সোনার আসল টাকা, আছে রূপার টাকাও! হাতের নাগালেই টাকার জাদুঘর!
কোনো দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য দেশটির পরিচয়কে বহন করে। ইতিহাসকে জানার এবং বোঝার জন্য জাদুঘর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার 'জাদুঘরে কেন যাব' প্রবন্ধে জাদুঘরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। জাদুঘরে স্থান পায় কয়েক হাজার বছরের নিদর্শন। এসব নিদর্শন আমাদের মনে নানা প্রশ্ন এবং কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। আমরা পরিচিত হই আমাদের অদেখা এক সমাজ, সংস্কৃতির সাথে। এদিক থেকে জাদুঘরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বলা চলে। জাতীয় জাদুঘর ছাড়াও আমাদের অন্যান্য জাদুঘর রয়েছে। টাকা জাদুঘর তেমনই একটি জাদুঘর। এখানে সংরক্ষিত আছে উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা। রয়েছে সুলতানদের আসল স্বর্ণমুদ্রা এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুদ্রাসমূহ। বর্তমানে জাদুঘরটিতে প্রায় ২০০টি দেশের ধাতব, কাগুজে, পলিমার এবং হাইব্রিড মুদ্রা সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির প্রবেশমুখের দেয়ালে ধাতব এবং কাগুজে নোটের আদলে 'টাকার গাছ' স্থাপিত হয়েছে। শিল্পী যেন 'টাকা কি গাছে ধরে' প্রবাদটি আক্ষরিক অর্থেই দেখাতে চেয়েছেন। আসলে এটি স্টিল দিয়ে তৈরী করা একটি রেপ্লিকা। জাদুঘরের বাইরের দেয়ালে আরেকটি পোড়ামাটির ফলক তৈরি করা হয়েছে। শিল্পী হাশেম খান, শ্যামল চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান এবং মুকুল মুৎসুদ্দী'র তৈরী করা নান্দনিক এই পোড়া মাটির ফলকের নাম 'বিনিময়'। কড়ি, মুদ্রা ভর্তি কলস এবং ধাতব মুদ্রা দিয়ে তৈরিকৃত ফলকটি যেন মুদ্রা বিনিময়ের বিভিন্ন ধাপের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা
টাকা জাদুঘরে প্রাচীন আমলের বিনিময় দ্রব্য থেকে শুরু করে আজকের কাগুজের নোটগুলো সংরক্ষিত আছে। তবে, ছাপাঙ্কিত রৌপ্য এবং সুলতানী আমলের স্বর্ণ মুদ্রাই যেন টাকা জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণ। Punched mark coins বা ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রাকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বিনিময় মুদ্রা হিসাবে গণ্য করা হয়। টাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এমন যেকোন মুদ্রার চাইতে ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রাগুলো পুরাতন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দুই প্রকারের ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে। এগুলো আঞ্চলিক মুদ্রা এবং রাজকীয় মুদ্রা। আঞ্চলিক মুদ্রাগুলো জনপদ মুদ্রা নামেও পরিচিত। সাধারণ জনগণ নিত্যপ্রয়োজনে এসব ব্যবহার করতেন। জনপদ মুদ্রাগুলো উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া যায়। এসব মুদ্রায় চাঁদ, সূর্য, মাছ, চতুষ্পদ জন্তু, কবুতরের মুখ, ডিম্বাকৃতির বন্ধনে কাঁকড়াবিছা, চিংড়ি, শাখাহীন পত্র, বাঁশ, নৌকার নোঙর, নানা আকৃতির নৌকা, বিন বাজানোর বাঁশি, ছুরি ইত্যাদির ছাপ লক্ষণীয়। কিছু মুদ্রার উভয় পার্শ্বেই এসব প্রতীকের ছাপ রয়েছে। রাজকীয় মুদ্রাগুলো বগুড়ার মহাস্থানগড়, নাটোর, বাঈগাছা প্রভৃতি অঞ্চলে প্রত্নতত্ত্ব খননের সময় পাওয়া যায়। প্রাপ্ত মুদ্রার একপাশে চারটি করে প্রতীক ছিল। এদের মধ্যে ছয়টি মুদ্রা গোলাকার, বাকিগুলোর আকৃতি অনিয়মিত। বর্তমানে টাকা জাদুঘরে বিভিন্ন আকৃতির মোট ৫৬টি ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা সংরক্ষিত রয়েছে।
প্রত্নতাত্বিকদের মতে, এসব রৌপ্য মুদ্রা মৌর্য সাম্রাজ্যে ব্যবহৃত হতো। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মৌর্য সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। পাটলীপুত্রের রাজাকে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতবর্ষে মৌর্য শাসনের সূচনা করেন। এরপর তিনি কৌটিল্যের সহযোগিতায় সেখান থেকে গ্রীকদের বিতারিত করেন। তার সময়ে রাজ্যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে মৌর্যদের পতন হলে এসব ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া, নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলের হরিকেল জনপদে রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহৃত হতো। তবে, এখান থেকে প্রাপ্ত মুদ্রাগুলো ছাপাঙ্কিত ছিল না।
স্বর্ণ মুদ্রা
জাদুঘরে সংরক্ষিত অধিকাংশ স্বর্ণমুদ্রাই দিল্লির সুলতানদের আমলের। টাকা জাদুঘরে প্রদর্শিত স্বর্ণ মুদ্রাগুলো কোনো রেপ্লিকা নয়। একেবারে আসল স্বর্ণ মুদ্রাই দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে। সুলতানী শাসকদের আমলে প্রচলিত স্বর্ণ এবং রৌপ্যের কিছু মুদ্রা এখানে সংরক্ষিত আছে। গিয়াসউদ্দীন তুঘলক, আলাউদ্দিন খিলজি প্রমুখ শাসকগণ দিল্লি থেকে এসব মুদ্রা প্রচলন করেন। এসব মুদ্রার বিশেষত্ব হচ্ছে, মুদ্রার গায়ে আরবি কালাম, তৎকালীন খলিফার নাম, মুদ্রা জারি কারী সুলতানের নাম, মুদ্রা জারির সাল, শাসনকাল ইত্যাদি অঙ্কিত থাকতো।
জাদুঘরের সংগ্রহে কুষাণ জনগণের ব্যবহৃত স্বর্ণ মুদ্রাও আছে। এসব মুদ্রাগুলো গোলাকার, মুদ্রার একপাশে কুষাণ রাজাদের পোর্ট্রেট। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কুষানদের ব্যবহৃত রৌপ্য এবং তাম্র মুদ্রাও পাওয়া গেছে।
বিদেশী মুদ্রাসমূহ
জাদুঘরের তৃতীয় তলায় বিদেশী মুদ্রাগুলো রাখা হয়েছে। এখানের দুটি গ্যালারির একটিতে মূলত বিভিন্ন দেশের নতুন এবং পুরাতন কাগুজে নোটগুলো স্থান পেয়েছে। আরেকটিতে ধাতব মুদ্রাসমূহ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে বিভিন্ন মেয়াদে চালু হওয়া নোটগুলো এখানে রাখা হয়েছে। এন্টার্কটিকা এবং ওশেনিয়া মহাদেশের মুদ্রাও আছে টাকা জাদুঘরে। এশিয়াসহ অন্য মহাদেশের মুদ্রাগুলো চতুর্থ গ্যালারিতে সংরক্ষিত। প্রাচীনকালে মুদ্রা দিয়ে বিভিন্ন অলঙ্কার তৈরী করা হতো। টাকা জাদুঘরে মুদ্রার পাশাপাশি এসব অলঙ্কারও সংরক্ষিত আছে।
স্মারক মুদ্রা ও স্যুভেনির শপ
দ্বিতীয় গ্যালারিতে আছে বিভিন্ন দেশের স্মারক মুদ্রা। কোনো ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই নোটগুলো ছাপানো হয়। প্রায় ১২০টি দেশের মুদ্রা সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানে। জাদুঘরে অন্তত তিনটি শোকেস আছে, যেখানে স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত হওয়া ২ টাকা, ১০০ টাকা এবং ৫০০ টাকার নোট সংরক্ষিত। জাদুঘরে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্মারক মুদ্রাও স্থান পেয়েছে। সাধারণত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত এসব স্মারক মুদ্রার কোনো বিনিময় বা বাজারমূল্য নেই। জাদুঘরে আপনি ৪০, ৬০, ৭০, ৮০, ৪০০ ইত্যাদি মূল্যের মুদ্রা দেখতে পাবেন। গুরুত্বপূর্ণ স্মারক মুদ্রাগুলোর মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০০০, বাংলাদেশ আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ- ২০১১, কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছর-২০১১ ইত্যাদি। কাগুজে নোটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর-২০১২, জাতীয় জাদুঘরের ১০০ বছর পূর্তি-২০১৩ ইত্যাদি। স্মারক নোটগুলো জাদুঘরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
টাকা জাদুঘরে একটি স্যুভেনির শপ স্থাপন করা হয়েছে। এখানে জাদুঘরের স্মারক মুদ্রা, স্মারক নোট, স্যুভেনির দ্রব্য, জাদুঘরের বিভিন্ন প্রকাশনা ক্রয় করা যায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০০০ উপলক্ষ্যে সর্বোচ্চ মূল্যের স্মারক মুদ্রাটি তৈরী করা হয়েছিল। একজন দর্শনার্থী মাত্র ৬৬ হাজার টাকা খরচ করে স্বর্ণের তৈরী এই স্মারক মুদ্রাটি কিনতে পারবেন।
জাদুঘরকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে পূর্ণতা দিতে কার্পণ্য করা হয়নি। এখানে রয়েছে ডিজিটাল সাইনেজ, ডিজিটাল কিয়স্ক, এলইডি টিভি, ফটো কিয়স্ক ইত্যাদি। ডিজিটাল সাইনেজের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি জাদুঘরের কার্যক্রমকে একনজরে দেখে নিতে পারেন। এখানে মুদ্রা এবং তার ইতিহাসকে ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে ধারণ করা আছে। সবগুলোতেই স্ক্রিনটাচ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে।
জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো 'ফটো কিয়স্ক'। এর মাধ্যমে দর্শনার্থীরা পছন্দের নোটে তাদের আবক্ষ ছবি তোলার সুযোগ পাবেন। মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে দর্শনার্থীরা টাকা জাদুঘর ভ্রমণের মুহূর্তকে বন্দি করতে পারেন। এখানে সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকার নোট ব্যবহার করে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে। তবে এটিও স্মারক নোটের মতোই বিনিময় অযোগ্য। কেবলমাত্র দর্শকদের আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে ফটো কিয়স্কগুলো রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও বিশ্বের মুদ্রার ইতিহাস সংরক্ষণ, মুদ্রার ঐতিহ্য এবং বিকাশকে সাধারণ্যে তুলে ধরার লক্ষ্যে বাংলাদেশ টাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি ঢাকার মিরপুর ২নং সেকশনে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কারেন্সি মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়। পরে এটির আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত একটি জাদুঘর তৈরী করার প্রস্তাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে টাকা জাদুঘর যাত্রা শুরু করে। টাকা জাদুঘরে প্রতিদিন প্রায় ২০০ দর্শনার্থী ভিড় করেন। জাদুঘরে যেতে হলে দর্শনার্থীকে নাম, ঠিকানা রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তবে, টাকা জাদুঘরে কোনো প্রবেশমূল্য নেয়া হয় না।