নারায়ণগঞ্জে গ্রিকরা এসেছিল লবণের ব্যবসা করতে
১৮ শতকে বাঙালি, ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম বড় বিনিয়োগক্ষেত্র ছিল লবণ ব্যবসা। লবণ ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিপুল অর্থ-বিত্তের অধিকারী হন তারা। ১৭৭২ সাল নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হয়ে ওঠে লবণ।
লবণ ব্যবসায় ইংরেজ ও বাঙালির পাশাপাশি সাফল্য কুড়িয়েছে গ্রিক বণিকরাও। গ্রিকরা এই বঙ্গে লবণ ব্যবসায় নামে ১৭৮০-র দশকে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণ বিক্রির নথিপত্র থেকে জানা যায়, গ্রিক ব্যবসায়ী আলেকজান্ডার প্যানিয়টি চুনের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে লবণ ব্যবসায় মন দেয়। নারায়ণগঞ্জ ছিল পূর্ব বাংলার সবচেয়ে বড় লবণ বাজার।
বিখ্যাত গ্রিক লবণ ব্যবসায়ী
লবণ ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৯০ সালে আয় বাড়ানোর জন্য সীমিত পরিসরে নিলামের মাধ্যমে লবণ বেচতে আরম্ভ করে। বাঙালি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি গ্রিক বণিকরাও কোম্পানির নিলাম থেকে লবণ কেনার সুযোগ পেত। ১৭৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সবচেয়ে বড় লবণক্রেতা ছিলেন গ্রিক বণিক মাভরোদি কিরিয়াকোস।
প্রভাবশালী বাঙালি ব্যবসায়ীরা পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত লবণ কিনতেন। পশ্চিম বাংলায় (ভুলুয়া ও চট্টগ্রামের এজেন্সিগুলো) উৎপাদিত লবণে প্রায় ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল মাভরোদি কিরিয়াকোসের। এ থেকে ধারণা করা যায়, গ্রিক বণিকরা লবণ ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন।
ভুলুয়া ও চট্টগ্রামে উৎপাদিত লবণের সিংহভাগ প্রথমে নারায়ণগঞ্জে আনা হতো। তারপর সেখান থেকে বিক্রির জন্য পাঠানো হতো উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব বাংলা ও আসামে।
সে সময় পূর্ব বাংলায় অন্তত বারোজন গ্রিক লবণ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম আলেকজান্ডার প্যানিয়টি, নিকোলাস দিমিত্রিয়াস ও ইয়ার্নিশ অ্যান্টনি ফস্কোলো। ১৭৯৫ সালের দিকে মাভরোদি কিরিয়াকোস মারা যান। এর পর মাভরোদির জায়গা নেন কলকাতার চীনাবাজারের বাসিন্দা জন লুকাস। গ্রিক বণিকদের পক্ষে কোম্পানির নিলামে অংশ নিতে থাকেন তিনি।
১৮২২ সালে নারায়ণগঞ্জে ২১ হাজার মণ লবণ আসে। কোম্পানির কাছ থেকে গ্রিক বণিকদের জন্য এই লবণ কিনেছিলেন জন লুকাস। নারায়ণগঞ্জের অনেক গ্রিক পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাতায়াতকারী নৌকায় কাজ করতেন। অ্যান্ড্রু নামে এক গ্রিক এসব নৌকায় করে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালপাড়ায় লবণ সরবরাহ করতেন।
নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালানোর জন্য কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি ছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল গ্রিকদের। তিনি ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ার ১৮১১ সালে সুপারিন্টেনডেন্ট আরউইন লবণ এজেন্ট হিসেবে পদোন্নতি পান। আলেকজান্ডার প্যানিয়টির নেতৃত্বে গ্রিক বণিকরা তাকে অভিনন্দন ও প্রশংসাপত্র পাঠান।
কিন্তু এর কদিন পরই জেমস আরউইনের সঙ্গে ঝামেলা বাধে লবণ ব্যবসায়ীদের। সব ব্যবসায়ী মিলে কলকাতায় বাণিজ্য বোর্ডের কাছে অভিযোগ পাঠায়। অভিযোগকারীদের দলে বারোজন গ্রিক বণিকও ছিলেন। গ্রিকরা তার বিরুদ্ধে চলে গেছে জানতে পেরে আরউইন অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হন।
ব্যবসায় ধস
১৮২০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে লবণ ব্যবসায় লাভের হার কমতে থাকে। এ ব্যবসায় কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে সস্তা অবৈধ বেঙ্গল লবণে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। এর ফলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে বৈধ লবণের দাম।
ওই সময়ই অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কলকাতার অর্থবাজারের ওপর নির্ভরশীল বড় ব্যবসায়ীরা পুঁজি সংকটে পড়েন। এর ফলে মন্দা দেখা দেয় লবণ ব্যবসায়।
এদিকে কোম্পানিও লবণের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিল না। ফলে তারা ১৮৩৬ সাল থেকে নিলামের মাধ্যমে লবণ বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে নির্ধারিত দামে লবণ বিক্রি হতে থাকে।
নারায়ণগঞ্জের লবণ ব্যবসা থেকে বাঙালি ব্যবসায়ীরা নিজেদের গুটিয়ে নেন। ফলে লবণ ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে থাকে শহরটি। এর জেরে নারায়ণগঞ্জে কমে যায় গ্রিক ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিও। লবণ কেনার পরিমাণ কমিয়ে দেন জন লুকাস। ১৮৩৬ সালে কোম্পানির নিলাম থেকে তিনি মাত্র ৬ হাজার মণ লবণ কেনেন।
১৮৩৮ সালে নারায়ণগঞ্জের জনসংখ্যা ছিল ৬ হাজারের কিছু বেশি। এর ৬০ শতাংশ ছিল হিন্দু। প্রায় সব হিন্দু ও কিছু গ্রিক লবণ ব্যবসায় জড়িত ছিল। এই সংখ্যা থেকেই বোঝা যায়, ওই সময় শহর হিসেবে নারায়ণগঞ্জ গুরুত্ব হারাচ্ছিল।
গ্রিক-বাঙালির সম্পর্কের অবনতি
এদিকে গ্রিক ও বাঙালি ব্যবসায়ীদের সম্পর্কও বদলে যেতে থাকে। আগে নারায়ণগঞ্জে দুই পক্ষের বাণিজ্যিক স্বার্থ হুমকির মুখে পড়লেই গ্রিক বণিকরা বাঙালি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জোট বাঁধত। কিন্তু গ্রিকরা ধীরে ধীরে সরকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করে। গ্রিক বণিকরা বাঙালি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ও সুনামেরও ক্ষতিসাধন করেন। এর ফলে বাঙালি ও গ্রিক ব্যবসায়ীদের সদ্ভাব নষ্ট হয়ে যায়।
গ্ৰিকদের পেশা বদল
এককালে লবণ ছিল গ্রিক বণিকদের আয়ের প্রধান উৎস। তবে এই ব্যবসার হাল খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে গ্রিকরা আগে থেকেই তার ব্যবসা বহুমুখীকরণ করে ফেলে। সে সময় জমিদারি ব্যবসার রমরমা চলছিল। আলেকজান্ডার প্যানিয়টি পূর্ব বাংলায় জমিতে বিনিয়োগ করেন। অন্য গ্রিক ব্যবসায়ীরাও জমিদারিতে বিনিয়োগ করে।
এছাড়াও গ্রিকরা ওকালতিসহ অন্য পেশাতেও চলে যায়। কলকাতার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও চাকরি শুরু করে তারা। এভাবে ধীরে ধীরে লবণ ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য ব্যবসা ও পেশায় নিযুক্ত হয় গ্রিকরা। সেইসাথে লবণ ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে নারায়ণগঞ্জও গুরুত্ব হারায়।