ভারতবর্ষের রহস্যময় চাপাতি আন্দোলন: ব্রিটিশদের মহাশঙ্কায় ফেলে দেয়!
সময়টি ১৮৫৭ সাল। ব্রিটিশ-অধিকৃত ভারতে সেসময় চলছিলো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। সেসময়ের আলোচিত সিপাহী বিপ্লবের পাশাপাশি আরও একটি রহস্যময় আন্দোলন শুরু হয়, যা ছিল ব্রিটিশদের উদ্বেগের কারণ। অস্বাভাবিক সেই ঘটনাকে 'চাপাতি আন্দোলন' হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
উত্তর ভারতের গ্রাম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযারে, প্রতিদিন হাজারো চাপাতি (ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত পাতলা বিশেষ ধরনের রুটি) এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পাঠানো হতো। মানুষের হাতে হাতে পাঠানো এই চাপাতি কোথা থেকে আসতো বা কী অর্থ বহন করতো- তা আদতে কেউই জানতো না।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন সার্জন ডা. গিলবার্ট হ্যাডো ব্রিটেনে তার বোনের কাছে লেখা একটি চিঠিতে এ ঘটনার উল্লেখ করেন। তিনি লিখেন, "বর্তমানে সমগ্র ভারত জুড়ে একটি রহস্যময় ঘটনা ঘটছে। কেউ এর অর্থ জানে বলে মনে হয় না। কোথা থেকে, কার দ্বারা বা কী উদ্দেশ্যে এটি পরিচালিত হচ্ছে তা আমার জানা নেই। এমনকি ঘটনাটি কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বা গোপন কোনো সমাজের সাথে সম্পর্কিত কিনা তাও জানা যায়নি।"
সে ঘটনাকে 'চাপাতি আন্দোলন' হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
সেসময় একটি গ্রাম থেকে ৪টি (বা অন্য কোনো সংখ্যার) চাপাতি গ্রামের চৌকিদার বা প্রহরীর হাতে করে কাছাকাছি গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হতো। চাপাতির সাথে তারা একটি নির্দেশনাও দিয়ে আসতো যেখানে আরও ৪টি চাপাতি তৈরি করে পাশের গ্রামে দিয়ে আসার কথা বলা থাকতো। চৌকিদাররা মাইলের পর মাইল ভ্রমণ করে ও দুর্গম জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে এসব চাপাতি বিতরণ করতেন। তবে, এর উৎপত্তি নিয়ে খুব কম লোকই জিজ্ঞাসা করতো।
১৮৫৭ সালের গোড়ার দিকে আগ্রার নিকটবর্তী মথুরা শহরের ম্যাজিস্ট্রেট মার্ক থর্নহিলের মাধ্যমে চাপাতি আন্দোলন প্রথমবারের মতো ব্রিটিশদের নজরে আসে। ঐসময় তার অফিসে বাসি চাপাতির একটি বান্ডেল এসে পৌঁছায়। জিজ্ঞাসাবাদের পর, থর্নহিলকে জানানো হয়, একজন বিভ্রান্ত চৌকিদারের কাছ থেকে চাপাতিগুলো একজন ভারতীয় পুলিশ অফিসার নিয়ে এসেছেন। আরও জানা যায়, ঐ চৌকিদারও তার মতো আরেক বিভ্রান্ত চাপাতি বিতরণকারীর কাছ থেকে বান্ডেলটি পেয়েছিলেন।
তবে, থর্নহিল এই চাপাতির উৎস অনুসন্ধানের চেষ্টা করে বিফল হন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, চাপাতিগুলো প্রত্যেক ভারতীয় বাড়িতে তৈরি করা সাধারণ চাপাতি; বিশেষ কিছুই ছিল না এতে। তবে কেনোই বা চলছিল এই বিতরণকাজ? উত্তর জানা ছিল না কারো।
উপমহাদেশের দক্ষিণে নর্মদা নদী থেকে শুরু করে উত্তরে কয়েকশো মাইল পেরিয়ে নেপালের সীমান্ত পর্যন্ত চলছিল চাপাতি বিতরণ। উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল, কিংবা কলকাতার কাছে বা উত্তরাঞ্চল, অথবা ইন্দোর- যেকোনো স্থান থেকেই এর উৎপত্তি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এরমধ্যে কিছু অঞ্চল থেকে চাপাতি রাতারাতি ২০০ মাইল দূরেও বিতরণ করা হচ্ছিল।
চাপাতির এই রহস্যজনক বিতরণ ব্রিটিশ অফিসারদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয়রা যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক চিঠি আদান-প্রচান করতো তাহলে তাদেরকে থামানো যেত। কিন্তু খাবার বিতরণের জন্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার উপায়ও ছিল না। এমনকি, এসব খাবার বিতরণ করতেন মূলত পুলিশ চৌকিদারেরাই।
অনেক ব্রিটিশ অফিসারই এই রহস্যময় আন্দোলনকে আসন্ন বিপর্যয়ের একটি অশুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। ইতিহাসবিদ কিম ওয়াগনার বলেন, "ভারতীয়দের মধ্যে চলমান যেসব ঘটনা তারা বুঝতে পারতো না, সেসব নিয়ে গভীর সন্দেহ করতো ব্রিটিশরা।" এক বান্ডিল চাপাতি থানায় পৌঁছালেই তা অফিসারদেরকে আতঙ্কে ফেলে দিত।
এমনকি সেসময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ব্রিটিশরা নিজেই এই ঘটনার পেছনে ছিল। ময়দার সাথে গরু ও শুকরের হাড়ের গুড়ো মিশিয়ে ভারতীয়দেরকে যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম সমাজ থেকে তারা আলাদা করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। একবার যদি কেউ এই নিষিদ্ধ খাবার খেয়ে ফেলে তাহলে তাকে তার ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা হবে বলে মনে করতো মানুষ। ভারতীয়দেরকে খ্রিস্টান ধর্মে রুপান্তরের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছিল এটি।
ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা নিয়ে যে সে বছর কেবল একটি গুজব ছড়িয়েছে তা কিন্তু নয়। একই বছর ব্রিটিশরা 'এনফিল্ড রাইফেল' নামক নতুন একটি অস্ত্রের আমদানি শুরু করে উপমহাদেশে। এই রাইফেলের জন্য নিয়ে আসা কার্তুজগুলো ছিল কাগজের তৈরি। গানপাউডার ও বুলেট ভরা থাকতো এতে। রাইফেল চালানোর সময় সৈনিকদের হাত খালি না থাকায় কার্তুজগুলো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ব্যবহার করতে হতো। এই কার্তুজ তৈরিতে শূকর ও গরুর চর্বি ব্যবহার করা হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে সেসময়। যদিও ব্রিটিশরা নিশ্চিত করে জানিয়েছিল, উপমহাদেশে আমদানিকৃত কার্তুজে এই চর্বি ব্যবহার করা হয়নি, সিপাহীরা তা মানতে নারাজ ছিল।
এই বিদ্বেষের জের ধরেই শুরু হয় ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই ২৫০ বছর ধরে শাসন করা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতনের ধারা শুরু হয়।
তবে, সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী ধারণা করা হয়, কলেরা আক্রান্ত মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার একটি প্রয়াস হতে পারে চাপাতি আন্দোলন। কিন্তু কোনোভাবে হয়তো বিতরণের ধারা ব্যহত হয়ে চাপাতিগুলো উপমহাদেশেই উদ্দেশ্যহীনভাবে বিতরণ হতে থাকে।
এই ঘটনা নিয়ে গবেষণাকারী কিম ওয়াগনার বলেন, "বিতরণের প্রথম দিকেই চাপাতিগুলো অনর্থক হয়ে দাঁড়ালেও, উপমহাদেশে এটি একটি বিশেষ প্রভাব ফেলে। সেগুলো আদতে 'আসন্ন ঝড়ের সংকেত' ছিল না৷ বরং, ১৮৫৭ সালে চাপাতির মাধ্যমে ছড়ানো গুজব থেকে ভারতীয়দের মধ্যে বিদ্যমান অবিশ্বাস ও আতঙ্কের বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।"