প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট কোথা থেকে আসে এবং কেন এটি পরিবেশ ও জ্বালানির জন্য জরুরী?
সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই আবিষ্কার বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
শুধু বাংলাদেশ না, বৈশ্বিকভাবেই প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেটের মজুদ এতো বেশি যে তা কার্বন চক্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোর জন্যও এ গ্যাস হাইড্রেট একটি জ্বালানি-সেতু হয়ে উঠতে পারে।
গ্যাস হাইড্রেট এবং এর আহরণ সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরাও অন্ধকারে ছিলেন এতদিন। তবে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো থেকে গ্যাস হাইড্রেট কীভাবে প্রকৃতিতে জমা হয় সে ব্যাপারে নতুন অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যাচ্ছে।
রিভিউস অব জিওফিজিক্সের সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে গত দুই দশক ধরে গ্যাস (মিথেন) হাইড্রেটকে নিয়ে হওয়া গবেষণাগুলো মূল্যায়ন করা হয়েছে। নিবন্ধে এই খাতে আরও গবেষণা পরিচালনা করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ নিবন্ধ অনুসারে গ্যাস হাইড্রেট সম্বন্ধে কিছু জরুরী প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো এই প্রতিবেদনে-
প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট কী এবং এটি কোথায় পাওয়া যায়?
গ্যাস হাইড্রেট একটি বরফের মতো কঠিন পদার্থ যা পানি ও গ্যাস (মূলত মিথেন) দ্বারা গঠিত। এরা কেবল উচ্চ চাপ এবং নিম্ন তাপমাত্রায় জন্ম নিতে পারে। পানি ও গ্যাসের আধিক্য আছে এমন জায়গায় জন্ম নেয় এরা। তাপমাত্রা ও চাপে হালকা পরিবর্তন হলেই তা গ্যাস হাইড্রেটকে আবার পানি ও গ্যাসে আলাদা করে দিতে পারে।
এ কারণে কৃত্রিমভাবে গ্যাস হাইড্রেট তৈরি করা বা অধ্যয়ন করাটা অনেক কষ্টসাধ্য। তবে প্রকৃতিতে এমন অবস্থা বেশ অহরহ। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীর মহাদেশীয় প্রান্ত বরাবর পলি স্তরের মধ্যে এবং আর্কটিক পারমাফ্রস্টের ভেতর ও নিচে অনেক গ্যাস হাইড্রেটের মজুদ রয়েছে।
আমাদের পরিবেশে গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি এবং আচরণ আরও ভালভাবে বুঝাটা কেন জরুরী?
প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট কার্বন চক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসব গ্যাস হাইড্রেট পৃথিবীর মোট জৈব কার্বনের ৫ থেকে ২২ শতাংশ ধারণ করে বলে মনে করা হচ্ছে।
মিথেন নিজেই একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস, যার উষ্ণায়ন ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ৪০ গুণ বেশি। বড় বড় প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট ক্ষেত্র থেকে নিঃসৃত হওয়া মিথেন জলবায়ু পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে।
মিথেন হাইড্রেটে প্রচুর জ্বালানি মজুদ থাকে। হিমায়িত মিথেন হাইড্রেটের প্রতিটি ইউনিট ১৬৪ ইউনিট প্রাকৃতিক গ্যাস তৈরি করতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রকৃতিতে মিথেন হাইড্রেটের মজুদ অনেক। যার মানে সবচেয়ে বড় অপ্রচলিত শক্তির উৎসগুলোর মধ্যে একটি এটি। এবং এই মিথেন হাইড্রেট অপরিশোধিত তেল বা কয়লার চেয়ে অনেক বেশি পরিবেশ-বান্ধব।
শুধুমাত্র মেক্সিকো উপসাগরে থাকা মিথেন হাইড্রেটের মজুদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কয়েকশ বছর প্রাকৃতিক গ্যাসের জ্বালানি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
গ্যাস হাইড্রেটের মজুদগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করার সর্বোত্তম উপায় কী?
প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট আবিষ্কারের স্থান, তাদের গঠন এবং আকৃতির বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে এদেরকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলা যেতে পারে।
যেকোনো মহাদেশের প্রান্তিক অঞ্চলে সমুদ্রতলের কয়েকশ মিটার নিচেই কম ঘনত্বের গ্যাস পাওয়া যায়। সমুদ্রতলের কর্দমাক্ত পলির খণ্ডগুলো খনন করলে এর অতিক্ষুদ্র ছিদ্রগুলোতে মিথেন হাইড্রেট পাওয়া যাবে।
এমনকি সমুদ্রতলের সাথে গভীর উপতলের সংযোগকারী বড় ফাটলগুলোতেও গ্যাস হাইড্রেট জমা থাকতে পারে। সমুদ্রতলে ভেন্ট সাইটগুলোর ফাটল থেকেও মিথেন গ্যাস বেরিয়ে আসে অনেক সময়। সাধারণত এই গ্যাস বুদবুদ আকারে বের হয়ে পানিতে মিলিয়ে যায়।
তবে, বেশি ঘনত্বের গ্যাস হাইড্রেট পাওয়া যায় বালুকাময় পলিতে।
গ্যাস হাইড্রেটকে নিয়ে অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো কী কী?
বেশিরভাগ প্রাকৃতিক হাইড্রেটের মিথেন জীবাণুর জৈবজনন (বায়োজেনেসিস) থেকে আসে। কারণ অণুজীবগুলো সাধারণত পলিতে থাকা জৈব কার্বন গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণা এখনও বিকশিত হচ্ছে। কোন অবস্থায় এবং কত দ্রুত অণুজীবগুলো মিথেন উৎপন্ন করতে পারে? এর বেশিরভাগই কি ঠাণ্ডা, অগভীর, কর্দমাক্ত পলি বা সমুদ্রপৃষ্ঠের গভীরে ঘটে? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও জানে না বিজ্ঞানীরা।
এসব প্রশ্নের উত্তর জানাটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বায়োজেনিক গ্যাস ইতোমধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তির উৎস হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসরায়েলের উপকূলের কাছে পাওয়া বায়োজেনিক গ্যাস ক্ষেত্র, লেভিয়াথান সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, এটি কয়েকশ বছর ইসরায়েলের জ্বালানি খাতে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটাতে পারবে।
গত বছর এখান থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের জ্বালানি খাতই পুরোপুরি বদলে গেছে।
তবে মিথেন হাইড্রেট কোনো দেশের জ্বালানি খাতকে এভাবে পরিবর্তন করে দিবে, সে সম্ভাবনা এখনও ক্ষীণ। কেননা, এই জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনও নিশ্চিত না বিজ্ঞানীরা।
মিশ্র গ্যাসগুলো কীভাবে হাইড্রেটের সাথে জমা হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়, এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা আমাদের। গ্যাস হাইড্রেটকে নিয়ে অনেক দেশেই জরিপ চলছে। বঙ্গোপসাগরে যে গ্যাস হাইড্রেটের উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে, এরকম হাইড্রেটের মজুদ বিশ্বের প্রায় সামুদ্রিক এলাকাতেই পাওয়া যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, জরিপ শেষে এসব মজুদ থেকে কার্যকরভাবে জ্বালানি আহরণ আদৌ সম্ভব হবে কি না। সম্ভব হলে পৃথিবীর কার্বন চক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের পাঠোদ্ধার করতে পারব আমরা, যা জলবায়ু পরিবর্তন, ভূ-ঝুঁকি এবং জ্বালানি নিরাপত্তার মতো সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সূত্র: ইওস।