সূচিকর্ম ভালোবাসতেন বলে বিদ্রুপ পিছু ছাড়ত না, এখন তার হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে নকশিকাঁথা
আজ থেকে প্রায় চার-পাঁচ দশক আগে পল্লীগ্রামে সেলাই কাজ ছেলেদের জন্য স্বাভাবিক ছিল না। এটি 'মেয়েদের কাজ' হিসেবেই বিবেচিত হতো। এমন কাজ করা ছেলেদের প্রতি সমাজের কটাক্ষ ছিল অবধারিত। আমিনুল ইসলামের কপালেও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
আমিনুল সূচিকর্ম করতেন। তাই সমাজের বিদ্রূপ আর তির্যক মন্তব্য হয়ে পড়ে তার নিত্যসঙ্গী। এমনকি কাছের মানুষজনের কাছ থেকেও রেহাই পাননি। পরিস্থিতি এতটাই তীব্র হয়েছিল যে, একসময় আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত ভর করেছিল তার মনে।
একপর্যায়ে তিনি পণ করেন, এ কাজ আর করবেন না। কিন্তু ভেতরের শিল্পী মনকে দমিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই বাধাকে খুব একটা তোয়াক্কা করেননি।
ঝিনাইদহের শৈলকূপায় এক সাধারণ গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা আমিনুলের। পুরো নাম মো. আমিনুল ইসলাম। পেশায় তিনি একজন সূচিশিল্পী। সাতান্ন বছর বয়সি আমিনুল ছিলেন পরিবারে সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। ফলে মায়ের খুব কাছের এবং আদরের যে ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তার সূচিশিল্পী হয়ে ওঠাও মাকে কেন্দ্র করেই।
মো. আমিনুল ইসলাম তখন নয় বা দশ বছরের বালক। প্রায়ই মাকে অবসরে কাঁথা, টেবিল ক্লথ, রুমাল, বিছানার চাদর ইত্যাদি সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত দেখতেন। অবসরে বাঙালি নারীদের সুঁই-সুতার কাজ এক চিরাচরিত অভ্যাস। আমিনুলের মাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
মায়ের হাতের হরেক রকম নকশায় রঙিন সুতোর বুনন আমিনুলকে আকৃষ্ট করত। ধীরে ধীরে এ কাজে তার ভালো লাগা তৈরি হয়। গ্রামের অন্য শিশুরা যখন খেলাধুলায় মগ্ন থাকত, তখন ছোট্ট আমিনুলের মন পড়ে থাকত মায়ের সুঁই-সুতোর কাজে।
মায়ের পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে সেসব কাজ দেখতেন, শিখতেন। মাঝেমধ্যে নিজেও চেষ্টা করতেন মাকে সাহায্য করার। ছোট ছোট হাতে রুমাল বা টেবিল ক্লথে মায়ের মতো করেই সেলাই করতেন। এভাবে কাঁথা বা কাপড়ে নকশা করে ফোঁড় দেওয়ার কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। মায়ের হাত ধরেই সূচিশিল্পে তার যাত্রা শুরু হয়। উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার প্রধান উৎসও ছিলেন মা।
তবে বিষয়টি গ্রামের লোকজন ভালোভাবে নেয়নি। ছোট বয়সেই আমিনুল নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন।
বলা যায়, আমিনুলের জীবনের গল্পটাও এক কাঁথার টুকরোর মতো—সেখানে সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম আর ঐতিহ্যের রঙ মিশে আছে। শেষ পর্যন্ত পেশা হিসেবে সূচিশিল্পকে বেছে নিয়েছেন তিনি।
১৯৯০ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান আমিনুল। মনের ভেতরে তখনও সূচিশিল্পের নকশা গেঁথে আছে। ফলে রাজধানীতে এসেই তিনি ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন।
তার লক্ষ্য ছিল দুটি—প্রথমত, হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা; দ্বিতীয়ত, নিজের ভালো লাগার কাজটি চালিয়ে যাওয়া। ১০-১৫ জন নারী কর্মীকে নিয়ে শুরু হয় তার এ উদ্যোগের পথচলা। একসময় গড়ে তোলেন কারখানাও। কর্মীদের কেউ গ্রামে কাজ করতেন, আবার কেউ ঢাকার দক্ষিণখানের ফায়দাবাদে অবস্থিত তার কারখানায়।
বর্তমানে এ কারখানায় ৩০ জন নারী-পুরুষ কাজ করছেন। আমিনুল তাদের হাতে নিজের নকশা করে কাঁথা দিয়ে দেন, আর তারা শুধু ফোঁড় দেওয়ার কাজটি করেন। ধীরে ধীরে কাজের পরিসরও বাড়তে থাকে। কারখানা ও তার বাইরে সব মিলিয়ে এখন কর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-৬০ জনে।
আমিনুল ইসলামের নকশিকাঁথার বিশেষত্ব হলো তার কাজের স্বতন্ত্রতা। গ্রামের জীবনযাপন, ফুল, পাখি, গাছপালা, নদী, পিঠার নকশা—সব মিলিয়ে তার কাঁথায় ফুটে ওঠে বাংলাদেশি সংস্কৃতির আদি রূপ।
তিনি বলেন, 'আমি পুরোনো দিনের মোটিফ নিয়েই কাজ করি। নকশিকাঁথার যে ঐতিহ্যবাহী রূপ, সেটিই সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছি। দেখা যাক কতদূর যেতে পারি।'
তিনি তৈরি করছেন রাজশাহীর বিখ্যাত দুই ধরনের নকশিকাঁথা—লহরী নকশিকাঁথা এবং সুজনী নকশিকাঁথা। হাতি-ঘোড়া, ফুল, লতাপাতা, গাছপালা, পাখির নকশা দিয়ে তৈরি হয় সুজনী কাঁথা। অন্যদিকে লহরী কাঁথার নামকরণ করা হয়েছে সেলাইয়ের ঢং-এর ওপর নির্ভর করে।
পারস্য শব্দ 'লহর' থেকে লহরী কাঁথা নামের উদ্ভব। লহর মানে হলো ঢেউ। এ কাঁথার সেলাইগুলো সরল সোজা ভাবে আগালেও, সেলাই শেষ হলে পুরো কাঁথার নকশায় ঢেউয়ের মতো দেখায়। এর মধ্যে লহরী নকশিকাঁথা তৈরি অনেক বেশি কষ্টসাধ্য বলে জানান আমিনুল। তাছাড়া এটি বানাতে যে ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন, তা খুব কম কারিগরের আছে। আগের কারিগরের সংখ্যাও এখন অনেক কম।
এক একটি কাঁথা সেলাই করার জন্য লাগে আট মাস থেকে দেড় বছর। বিশেষ করে বড় নকশিকাঁথাতে সময় বেশি দিতে হয়। কখনো কখনো এক বছরেরও বেশি। প্রতিটি কাঁথার প্যাটার্ন, রঙের পরিকল্পনা, সেলাইয়ের নির্দেশনা—সবকিছু আমিনুলই দেখভাল করেন।
কাঁথাগুলো সেলাই করেন কর্মীরা, তবে কাজের নির্দেশনা থাকে একেবারে আমিনুলের। তিনি বলেন, 'কাঁথার স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে সবকিছু নিজে দেখি। কর্মীদের হাতে কাজ তুলে দিই, তবে কীভাবে কাজ হবে, তা আমিই ঠিক করে দিই।'
এ কাঁথা বিক্রির মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। ফেসবুকে তার 'বাংলার সেলাই' নামক একটি ব্যবসায়িক পেইজ আছে, যেখান থেকে কেনাকাটা করেন অনেকেই। আবার বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমেও কেউ কেউ কিনতে আসেন।
তার আয়ের আরেকটি বড় উৎস হলো আড়ংয়ের সঙ্গে চুক্তি। প্রায় ৩০-৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার তৈরিকৃত পণ্য ক্রয় করছে আড়ং।
এ পর্যন্ত তিনি ২৫০-৩০০টি নকশিকাঁথা তৈরি করেছেন। বড় নকশিকাঁথার দাম ২৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সেসবের আকার হয় ৮০-৯০ ইঞ্চি। অন্যদিকে ছোট নকশিকাঁথার দাম হয় আট হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে। তবে ৩০০টির মধ্যে মাত্র ৫০টির মতো কাঁথা বিক্রি হয়েছে তার।
তাহলে এতজন কর্মীর মজুরি দিচ্ছেন কীভাবে? উত্তরে আমিনুল বলেন, 'আড়ংয়ে অনেক জিনিস আমি সাপ্লাই দিই। বেড কাভার, কুশন কাভার, পুরোনো দিনের মোটিফের কাজ, হাতের কাজের জামা ইত্যাদি তারা আমার কাছ থেকে কেনে। সেখান থেকে আমি বেশ ভালো পরিমাণে টাকা পাই। ওখান থেকে কর্মীদের পারিশ্রমিক দিই।'
তার ব্যবসায়িক লাভ তেমন একটা নেই। তবে তা-তে তার খারাপ লাগাও নেই। তার মূল লক্ষ্য ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা। তিনি বলেন, 'আমার মূল উদ্দেশ্য, আমি চাই পরবর্তী প্রজন্ম এ ঐতিহ্যকে জানুক, এটি রক্ষা করুক। আমাদের সংস্কৃতি যেন হারিয়ে না যায়।'
তবে আমিনুল ব্যবসায়িকভাবে সূচিশিল্পের কাজ শুরু করেন ৩৫ বছর আগে। আগে তিনি হ্যান্ড ক্রাফটের কাজ করতেন। কাঁথার কাজ করতেন না তখন। ১৫ বছর হলো নকশিকাঁথার কাজে। তবে ভাবেননি এ কাজ করে তিনি একদিন পুরস্কারও জয় করবেন।
'নকশিকাঁথা নিয়ে যে পুরস্কার আছে, সেটাই তো আমি জানতাম না। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে আমাকে বলা হলো কম্পিটিশনে নকশিকাঁথা পাঠাবো কি-না। তাদের কথায় পাঠাই। পরে পুরস্কারও পেয়ে যাই,' বলেন আমিনুল।
ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফটস কাউন্সিলের মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা 'অ্যাওয়ার্ড অব এক্সেলেন্স ফর হ্যান্ডিক্রাফটস ২০২৪'-এ আমিনুলের নকশিকাঁথা 'ময়ূরপঙ্খী' পুরস্কৃত হয়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সেরা কারুশিল্পীদের বৈচিত্র্যময় সব সামগ্রীর মধ্যে থেকে বাংলাদেশের তিনটি পণ্য পুরস্কৃত হয়েছে—নকশিকাঁথা, জামদানী ও কাঠের গহনার বাকশো।
তবে এত অল্পতে সন্তুষ্ট নন আমিনুল। 'বাংলার সেলাই'কে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। সঙ্গে নকশিকাঁথাকে পৌঁছে দিতে চান দেশের বাইরেও।
তিনি বলেন, 'এসব করে আমার খুব বিক্রি বা লাভ হচ্ছে তেমনটিও নয়। আমি আসলে আমার আগ্রহের জায়গা থেকে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখছি বলতে পারেন। কারণ একটা সময় দেখা যাবে এ মানুষগুলো থাকছে না, নকশিকাঁথার প্রচলনও হারিয়ে যাবে। আমি চাই পরবর্তী প্রজন্ম দেখুক আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। দেখবেন, একদিন তাদেরও কেউ কেউ এ কাজে যুক্ত হবে।'
ছবি: সৌজন্যে