কুমিল্লার রসমালাই: আসল মাতৃভান্ডারের খোঁজে
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আলেখারচর। মহাসড়কের এ অংশের দু'পাশে তাকালে চোখে পড়বে বেশ ক'টি মাতৃভান্ডারের দোকান। এসব মিষ্টির দোকানের অধিকাংশই নকল মাতৃভান্ডারের দোকান।
আলেখারচরের আশপাশেই এমন মাতৃভান্ডার নাম সংযুক্ত ৩৬টি প্রতিষ্ঠান আছে। এ অংশ বাদে গোটা মহাসড়ক জুড়ে এমন দোকান আছে ২০টির মতো। তাছাড়া কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায়ও মাতৃভান্ডার নামে দোকান আছে। তবে যেহেতু অন্য জেলার মানুষের যাতায়াত মহাসড়ক ধরে, তাই মহাসড়কের নকল মাতৃভান্ডারেই মানুষ বেশি প্রতারিত হচ্ছে। যদিও নকল মাতৃভান্ডারের সাথে সংশ্লিষ্টদের দাবি, তারা নিয়ম মেনেই ব্যবসা করছেন। এতে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন আছে।
তাছাড়া শুধুমাত্র মাতৃভান্ডার নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেওয়া হয়নি। যেমন, মাতৃভান্ডার হোটেল এন্ড সুইটস, মাতৃভান্ডার সুইটস লিমিটেড, মাতৃভান্ডার কুমিল্লা, মাতৃভান্ডার সুইটস (প্রাইভেট) লিমিটেড, মাতৃভান্ডার সুইটস প্রাইভেট লিমিটেড, কুমিল্লা মাতৃভান্ডার, কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের একমাত্র শো রুম ও কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের শো রুম ইত্যাদি নামেও লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে।
সারাদেশেই এত বেশি জনপ্রিয় যে অন্য নামের দোকান হলে সেখানে ক্রেতা আসতে চান না। অনেকে রসমালাই বলতে বোঝেন মাতৃভান্ডারের রসমালাই।
মহাসড়ক ঘুরে অন্তত দশটি নকল মাতৃভান্ডারের সাথে কথা হয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিবেদকের।
মহাসড়কের মাতৃভান্ডার হোটেল এন্ড সুইটসের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাস থেকে ক্রেতারা নেমে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছেন মিষ্টির দোকানে। কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে রসমালাই কিনছেন। কেজি প্রতি তিনশ টাকা। ওই দোকানের কর্মচারী আবুল কালাম রসমালাইসহ মিষ্টি বিক্রি দেখভাল করেন। আবুল কালাম জানান, সাত বছর আগে দোকানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি দুই বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। এত নাম থাকতে নামের পাশে মাতৃভান্ডার নামটি সংযুক্ত করা হলো কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এটা আমি বলতে পারবো না।"
বাইরে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা "কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের শো রুম"। ভেতরে মাতৃভান্ডার সুইটস লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক ইউসুফ মিয়া জানান, আমরা কোনোভাবেই গ্রাহকদের প্রতারিত করছি না। বিক্রির আগে আমরা অবশ্যই জানিয়ে দিই এটা আসল মাতৃভান্ডার নয়। কিন্তু গ্রাহকরা তারপরও কেনেন। এর একটি কারণ হলো, তারা দামে ছাড় পান। অন্য আরেকটি কারণ, লোক দেখানো যে কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমালাই কিনেছেন। শহরের ভিতরে ঢুকে রসমালাই কেনার সুযোগ না পেয়েও কেউ কেউ এখান থেকে রসমালাই কিনে নিয়ে যান। তবে কাউকে তারা ঠকান না বলে তিনি দাবি করেন।
কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের শো-রুমের ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান বলেন, "আমরা লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছি। আমরা ওদের (প্রকৃত মাতৃভান্ডার) নাম হুবহু ব্যবহার করছি না। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ রসমালাই বলতে মাতৃভান্ডারকে বোঝেন, তাই এই নামটা ব্যবহার করা হয়েছে।"
আসল মাতৃভান্ডারের অবস্থান
কুমিল্লা নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ২০০ গজ পূর্বদিকে মনোহরপুর। মনোহরপুরের একটি টিনশেড ঘরে তৈরি ও বিক্রি হয় মাতৃভান্ডারের রসমালাই। তার দুই পাশে ভগবতী পেড়া ভান্ডার ও শীতল ভান্ডার। উল্টোদিকে কুমিল্লা মিষ্টি ভান্ডারের অবস্থান। মাতৃভান্ডারের সামনে সারাদিনই ক্রেতাদের ভিড় থাকে। মাতৃভান্ডারের স্বত্বাধিকারী অনির্বাণ সেন গুপ্ত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তারা গুণগত মান ঠিক রাখার চেষ্টা করছেন। তার দাদা, বাবার পর বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছেন। বর্তমানে ২৫জন কারিগর কর্মরত আছেন এখানে।
অনির্বাণ সেন গুপ্ত আরও জানান, যে পরিমাণ উৎপাদন, তাতে চাহিদা অনুযায়ী ক্রেতাদের রসমালাই সরবরাহ করতে পারছেন না তারা। স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার কারণে দিন দিন মাতৃভান্ডারের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। তিনি আরো বলেন, "চাইলে ওদের ( নকল মাতৃভান্ডার) বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারি। ওরা কিছু করে খাচ্ছে, তাই আইনের আশ্রয় নিচ্ছি না। যদি ভবিষ্যতে মনে হয়, ওরা বড় ধরনের প্রতারণা করছে, তখন বিষয়টি ভাবতে হবে।"
মাতৃভান্ডারের ইতিহাস
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক জানান, ১৯ শতকের গোড়ার দিকে কুমিল্লা শহর দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। রাজগঞ্জ বাজারের পূর্বদিক ছিল ব্যবসায়িক এলাকা। আর পশ্চিম দিক আবাসিক। শহরের উত্তর-পশ্চিমের অংশে বিদেশি পর্যটকদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা ছিল। রাজগঞ্জের পূর্বে ছাতিপট্টি, পানপট্টি, গোয়ালপট্টি, স্বর্ণপট্টি, তেরীপট্টি, খড়মপট্টি, কাশারিয়াপট্টি, বাতাসাপট্টি, দেশলাই পট্টি ইত্যাদি এমন বেশকিছু ব্যবসায়িক অঞ্চল ছিল। গোয়ালপট্টিতে ঘোষরা মিষ্টান্ন তৈরি করতো। সেখানে খাঁটি গরুর দুধ দিয়ে দই, মাঠা, মাখন, ঘি তৈরি করা হতো। জিলাপি ও বাতাসাও তৈরি হতো এসব দোকানে। একসময় দইজাতীয় মিষ্টান্ন তৈরি শুরু করেন ঘোষরা। তবে তা ছিল সাদামাটা। ১৯৩০ সালের দিকে কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর এলাকায় গড়ে ওঠে মাতৃভান্ডার। ওই বছর শীতল ভান্ডার ও ভগবতী পেড়া ভান্ডারও প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা মিষ্টি ভান্ডার। তারাই ছানার মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। এরপর আকৃতি পরিবর্তন করে রসমালাই। মূলত এ চার প্রতিষ্ঠান থেকেই কুমিল্লার রসমালাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
অধ্যাপক শান্তি রঞ্জন ভৌমিক মনে করেন, মাতৃভান্ডার সারাবিশ্বে কুমিল্লার মুখ উজ্জ্বল করেছে। কুমিল্লার অনেক ঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে মাতৃভান্ডার ধ্বংস হয়নি বরং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটা গৌরবের বিষয়।
কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক অ্যাডভোকেট গোলাম ফারুক জানান, কুমিল্লা তখন ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত। নগরীর মনোহরপুরে বর্তমান সোনালী টাওয়ারের সাথে কৈলাস ভবন ছিল। সেখানে ইউনাইটেড ব্যাংক ছিল। ওই ভবনের মালিকের ছেলের নাম ইন্দুভূষণ দত্ত। পাশে রাজরাজেশ্বরী কালিবাড়ি। মন্দিরের ভোজনের উপকরণ ছিল মিষ্টি। তাছাড়া ব্যাংকেও দূর-দূরান্তের মানুষের যাতায়াত ছিল। তাই ১৯৩০ সালের দিকে মাতৃভান্ডারের মূল মালিক ইন্দুভূষণ দত্ত থেকে জায়গা নিয়ে মিষ্টির দোকান শুরু করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গভবনে বিদেশি অতিথিদের আতিথেয়তায়ও মাতৃভান্ডারের রসমালাই সরবরাহ হতো। তাছাড়া একসময় তারা ব্র্যান্ড হয়ে যায়। অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পেছনে পড়ে যায়।
মাতৃভান্ডারের স্বত্বাধিকারী অনির্বাণ সেন গুপ্ত বলেন, "ব্রিটিশ আমলে ঘোষরা মিষ্টি তৈরি করতো। একটা সময় বর্ণের পার্থক্য কমে আসে। হিন্দুদের বিভিন্ন বর্ণ ও মুসলিমরাও মিষ্টি তৈরি শুরু করে। পার্থক্য কমে আসায় আমরাও বংশ পরম্পরায় এ ব্যবসা ধরে রাখি। মন্দিরের কালী থেকে মায়ের নামটি নিয়ে এর নাম মাতৃভান্ডার করা হয়েছে।"