মাউন্ট এভারেস্ট কি সত্যিই বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত?
সেই ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে আসছি- বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার মাউন্ট এভারেস্ট। এটি সেরকমই একটি তথ্য যা শৈশবকাল থেকেই আমাদের মগজে গেঁথে আছে যেমন, চাঁদে পদার্পনকারী প্রথম মানব নীল আর্মস্ট্রং অথবা নীল তিমি হলো বিশ্বে এযাবত বসবাসকারী সর্ববৃহৎ প্রাণি। তবে যে কেউ এটা শুনে চমকে উঠবেন যে পৃথিবীতে আরো অনেক পর্বতশৃঙ্গ আছে যেগুলোকে সর্বোচ্চ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে; আর এটি পুরোপুরি নির্ভর করছে কীভাবে উচ্চতা মাপা হচ্ছে। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার বিচারে কে সর্বোচ্চ, পর্বতের বেস থেকে শীর্ষ পর্যন্ত উচ্চতার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ এবং পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী বিন্দুর দূরত্বের বিচারে সর্বোচ্চ- এসব বিভিন্ন প্যারামিটারকে বিবেচনায় নিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত কোনটি? এমন প্রশ্নকে কেউ অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না।
মাউন্ট এভারেস্ট নেপাল ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নিঃসন্দেহে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্বত, যার রহস্যঘেরা সৌন্দর্য আজো মুগ্ধ করে চলেছে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে। এর অপর নাম "চোমোলুংমা", তিব্বতি ভাষায় যার অর্থ "গডেস মাদার অব দ্য ওয়ার্ল্ড"। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে প্রথম নেপালি শেরপা তেনজিং নোরগে এবং নিউজিল্যান্ডের নাগরিক এডমন্ড হিলারি মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন। সেই থেকে এ পর্যন্ত সফলতার সঙ্গে এভারেস্টে আরোহন করেছেন প্রায় ৪ হাজার অভিযাত্রী। দ্য গার্ডিয়ানের তথ্য অনুযায়ী, ১৯২২ সাল থেকে সংরক্ষিত রেকর্ড থেকে দেখা যায়, এই দুঃসাহসিক অভিযানে ৩০০ এরও বেশি অভিযাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন।
গত কয়েক দশকে গবেষকরা বহুবার মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা মেপেছেন। কিন্তু ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বসাম্প্রতিক পরিমাপ অনুযায়ী, মাউন্ট এভারেস্ট সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে ২৯,০৩১.৬৯ (৮,৮৪৮.৮৬ মিটার) ফুট উঁচু। দৈর্ঘ্যে যা প্রায় ৫.৫ মাইল (৮.৮ কিলোমিটার) । সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাকে শূন্য ধরে এই উচ্চতা মাপা হয়েছে। কিন্তু এভাবে উচ্চতা পরিমাপ বিশাল এক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেন আমরা বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা মাপার ক্ষেত্রে 'সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে উঁচু' ব্যবহার করি?
স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব হাইল্যান্ডস অ্যান্ড আইল্যান্ডস-এর সেন্টার ফর মাউন্টেইন স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক মার্টিন প্রাইস লাইভ সায়েন্সকে বলেন, "পরিমাপে তুলনামূলক বিচারের ক্ষেত্রে একটি অপরিবর্তনীয় বেসলাইন প্রয়োজন। ঐতিহাসিকভাবে, এমনকি বর্তমানেও এলিভেশন বোঝানো হয়ে থাকে সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতার চেয়ে কত উঁচু তা। তবে এধরনের উচ্চতার পরিমাপ হওয়া উচিত সমুদ্রপৃষ্ঠের একটি স্ট্যান্ডার্ড গড় উচ্চতার ভিত্তিতে। আর এই স্ট্যান্ডার্ডকেও সংজ্ঞায়িত করতে হবে। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের এই উচ্চতা বিভিন্ন এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে তা পরিবর্তিত হচ্ছে।"
তিনি আরো বলেন, "এ কারণে বর্তমানে এলিভেশন (সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় উচ্চতা) পরিমাপ করা হয় গাণিতিকভাবে সংজ্ঞায়িত পৃথিবীর geoid থেকে। ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, geoid হচ্ছে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতার একটি মডেল। এটি একটি কাল্পনিক সমুদ্রপৃষ্ঠ, যা ব্যবহার করা হয় সারফেস এলিভেশন মাপার ক্ষেত্রে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের এই গড় উচ্চতা পর্বতের উচ্চতা মাপার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো চূড়ার উপর মধ্যাকর্ষণের প্রভাব পরিমাপের জন্য একটি উড়োজাহাজকে পর্বতের উপর দিয়ে এপাশ-ওপাশ উড়ে যেতে হয় সমান্তরাল রেখা বরাবর। এই পরিমাপ ও জিপিএস রিডিংয়ের সমন্বয়ে নির্ণয় করা হয় পর্বতের সঠিক উচ্চতা।
তাই দেখা যাচ্ছে, সব পর্বতের উচ্চতা মাপা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠের সাথে তুলনা করে। এটি করা হয় প্রধানত কনসিস্ট্যান্সি বজায় রাখার সুবিধার্থে। তবে পর্বতের উচ্চতা যদি এর বেস থেকে চূড়া পর্যন্ত মাপা হয়, তাহলে কি এভারেস্ট সর্বোচ্চ পর্বতের তলিকার শীর্ষে থাকবে?
এর উত্তর হচ্ছে- এক বিশাল "না"। এই মর্যাদা পাবে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের মাউনা কেয়া, যা একটি নিষ্ক্রিয় আগ্নেয়গিরি। যদিও এর চূড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে ১৩,৮০২ ফুট (৪,২০৫ মিটার) উঁচু, যা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের হিসেবে এভারেস্টের উচ্চতার অর্ধেকেরও কম। মাউনা কেয়া'র অধিকাংশই সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে অবস্থিত। ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে'র মতে, যদি বেস থেকে চূড়া পর্যন্ত মাপা হয় তাহলে মাউনা কেয়া'র উচ্চতা দাঁড়ায় ৩৩৪৯৭ ফুট (১০,২১১ মিটার)। এই উচ্চতা মাউন্ট এভারেস্টেরে চেয়ে বেশি। তাহলে কি আমরা মাউনা কেয়াকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত হিসেবে গণ্য করতে পারি?
অধ্যাপক মার্টিন প্রাইস এ সম্পর্কে বলেন, "এর সবকিছু নির্ভর করছে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর। যদি পৃথিবীতে কোনো সমুদ্র না থাকতো, তাহলে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হতো না। আমাদের সৌরজগতের অন্য বস্তুর সাথে তুলনা করে আপনি সর্বোচ্চ পর্বত নিধারণ করতে পারতেন, যেখানে সমুদ্র নেই।"
এদিতে আরেক প্রতিযোগী হলো ইকুয়েডরের 'মাউন্ট চিমবোরাজো', যার চূড়ার দূরত্ব পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে বেশি। এটি আন্দিজ পর্বতমালার সর্বোচ্চ পর্বত নয়। এটি এমনকি শীর্ষ ৩০ এর তালিকায়ও নেই। তবে এটি বিষুবরেখার কাছাকাছি। আর পৃথিবীর আকার ঠিক গোলাকার নয়, বিষুবরেখা বরাবর তা কিছুটা স্ফীত হয়ে আছে। পৃথিবী ঘুরতে থাকায় যে বলের সৃষ্টি হয় তার কারণে এমনটা হয়েছে। তাই পৃথিবীর পোলার রেডিয়াস (৩৯৪৯.৯০ মাইল) এবং ইকুয়াটরিয়াল রেডিয়াসের ( ৩৯৬৩.১৯ মাইল) মধ্যে ১৩.২৯ মাইল (২১.৩৯ কিলোমিটার) ব্যবধান দেখা যায়।
চিমবোরাজো বিষুবরেখার মাত্র ১ ডিগ্রি দক্ষিণে, যেখানে পৃথিবীর স্ফীতি সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চিমবোরাজোর চূড়ার দূরত্ব ৩৯৬৭ মাইল। এর মানে দাঁড়াচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে এর চূড়ার দূরত্ব এভারেস্টের চূড়ার চেয়ে ৬৭৯৮ ফুট (২০৭২ মিটার) বেশি।
সুতরাং এই তিন প্রতিযোগীর মধ্যে কোনটি সর্বোচ্চ পর্বত?
মাউন্ট এভারেস্ট হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্বত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার বিচারে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার সাথে তুলনা না করলে মাউন্ট কেয়া নিশ্চিতভাবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতের দাবিদার হতে পারে। আর পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চূড়ার দূরত্বের বিচারে চিমবোরাজো আছে শীর্ষস্থানে।
তবে যে পর্বতই আপনি বেছে নেন না কেন, সৌরজগতের সর্ববৃহৎ আগ্নেয়গিরি মার্স অলিম্পাস মোনস-এর সাথে তুলনা করলে অন্যদের উচ্চতা ম্লান হয়ে যাবে। নাসা'র মতে এর উচ্চতা ১৬ মাইল (২৫ কিলোমিটার), যা এভারেস্টের তুলনায় ৩ গুণ বেশি।
- সূত্র: লাইভ সায়েন্স