২০২১ সালের ১০টি অবিশ্বাস্য আবিষ্কার!
মহামারির কঠিন একটি বছর পার করার পর, বাড়ির দেয়ালে ৩ লাখ ডলার মূল্যের সোনার কয়েন কিংবা ড্রয়ারে ১৭ লাখ ডলার মূল্যের বিরল থালার সন্ধান পাওয়া নিঃসন্দেহে মন্দ নয়।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রায়শই অপ্রত্যাশিত জায়গায় আবিষ্কার করে থাকেন বিরল সব অমূল্য জিনিস, যার ফলশ্রুতিতে আমরা প্রাচীন মানব ইতিহাসের নিত্যনতুন তথ্য পাই। এ বছরটিও তার ব্যাতিক্রম ছিল না; করোনার মাঝেও প্রতাত্ত্বিকরা বিশ্বজুড়ে খুঁজে পেয়েছেন অমূল্য, বিরল ও রহস্যময় কিছু জিনিসের সন্ধান।
তাদের সেই বিশেষ আবিষ্কারগুলো নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এবারের আয়োজন। চলুন জেনে নেওয়া যাক ২০২১ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কয়েকটি আবিষ্কার সম্পর্কে-
দেড় হাজার বছর পুরনো সোনার আংটি
নভেম্বরে ইসরায়েলের ইয়াভন শহরে আবিষ্কৃত হয়েছে বেগুনি রঙের পাথর বসানো সোনার একটি আংটি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, অন্তত ১,৫০০ বছর আগে আংটিটি হ্যাংওভার বা অ্যালকোহলের প্রভাব কাটাতে ব্যবহার করা হত। রত্নটি যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে 'অ্যামফোর' নামে পরিচিত একটি প্রাচীন মদের ওয়্যারহাউসের উপস্থিতির কথাও জানিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আংটির মালিক ছিলেন সম্ভবত একজন ধনী বাইজেন্টাইন; তৃতীয় থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে হয়তো তিনি রত্নটি ব্যবহার করেছিলেন।
খনন কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত সহ-পরিচালক এলি হাদ্দাদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, "আংটিটি হতে পারে ওয়্যারহাউসের (ওয়াইনারি) মালিকের অথবা একজন ফোরম্যানের কিংবা দুর্ভাগ্যের শিকার কোনো কাস্টোমারের, যিনি হয়তো অমূল্য এই রত্নটি হারিয়ে ফেলেছিলেন।"
রেমব্রান্টের চিত্রকর্ম
২০১৬ সালে রোমের একটি বাড়ির দেওয়াল থেকে আবিষ্কৃত হয় প্রাচীন এক চিত্রকর্ম। পরবর্তীতে এটি পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠানো হলে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। ঘরের দেওয়াল থেকে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ওই শিল্পকর্মটি সৃষ্টি করেছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রেমব্রান্ট।
একসময় বিশ্বাস করা হতো, এই পেইন্টিংটিই রেমব্রান্টের সংরক্ষিত একমাত্র শিল্পকর্ম। তবে এটি মূল শিল্পকর্মটি নয়, বরং অন্যদের দিয়ে এর কপি তৈরির মাধ্যমে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল বলেই মনে করা হতো এতদিন।
সম্প্রতি ইতালিয় হেরিটেজ ফাউন্ডেশন নিশ্চিত করেছে, 'দ্য অ্যাডোরেশন অফ দ্য ম্যাগি' নামের ওই শিল্পকর্মটি ডাচ মাস্টার রেমব্রান্টের নিজের হাতে আঁকা তৈলচিত্র। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, ১৬৩২-১৬৩৩ সালে চিত্রটি এঁকেছিলেন তিনি। চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে, তিনজন বিজ্ঞ ব্যক্তি প্রথমবারের মতো শিশু যীশুর সঙ্গে দেখা করেছেন।
৩,০০০ বছর পুরনো শহর
বালির নিচে ঘুমিয়ে থাকা মিশরের ৩ হাজার বছর পুরানো শহরটিই এ বছরের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার। ২০২০ সালের শরৎ-এ প্রত্নতাত্ত্বিকরা লুক্সর শহরের পশ্চিম তীরে আবিষ্কৃত 'দ্য রাইজ অফ অ্যাটেন'-এর খনন কাজ শুরু করেছিলেন। সেখানেই আবিষ্কার হয়েছে এই শহর।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ইজিপ্টোলজির অধ্যাপক বেটসি ব্রায়ান এক বিবৃতিতে বলেন, "হারিয়ে যাওয়া এই শহরের আবিষ্কারটি তুতানখামুনের সমাধির পর দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার।"
এপ্রিল পর্যন্ত, প্রত্নতাত্ত্বিকরা শহরের দক্ষিণ অর্ধেকের বেশির ভাগই উন্মোচন করেছিলেন। ১০ ফুট (৩ মিটার) পর্যন্ত উঁচু দেয়ালওয়ালা অক্ষত কয়েকটি বাড়ি, একটি বড় বেকারি ও একটি সমাধিস্থল খুঁজে পেয়েছেন তারা। সমাধিস্থলের কঙ্কালের অস্তিত্ব খুজে পেয়ছেন বলেও দাবি করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
বিবৃতি অনুসারে, বাড়ির ঘরগুলোতে ছিল মাটির তৈরি বাসন, চরকা, বুনন ও কাচ তৈরির সরঞ্জাম এবং নানান রকমের গয়না; যেন বাড়ির বাসিন্দারা গতকালই এগুলো গুছিয়ে রেখেছেন।"
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন প্রাণীর চিত্র
ইন্দোনেশিয়ান সুলাওয়েসি দ্বীপের একটি গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন কোনো প্রাণীর চিত্র।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, শূকরের এই চিত্রকর্মটি আঁকা হয়েছে কমপক্ষে ৪৫ হাজার ৫০০ বছর আগে। লাল গেরুয়া-রঙের দৃশ্যে তিনটি শূকরকে দেখানো হয়েছে শিল্পকর্মটিতে; এরমধ্যে একটিকে তার অপর দুই সঙ্গীর মধ্যে লড়াই পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যাচ্ছে।
এছাড়া, গুহা থেকে ৪৩ হাজার ৯০০ বছর পুরোনো শিকারের আরও একটি চিত্রও উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক দল।
ব্রোঞ্জের মুখোশ
চলতি বছরের জুনে বলির গর্ত থেকে উদ্ধার করা হয় ব্রোঞ্জের তৈরি হালকা ওজনের সোনালী রঙের একটি মুখোশ। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের চেংডুর কাছে অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট সানজিংডুই থেকে আবিষ্কৃত হয় মুখোশটি। ৪.৬ বর্গ-মাইল সাইটটিতে পাওয়া গেছে হাজার হাজার নিদর্শন। তবে, উদ্ধারকৃত প্রায় ৫০০টি ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এটিকেই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
প্রায় এক শতাব্দী আগে স্থানীয় একজন কৃষক ঘটনাক্রমে আবিষ্কার করেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটটি। তারপর থেকেই সেখানে শুরু হয় খনন কাজ।
দেশটির রাষ্ট্রচালিত প্রেস এজেন্সি সিনহুয়া অনুসারে, মুখোশটি সম্ভবত শ্যাং রাজবংশের শেষের দিকে তৈরি করা হয়েছিল। অর্থাৎ ১০৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই তৈরি করা হয়েছিল মুখশটি। সেই হিসাবে এর বয়স সম্ভবত ৩,০০০ বছরেরও বেশি। এছাড়া, অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যে ছিল হাতির দাঁতের ধ্বংসাবশেষ, ব্রোঞ্জের মূর্তি ও একটি জেড নাইফ।
এখানেই শেষ নয়...
চলতি বছরের মার্চে জুডিয়ান মরুভূমিতে কর্মরত প্রত্নতাত্ত্বিকরা ডেড সি স্ক্রলে কয়েক ডজন নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন বলে ঘোষণা দেয় ইসরায়েল সরকার।
এছাড়া, মার্চে গবেষকরা পেরুতে ৩ হাজার ২০০ বছরের পুরানো একটি ম্যুরাল শনাক্তেরও ঘোষণা দিয়েছেন। ম্যুরালটি ২০২০ সালে উত্তর পেরুতে পোড়া ইটনির্মিত একটি মন্দিরের পাশে আবিষ্কৃত হয়েছিল; তবে, এর বেশিরভাগই স্থানীয় কৃষকদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে।
চলতি বছরের মে মাসে ইতালির ইসারনিয়া শহরে আবিষ্কৃত হয় ২ হাজার বছরের পুরনো মার্বেলের তৈরি একটি মাথা। রোমের প্রথম সম্রাট অগাস্টাস অক্টাভিয়ানের আদলে নির্মিত মাথাটি মধ্যযুগের একটি প্রাচীর মেরামতের সময় আবিষ্কৃত হয়।
অক্টোবরে ডালাস মিউজিয়াম অফ আর্ট, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের অলিভ গ্রোভ পেইন্টিংয়ের নতুন আবিষ্কারগুলোও প্রদর্শন করেছে। এখানে একটি পতঙ্গের লেজ পাওয়া যায়, যা হয়তো দুর্ভাগ্যবশত তার চিত্রকর্মের ওপর পড়েছিল। এর মাধ্যমে অন্তত শিল্পকর্মটি কোথায় তৈরি হয়েছিলো তার প্রমাণ মেলে।
এছাড়া, নভেম্বরে মিশরের আবু ঘুরাব শহরে হারিয়ে যাওয়া একটি 'সূর্য মন্দির'-এর সন্ধান পাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। তাদের বিশ্বাস মন্দিরটি ২৫ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল।
- সূত্র: সিএনএন