খরগোশ জন্ম দিতেন যে নারী!
অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকের কথা। মেরি টফট নামে ২৫ বছর বয়সী এক নারী দাবি করলেন, তিনি খরগোশ জন্ম দিয়েছেন। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনকে তো বটেই, এমনকি বিশ্বাস করিয়ে ছাড়লেন চিকিৎসকদেরও!
হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। রীতিমতো সমাজে প্রভাবশালী, সর্বোচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকরাও মেনে নিলেন, আসলেই খরগোশের মা হয়েছেন মেরি!
মেরির এই অভাবনীয় মাতৃত্বের খবর গোটা ইংল্যান্ডের নজরে আসে ১৭২৬ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে, যখন লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছে যায় এ খবর।
১৭২৬ সালের ১৯ নভেম্বর মিস্ট'স উইকলি জার্নালেও প্রকাশিত হয় এ নিয়ে একটি সংবাদ। সেখানে বলা হয় :
"গিল্ডফোর্ড থেকে খুবই অদ্ভুত কিন্তু সত্য বলে নিশ্চিত হওয়া একটি খবর আসছে। জন হাওয়ার্ড নামের এক প্রখ্যাত সার্জন ও পুরুষ-ধাত্রীর হাতে মাসখানেক আগে গোডালমিনে (সারেতে অবস্থিত) বাস করা এক গরিব মহিলা জন্ম দিয়েছেন খরগোশের মতো দেখতে একটি প্রাণি। হৃদপিণ্ড ও ফুসফুস জন্মালেও বাইরে থেকে সেটির পেট দৃশ্যমান নয়। এর ১৪ দিন বাদে ওই একই চিকিৎসকের হাতেই মহিলাটি একটি নিখুঁত খরগোশের জন্ম দেন। এর কয়েকদিন বাদে আরও চারটি; এবং শুক্র, শনি ও রবিবার পরপর একটি করে। কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর সবগুলো বাচ্চাই মারা গেছে।
"মহিলাটি শপথ করে বলেছেন, মাস দুয়েক আগে মাঠে অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে কাজ করার সময়, তারা একটি খরগোশ দেখতে পান। খরগোশটি তাদের দেখে দৌড়ে পালাচ্ছিল। তারাও খরগোশটিকে ধরার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। এতে করে তার মনে খরগোশটির প্রতি এমন আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয় যে গর্ভাবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং তার গর্ভপাত ঘটে। সেই থেকে তিনি খরগোশটির কথা ভুলতেই পারছেন না।
"এ বিষয়টি নিয়ে অবশ্য মানুষের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ পরম আগ্রহের সঙ্গে তাদের দেখছে, রয়্যাল সোসাইটির সামনে তাদের পেশ করার কথা ভাবছে। অন্য অনেকে আবার এ খবরে যারপরনাই নাখোশ। তারা বলছে, এ ঘটনা যদি সত্যি হয়, তাহলে এই ঘটনায় অতিসত্ত্বর যবনিকা টানতে হবে, কেননা এটি মানব প্রকৃতির অপূর্ণতার নিদর্শন।"
অর্থাৎ মেরি টফট যে খরগোশ জন্ম দেওয়ার দাবি করেছিলেন, সে দাবির শেকড় প্রোথিত ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের অপ্রমাণিত ধারণা 'ম্যাটার্নাল ইমপ্রেশন'-এ। এ ধারণা অনুযায়ী, গর্ভাবস্থায় মায়েদের মনে এক শক্তিশালী মানসিক (কখনোবা শারীরিক) প্রভাব কাজ করে, যার ফলে গর্ভের শিশুর ব্যাপারে তার মনে কোনো সামগ্রিক বা নির্দিষ্ট ছাপ পড়তে পারে। ওই ছাপই অনেক সময় বাস্তব হয়ে ধরা দেয় শিশুর মাঝে।
আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন আসলেই এ ধরনের ধারণা খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রচলিত ছিল ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের নানা জায়গায়। তারা বিশ্বাস করত, গর্ভবতী মায়ের চিন্তা-ভাবনা ও আবেগ-অনুভূতি প্রভাব ফেলবে তার গর্ভের শিশুর উপর।
তবে জনসাধারণ যা-ই মনে করুক, মেরি টফটের আজগুবি দাবিকে বিশ্বাস করে নেন এমনকি জন হাওয়ার্ড নামের এক চিকিৎসক। তিনি ছিলেন মূলত একজন প্রসূতি বিশেষজ্ঞ। অভিভূত হয়ে তিনি ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের তো বটেই, রাজা প্রথম জর্জকেও চিঠি লিখে অবহিত করেন এ ঘটনার ব্যাপারে।
রাজাও দারুণ বিস্মিত হন সেই চিঠি পেয়ে। ঘটনার রহস্য তদন্ত করতে নিজস্ব চিকিৎসক, সুইস সার্জন ও শারীরবিদ্যা বিশেষজ্ঞ নাথানিয়েল সেইন্ট আন্দ্রেকে পাঠিয়ে দেন তিনি। সেইন্ট আন্দ্রে যখন এসে পৌঁছালেন, তখন মেরি তার ১৫তম খরগোশটির জন্ম দিচ্ছেন। তাই দেখে সেইন্ট আন্দ্রে চোখ বুজে বিশ্বাস করে ফেলেন যে মেরির দাবিতে কোনো মিথ্যা নেই। ফলে তিনি মেরির কয়েকটি খরগোশ সন্তানকে সঙ্গে করে লন্ডনে রওনাও দেন - রাজা ও ওয়েলসের যুবরাজকে দেখাবেন বলে।
এরপর রাজপরিবার থেকে ঘটনা খতিয়ে দেখতে পাঠানো হয় আরেক সার্জনকে। এই সার্জন অবশ্য অন্যান্য চিকিৎসকদের চেয়ে বেশি বিচক্ষণ ছিলেন। তিনি বাচ্চা খরগোশগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পান, সেগুলোর মলে ভুট্টার অস্তিত্ব রয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়ে যায়, খরগোশগুলো আর যা-ই হোক, মেরির গর্ভে বেড়ে ওঠেনি।
তবে তাতেও কিন্তু মেরির 'জন্মদানযাত্রা' থেমে থাকেনি। খরগোশের পর তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন আরো অদ্ভুত সব বস্তু 'জন্ম' দিতে, যার মধ্যে ছিল বিড়ালের পা থেকে শুরু করে শূকরের মূত্রথলি।
এরই মধ্যে উচ্চতর গবেষণার জন্য মেরিকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে। রাখা হয় একটি বানিওতে [এক ধরনের লজিং হাউজ]। দুই মাস তাকে কঠোর পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অথচ এই সময়ের মধ্যে তাকে কোনো খরগোশ বা অন্য কিছু জন্ম দিতে দেখা যায়নি।
ওই বানিওতে বসেই শেষমেশ ফাঁস হয়ে যায় মেরির গোমর। মেরির শাশুড়ি যে বানিওর এক কর্মীকে খরগোশ সরবরাহের জন্য বলেছিলেন, জানাজানি হয়ে যায় সে কথা। এরপর একে একে আরো অনেকেই দাবি করতে থাকে, তাদেরকেও মেরি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে একই ধরনের অনুরোধ করা হয়েছিল।
এভাবে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়, মেরির জন্ম দেওয়া খরগোশ কিংবা অন্যান্য প্রাণির অংশবিশেষ আসলে অন্য কারো ধরে বা মেরে নিয়ে আসা, যেগুলোকে পরে ধাপ্পাবাজিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
এক পর্যায়ে গোটা বিষয়টি যে সাজানো, তা স্বীকার করে নেন মেরি। অবশ্য শুনতে যতটা সহজ লাগছে, ততটাও সহজ ছিল না আসলে। শোনা যায়, উপরমহল থেকে নাকি মেরির উপর চাপ দেওয়া হচ্ছিল তাকে 'অপরাধ'-এর দায় স্বীকার করতে। শেষ পর্যন্ত তাকে যখন ভয় দেখানো হয় যে কঠিন যন্ত্রণাময় সার্জারির মাধ্যমে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে, তখন মেরির সামনে নিজের দোষ মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তাই খোলা ছিল না।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক মাসের জেল হয় মেরির। এরপর তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও, প্রায়ই নতুন করে উন্মাদনা শুরু হতো তাকে নিয়ে। এদিকে এই ঘটনার পর চিকিৎসা পেশা ব্যাপকভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়। সেইন্ট আন্দ্রের এতটাই দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে যে রোগীরা তার কাছে আসা একদমই বন্ধ করে দেয়। দরিদ্র অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
খরগোশ জন্মের এই ধাপ্পাবাজি নিয়ে যুগে যুগে গবেষণা হয়েছে অনেক। কেউ গবেষণা করেছেন চিকিৎসকদের দৃষ্টিকোণ থেকে, কেউ এই ঘটনার ফলে সৃষ্ট জনপ্রতিক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু কেন মেরি টফটের মতো একজন নারী এ কাজ করলেন, সে ব্যাপারটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে খুব কমই। তবে দেরিতে হলেও সেই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করেছেন ইতিহাসবিদ এলি কথর্ন।
কথর্নের মতে, মেরির এই কাজের নেপথ্যের অনুপ্রেরণা হতে পারে নিছকই অর্থ উপার্জন। কেননা বলাই বাহুল্য, সেই অষ্টাদশ শতকেও কেউ ভাইরাল হতে পারলে নগদ নারায়ণ লাভের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হতো।
তবে এই ব্যাখ্যার একটি সমস্যা হলো, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অর্থ লেনদেনের কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি। সুতরাং মেরি ও তার পরিবারের অন্যদের এমন জালিয়াতির উদ্দেশ্য যদি হয় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া, সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। তাছাড়া তারা যদি কেবল অর্থের কথাই ভাবতেন, তাহলে ঘটনাটিকে হয়তো সাজাতেনও অন্যভাবে। গিল্ডফোর্ড ও লন্ডন দুই জায়গাতেই মেরিকে দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন অগণিত মানুষ। মেরিরা চাইলেই তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারতেন।
তাই কথর্ন চেষ্টা করেন অন্য কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার। সেটি করতে গিয়ে তিনি কিছু গোপন জবানবন্দি পেয়ে যান। সেই জবানবন্দিগুলো মেরি দিয়েছিলেন জেমস ডগলাস নামের এক চিকিৎসককে। ওই নথি পড়ে কথর্ন ধারণা করেন, মেরিকে সম্ভবত তার আশপাশের নিকটাত্মীয় নারীরা জোর করেছিলেন ভুয়া জন্মদানের গল্প সাজাতে। নারীদের ব্যাপারেই কথর্ন বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন, কেননা তখনো গর্ভাবস্থা বা সন্তান জন্মদানের প্রসঙ্গ ছিল অতিমাত্রায় নারীকেন্দ্রিক। পুরুষদের সেই আলাপে অনুপ্রবেশের কোনো সুযোগই যেন ছিল না।
মেরিকে সম্ভবত ভয়ভীতি দেখানো হয়েছিল কাজটি করতে, এবং সে কাজটি করেছিলেন তার শাশুড়িসহ অন্যান্য বয়োজ্যোষ্ঠ ও তার উপর প্রভাব রয়েছে এমন নারীরা। তাই তো মেরি নিজের চূড়ান্ত জবানবন্দিতেও একজনের নামই কেবল নিয়েছিলেন: "আমার শাশুড়িমা।"
মেরি ছিলেন একজন কমবয়সী নারী, যিনি তার স্বামীর পরিবারের সঙ্গে বাস করতেন। তাকে কেন্দ্র করে গুজবটি যখন রটতে শুরু করে, তখন সদ্যই একটি গর্ভপাতের শিকার হয়েছেন তিনি। যেহেতু তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন তার 'প্রজনন দায়িত্ব' পালনে, তাই তার আশপাশের কর্তৃত্বপরায়ণ নারীরা খুবই চটে ছিলেন তার উপর। হয়তো তাদের ক্রোধের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, এমন একটি অবাস্তব কাজে মেরিকে বাধ্য করতেও তারা দু'বার ভাবেননি।
এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, অষ্টাদশ শতকের ইংল্যান্ডের সমাজে নারীদের অবস্থা কতটা ভয়াবহ ছিল। আরো অনুমান করা যায়, তখনকার দিনে নারীরাই নারীদের উপর কেমন নির্মম ছিলেন, এবং প্রজনন সক্ষমতাকে তারা একজন নারীর অস্তিত্বের সমার্থক বলে মনে করতেন।
কথর্ন আরো বলেন, সামগ্রিক ঘটনায় মেরি এতটাই অসহায় ও নিরুপায় ছিলেন যে, তার সঙ্গে হয়ে চলা অন্যায়ের বিন্দুমাত্র প্রতিবাদও করতে পারেননি। খুব বিস্তৃত বর্ণনায় না গেলেও এ বিষয়টি সহজেই অনুধাবন করা যায়, জোর করে তার শরীরে বিভিন্ন প্রাণির অংশবিশেষ ঢুকিয়ে দেওয়া আবার বের করে আনার প্রক্রিয়া কী ভীষণ কষ্টকর ছিল। কেউই হয়তো বিশ্বাস করবে না, এসব কাজ মেরি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে করতে দিতেন।
একজন নারী খরগোশের জন্ম দিয়েছেন, এ ধরনের ঘটনা বা রটনা শুনলে প্রথমে বেশ কৌতুকবোধ করাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটির অন্তরালে এক নারীর চূড়ান্ত অসহায় অবস্থার কথা উপলব্ধি করতে পারলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে বাধ্য।