানে যেতে সক্ষম হয়েছে– পৃথিবীর কক্ষপথ এবং চাঁদ।
এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ মানুষ মহাকাশে গেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরি গাগারিন ১৯৬১ সালে প্রথমবারের মতো মহাকাশে গিয়েছিলেন। তিনি মানবজাতির প্রথম মহাকাশ অভিযাত্রী।
অধিকাংশ মানুষ মার্কিন কোম্পানি ব্লু অরিজিনের নিউ শেপার্ড রকেটের মতো বিভিন্ন মহাকাশযানে চড়ে স্বল্পসময়ের জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে বা মহাকাশে উড়াল দিয়েছেন।
রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী এবং 'এ সিটি অন মার্স' বইয়ের সহ-লেখক ড. কেলি উইনারস্মিথ বলেন, "গৌরবের জন্য মানুষকে মহাকাশে পাঠানো হয়। মনে হয় সবাই মেনে নিয়েছে, এটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং জনগণের প্রতিভা দেখানোর একটি চমৎকার উপায়।"
কিন্তু একেবারে অনুসন্ধান করার ইচ্ছা বা গৌরবের অনুভূতির বাইরেও মানুষ মহাকাশে বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মাধ্যমেই বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে মানুষের সরাসরি ভূমিকা রয়েছে।
রোবটরা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সাহায্য করতে পারে, কারণ তারা এমন জায়গায় যেতে পারে যা মানুষের জন্য অচেনা এবং বিপজ্জনক। বিভিন্ন রোবোটিক যন্ত্র ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডল এবং পৃষ্ঠ পরীক্ষা করা হয়।
ড. উইনারস্মিথ বলেন, "মানুষ অনেক বেশি বহুমুখী এবং আমরা রোবটের চেয়ে দ্রুত কাজ করি। কিন্তু মহাকাশে আমাদের বাঁচিয়ে রাখা কঠিন এবং ব্যয়বহুল।"
২০২৪ সালের বুকার পুরস্কার জয়ী উপন্যাস "অর্বিটাল"-এর লেখিকা সামান্থা হার্ভি বলেন, "একটি রোবটের পানির প্রয়োজন নেই, পুষ্টির প্রয়োজন নেই, বর্জ্য নিঃসরণ বা ঘুমের প্রয়োজন নেই… এটি কিছু চায় না এবং কোনো চাহিদা নেই।"
তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। অনেক রোবট ধীরগতির এবং সাবধানি। উদাহরণস্বরূপ, মঙ্গলগ্রহে রোভার (রিমোট-কন্ট্রোলড রোবোটিক যান) প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ০.১ মাইল গতিতে চলে।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহবিজ্ঞানী ড. ইয়ান ক্রফোর্ড প্রশ্ন করেন, "এআই দৌড় প্রতিযোগিতায় হয়ত মানুষের চেয়ে ভালো করতে পারবে, কিন্তু এর মানে কি তারা মানুষের চেয়ে পরিবেশ অনুসন্ধানে ভালো?"
তিনি বলেন, "আমার মনে হয়, আমরা এখনও এটা জানি না।"
তবে তিনি বিশ্বাস করেন, এআই অ্যালগরিদম রোভারের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
এআই সহায়ক এবং মানবসদৃশ রোবট
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহায়ক হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণে ভূমিকা রাখতে পারে। এটি মহাকাশচারীদের কিছু কাজ থেকে নির্ভার রাখতে সাহায্য করবে, যাতে তারা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারেন।
কম্পিউটার ও গ্রহবিজ্ঞানী ড. কিরি ওয়াগস্টাফ বলেন, "এআই-এর মাধ্যমে ক্লান্তিকর কাজগুলো অটোমেটেড করা যেতে পারে।" তিনি আরও বলেন, "যেকোনো গ্রহের পৃষ্ঠে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং মনোযোগ হারাতে পারে। তবে, যন্ত্রের ক্ষেত্রে এমনটি হয় না।"
বৃহৎ ভাষার মডেল (এলএলএম) চালানোর জন্য প্রচুর শক্তি প্রয়োজন। ড. ওয়াগস্টাফ বলেন, "আমরা এখনও মঙ্গলগ্রহের রোভারে এলএলএম চালানোর অবস্থানে নেই। রোভারের প্রসেসরের গতি আপনার স্মার্টফোনের এক দশমাংশের সমান।" এর ফলে এলএলএম চালানোর জটিলতা তারা সামাল দিতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।
আরেকটি প্রযুক্তি হলো– রোবটিক হাত ও পা যুক্ত মানবসদৃশ রোবট। এ ধরনের রোবট মহাকাশে মৌলিক কাজগুলো করতে সাহায্য করতে পারে, বিশেষত যখন তারা মানুষের শারীরিক ক্ষমতাকে যথাযথভাবে অনুকরণ করবে।
জনসন স্পেস সেন্টারের তৈরি নাসার ভালকাইরি রোবট ২০১৩ সালের রোবোটিকস চ্যালেঞ্জে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এর ওজন ৩০০ পাউন্ড এবং উচ্চতা ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। দেখতে স্টার ওয়ার্সের স্টর্মট্রুপারের মতো হলেও, এটি একটি শক্তিশালী মানবসদৃশ রোবট।
ভালকাইরি তৈরির আগে, নাসার রোবোনট ছিল প্রথম মানবসদৃশ রোবট, যা মহাকাশে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এটি এমন কাজ করত, যা সাধারণত মানুষ করতে পারে।
রোবোনটের বিশেষভাবে ডিজাইন করা হাত ছিল, যা মহাকাশচারীদের সরঞ্জাম ব্যবহারের মতো কাজ করতে পারত। এটি জটিল কাজ যেমন কোনো বস্তু ধরতে বা সুইচ চালাতে সক্ষম ছিল, যা অন্যান্য রোবটের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
রোবোনটের একটি পরবর্তী মডেল ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে পাঠানো হয়, যেখানে এটি রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংযোগকরণে সহায়তা করেছিল।
নাসার জনসন স্পেস সেন্টারের ডেক্সটারাস রোবটিকস দলের প্রধান ড. শান আজিমি বলেন, "যদি কোনো উপাদান পরিবর্তন করতে হয় বা সৌর প্যানেল পরিষ্কার করতে হয়, তাহলে আমরা রোবটের মাধ্যমে তা করতে পারি। আমরা রোবটকে এমনভাবে দেখি, যেন মানুষ না থাকলে তারা এই আবাসস্থলগুলো নিরাপদ রাখতে সাহায্য করতে পারে।"
তিনি বলছেন, রোবটরা মানুষের জায়গা নেবে না, বরং তাদের সাথে কাজ করবে।
কিছু রোবট ইতোমধ্যে অন্য গ্রহে মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই কাজ করছে। কখনো কখনো তারা নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, নাসার কিউরিওসিটি রোভার মঙ্গলের গেইল ক্রেটারে অনুসন্ধান করছে এবং কিছু বৈজ্ঞানিক কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করছে।
ড. ওয়াগস্টাফ বলেন, "আপনি রোভারের কাছে একটি দৃশ্যের ছবি তোলার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। বৈজ্ঞানিক অগ্রাধিকারের জন্য উপযুক্ত পাথর খুঁজে বের করতে বলুন, তারপর সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার লেজার সেই লক্ষ্যবস্তুতে ফায়ার করতে পারে।"
তিনি বলেন, "এটি একটি নির্দিষ্ট পাথরের পাঠ নিতে পারে এবং মানুষ ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তা পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিতে পারে।"
তবে কিউরিওসিটির মতো রোভারের ক্ষমতাগুলো ধীর গতির কারণে সীমিত। এছাড়া, মানুষের অনুপ্রেরণা সৃষ্টির ক্ষমতা রোবটের নেই।
প্রফেসর কোয়েটস বলেন, "অনুপ্রেরণা এমন একটি বিষয় যা নির্দিষ্ট নয়।"
অবসরপ্রাপ্ত নাসা মহাকাশচারী লিরয় চিয়াও ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে নাসার স্পেস শাটল ও আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে তিনটি মহাকাশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন,"মানুষ যখন কিছু করে, তখন তা মানুষ বুঝতে পারে। সাধারণ মানুষ রোবোটিক মিশনের জন্য উত্তেজিত হয়। তবে আমি আশা করি, মঙ্গলে মানুষের প্রথম পৌঁছানোর বিষয়টা চাঁদে মানুষের প্রথম পা রাখার থেকেও বড় হবে।"
মঙ্গলগ্রহে জীবন?
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে শেষ অ্যাপোলো মিশন চাঁদে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মানুষ পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে যায়নি। নাসা এই দশকে আর্টেমিস প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানুষকে ফের চাঁদে পাঠানোর আশা করছে।
পরবর্তী ক্রু মিশন ২০২৬ সালে চারজন মহাকাশচারীকে নিয়ে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে। আরেকটি মিশন ২০২৭ সালে নির্ধারিত এবং এটির মাধ্যমে নাসার মহাকাশচারীরা চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ করবেন।
চীনা মহাকাশ সংস্থাও চাঁদে মহাকাশচারী পাঠানোর পরিকল্পনা করছে।
অন্যদিকে, স্পেসএক্স-এর সিইও ইলন মাস্কের মহাকাশ নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা আছে। তিনি বলেছেন, মঙ্গলগ্রহে একটি উপনিবেশ তৈরি করা তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এটি বাস্তবায়িত হলে, মানুষ মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করতে পারবে।
তার পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্টারশিপ নামক একটি বৃহৎ যান ব্যবহার করে প্রতি বার ১০০ জন মানুষকে মঙ্গলগ্রহে পাঠানো হবে। স্পেসএক্স ২০ বছরের মধ্যে মঙ্গলগ্রহে ১০ লাখ মানুষ পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
মাস্ক বলেন, "আমাদের মঙ্গলে যেতে হবে, কারণ এটি পৃথিবীতে কোনো বিপর্যয় ঘটলে মানবজাতির জন্য একটি ব্যাকআপ [বিকল্প] হতে পারে।"
তবে, মঙ্গলে জীবনযাত্রা নিয়ে অনেক অজানা প্রশ্ন রয়েছে, বিশেষত যে সমস্ত প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ এখনো সমাধান হয়নি সেগুলো নিয়ে।
মাস্ক বলেন, "হয়ত মঙ্গলগ্রহের পরিবেশে শিশুরা বেড়ে উঠতে পারবে না। এমন কিছু নৈতিক প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর আমাদের কাছে নেই।"
তিনি আরও বলেন, "আমার মনে হয় আমাদের যেন একটু ধীরস্থির হয়ে ভাবা উচিত।"
তবে লর্ড রিসের নিজস্ব এক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যেখানে মানব ও রোবোটিক অনুসন্ধান একত্রিত হতে পারে। এমনকি কঠোর পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষ নিজে যন্ত্রে পরিণত হতে পারে।
তিনি বলেন, "আমি কল্পনা করতে পারি, তারা জিনগত পরিবর্তন, সাইবর্গ অ্যাড-অন্স ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, যাতে অত্যন্ত বিরূপ পরিবেশে বাঁচতে পারে।"
রিস আরও বলেন, "আমরা এমন একটি নতুন প্রজাতি হতে পারি, যারা মঙ্গলে সুখীভাবে বসবাস করতে পারবে।"
তবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষ সম্ভবত তাদের মহাকাশ অভিযানে ছোট পদক্ষেপই নেবে, যেখানে রোবট অনুসন্ধানকারীরা আগে থেকেই এসব পথ পাড়ি দিয়েছে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়