জাহাঙ্গীরনগর: পাখিদের ক্যাম্পাস!
শীতের শুরুতেই অতিথি পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখরিত হতে থাকে ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার প্রায় ৭০০ একর। আশেপাশে আরও অনেক জলাশয় আর খালি জায়গা থাকলেও শুধু ওই নির্দিষ্ট ৭০০ একরেই অতিথিদের আনাগোনা। দলবেঁধে কখনও তারা আকাশে উড়ছে, আবার কখনও শাপলা-পদ্মে ভরা লেকের পানিতে আপন মনে ভেসে বেড়াচ্ছে।
প্রায় ৩৫ বছর ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসকে শীতকালের আবাসস্থল হিসেবে চিনে আসছে অতিথি পখিরা। এ বছরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নভেম্বরের শুরুতেই জাবি ক্যাম্পাসে দেখা মিলেছে ছোট সরালি, বড় সরালি, জলপিপি, শামুক খোল, গো বক সহ বিচিত্র রকম সব পাখির। তবে, আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে অনেক জলাশয় থাকতেও কেনো ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভিড়ে এই ক্যাম্পাসেই পাখিরা আসে, এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণি পরিবেশবিদ্যা ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক ড. মোঃ কামরুল হাসান বলেন, "কারণ হল, পাখির নিরাপত্তা। আশেপাশের জলাশয়গুলোতে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। তাই পাখিরা সেখানে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা।"
"এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অবৈধ শিকার হয়না। এখানে পুরো কমিউনিটি অর্থাৎ, ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই পাখিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে খুবই সচেতন", অধ্যাপক হাসান আরও যোগ করেন।
১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগরের লেকে প্রথমবারের মতো দেখা মিলেছিল অতিথি পাখির। এরপর থেকে প্রতি বছর শীত মৌসুমে এখানে আসছে তারা। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের সচেতনতার কারণেই জাহাঙ্গীরনগর হয়ে উঠেছে অতিথি পাখির শীতকালীন নিরাপদ আশ্রয়।
প্রশাসনসূত্রে জানা যায়, ছোট বড় মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লেক রয়েছে অন্তত ২৬টি। তবে, এরমধ্যে মাত্র ৪টি লেকে পাখিদের বসতে দেখা যায়। কারণ লেক ৪টি লিজমুক্ত। ফলে মাছচাষ বা অন্য কোনো ধরনের কার্যক্রম ও কীটনাশকের ব্যবহার না থাকায়, এগুলোতে প্রাকৃতিকভাবেই পাখিদের খাবার জন্মে।
অধ্যাপক হাসান জানান, জাহাঙ্গীরনগরে আসা পাখিগুলোর ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশই লোকাল মাইগ্রেটরি বা দেশীয় পরিযায়ী পাখি; এরমধ্যে ছোট সরালি বা পাতি সরালি অন্যতম। দেশের হাওড় অঞ্চল থেকে শীতের শুরুতেই এই পাখি আসে জাহাঙ্গীরনগরে।
এছাড়া, এর সঙ্গে কিছু বড় সরালিও আসে; এরা মূলত বিদেশি অতিথি। ভারত ও নেপালের হিমালয় বেসিন থেকে আসে এরা। শীতকালীন তুষারপাতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরেই আশ্রয় খোঁজে তারা জাহাঙ্গীরনগরে। এদের সঙ্গে আসে আরও কিছু দূর্লভ পাখি; সংখ্যায় এরা খুবই কম। এই পাখিগুলো আসে সাইবেরিয়া থেকে। তবে, এতো দূরের পথ পাড়ি দিয়ে আসা পাখিগুলো বেশিদিন থাকেনা ক্যাম্পাসে।
অধ্যাপক হাসান বলেন, "এগুলো ক্যাম্পাসে এসে খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়না। এরা আসে, ক্যাম্পাসে কিছুদিন বিশ্রাম করে, খাওয়া-দাওয়া করে আবার চলে যায়।"
"আমাদের হাওড় অঞ্চল, বিশেষ করে নদীর মোহনা অঞ্চলে, পদ্মা-যমুনার চর এবং একইসঙ্গে আমাদের ভোলার দিকে যে নিঝুম দ্বীপ এবং চর কুঁকড়িমুকড়ি রয়েছে, ওইদিকটায় এই পাখিগুলো বেশি দেখা যায়", তিনি আরও বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক জরিপে বলা হয়, আশির দশকে যখন জাবি ক্যাম্পাসে প্রথম অতিথি পাখি আসতে শুরু করে, তখন সন্ধান মিলেছিল প্রায় ৯০ প্রজাতির পাখির। এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২০০ তে গিয়ে ঠেকেছে। এরমধ্যে ১২৬ প্রজাতির দেশীয় ও ৬৯ প্রজাতির অতিথি পাখি রয়েছে। এদের মধ্যে আবার বেশ কিছু প্রজাতির পাখি ক্যাম্পাসে সব সময়ই দেখা যায়।
কমে যাচ্ছে অতিথি পাখির সংখ্যা
শিক্ষার্থীরা জানান, ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসে পাখির সংখ্যা কমে আসছে। এমনকি গতবছর শীতেও যে পরিমাণ অতিথি পাখি দেখা গিয়েছিল, এ বছর তার অর্ধেকের দেখাও মিলছে না।
এর কারণ জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আজিজুল সরকার বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প, সেইসঙ্গে ক্যাম্পাসে মানুষের ভিড় ও যানবাহনের চাপে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।"
আজিজুলের সঙ্গে একমত পোষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মৌসুমী রানী পাল বলেন, "উন্নয়নেরও প্রয়োজন আছে। তবে, সেটি এমনভাবে হতে হবে যেন তাতে জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব না পড়ে। উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষার মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখাটা জরুরি।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোর আশেপাশে ডজনখানেক সচেতনতামূলক ব্যানার, ফেস্টুন, সাইনবোর্ড লাগানো থাকলেও গাড়ি নিয়ে অহরহই লেকের পাড়ে চলে আসছেন পাখিপ্রেমী দর্শণার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি গবেষকরা মনে করছেন, দর্শণার্থীদের এমন অসচেতনতার কারণেই কমে যাচ্ছে পাখির সংখ্যা; বিরক্ত হয়ে তারা জাহাঙ্গীরনগরে আসা কমিয়ে দিয়েছে।
অধ্যাপক হাসান বলেন, "ক্যাম্পাসটি ঢাকার পাশে হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই এখানে দর্শনার্থীরা বেশি আসেন। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেও তাদেরকে ঠেকানো সম্ভব হয়না। অনেকেই লেকের পাড়ে গাড়ি নিয়ে চলে আসেন। এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
এই সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো বিশেষ উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "নিরাপত্তাকর্মীদের ছুটির দিনে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা লেকের পাড়কে কোলাহল মুক্ত রাখার চেষ্টা করেন। তবে, যেখানে বেশি লোকের সমাগম হয় সেখানে উনাদের পক্ষেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।"
এ ব্যাপারে দায়িত্বরত কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বললে, তারাও দর্শণার্থীদের বেপরোয়া আচরণে বিরক্তি প্রকাশ করেন। মানুষের ভিড় ও যানবাহনের কারণেই পাখির সংখ্যা কমে গেছে বলে জানান তারা।
অধ্যাপক হাসান দর্শণার্থীদের সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, "যদি দর্শণার্থীরা একটু সচেতন হন; তারা যদি নির্দেশনা মেনে চলেন তাহলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। অন্যথায়, এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে একা কাজ করা কঠিন হয়ে উঠবে।"
অনেকেই মনে করছেন, গতবছরের তুলনায় এ বছর পাখির সংখ্যা কম হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ করোনাভাইরাসজনিত লকডাউন। প্রায় দু'বছর যাবত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায়, গতবছর পাখির সংখ্যা ছিল বেশি; লেকগুলো পরিপূর্ণ হয়েছিল লাল-সাদা শাপলা ও পদ্মে। এ বছর প্রায় পুরো নভেম্বরজুড়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলেছে ভর্তি পরীক্ষা। তাই মানুষের সমাগম বেশি থাকায় এখনও পর্যন্ত পাখির সংখ্যা কম বলে মনে করছেন অনেকে।
অধ্যাপক হাসান জানান, পাখির পিক টাইম এখনও শুরু হয়নি।
"সাধারণত ডিসেম্বরের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। আশা করা যায়, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পাখির সংখ্যা আরও বাড়বে", যোগ করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখিমেলা
পাখি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর আয়োজন করে আসছে পাখিমেলার। ২০০০ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান অডিটরিয়াম প্রাঙ্গণে এ আয়োজন করা হয়। শুরুতে বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের উদ্যোগে পাখিমেলার আয়োজন করা হলেও, পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। ২০০৫ সাল থেকে এই মেলার আয়োজন করে আসছে বিভাগটি, আর সেই আয়োজনে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবসহ আরও বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
তবে, গতবছর লকডাউনের কারণে এই আয়োজন করা সম্ভব হয়নি বলে জানান অধ্যাপক হাসান। সবকিছু ঠিক থাকলে নতুন বছরের শুরুতে, আগামী ৭ জানুয়ারি পাখিমেলা আয়োজনের কথা ভাবছে প্রশাসন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন এই মেলায়। পাখি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতার ওপর আলোকপাত করে তৈরি করা হয় নানা ধরনের ইভেন্ট; বিজয়ীদের মাঝে সনদ ও ক্রেস্টসহ বিতরণ করা হয় পুরস্কার।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক হাসান বলেন, "পাখিমেলার ইভেন্টগুলোয় যারা অংশ নেন তারা মূলত একটি মেসেজ দিয়ে থাকেন যে, পাখি আমাদের প্রকৃতির একটি অংশ; তাদেরকে সংরক্ষণ করা দরকার। এই সচেতনতা যত বাড়বে পাখিরা ততই নিরাপদে থাকবে।"
"শুধু আমাদের ক্যাম্পাসের জন্য নয়, সারা বিশ্বের পাখিদের ব্যাপারে সচেতন করতেই এ আয়োজন করা হয়", আরও যোগ করেন তিনি।
পাখি সংরক্ষণে শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ
কেবল পাখিদের সুরক্ষায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একক কোনো সংগঠন না থাকলেও 'ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেস্কিউ ফাউন্ডেশন' নামে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের একটি স্বেচ্ছাসেবী ফেসবুক গ্রুপের কথা উল্লেখ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজিজুল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা এখন ১ লাখের বেশি।
গ্রুপ সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা সাপসহ বিপদগ্রস্ত যেকোনো বন্যপ্রাণি নিরাপদে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবমুক্ত করে থাকেন। টিয়া, ঘুঘুসহ আরও যেসব পাখি বাজারে অহরহ বেচা-কেনা হয়, সেগুলো তারা রক্ষা করে ক্যাম্পাসে ছেড়ে দেন।
এছাড়া, করোনা মহামারির আগে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে শিক্ষার্থীরা পাখি সংরক্ষণে বিভিন্ন স্কুলে শিশুদের মাঝে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালিয়েছেন বলেও জানান আজিজুল। তবে করোনাজনিত লকডাউন, সেশনজটসহ নানা কারণে এখন স্বেচ্ছাসেবামূলক এসব কর্মকান্ডে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া কোনভাবেই অতিথি পাখি সংরক্ষণ ও তাদের বিচরণ বাড়ানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন গবেষকরা। হাজার হাজার মাইল উড়ে এসে যদি পাখিরা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে না পারে, তাহলে দিন দিন পাখির সংখ্যা কমতেই থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পরিচর্চা ও সংরক্ষণ নীতির কারণেই কোলাহলপূর্ণ ঢাকা শহরের পাশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন যুগ ধরে প্রতি বছরই চলছে অতিথি পাখিদের সমাগম। কিন্তু দর্শণার্থীদের অসচেতনতা যদি এভাবেই বাড়তে থাকে, তাহলে এক সময় ক্যাম্পাস অতিথি পাখিশূন্য হয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন পাখি বিশেষজ্ঞরা।