অনেকের শৈশব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে নারায়ণ দেবনাথ ছাড়া
হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে-ফন্টে—এই নামগুলোর সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন বাঙালি পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দুর্দান্ত জনপ্রিয় এই চরিত্রগুলোর জনক, কিংবদন্তি কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথ ৯৬ বসন্ত পার করে সাতানব্বইয়ে পা দিলেন ২৫ নভেম্বর।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ। কানে কম শোনেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে এখন একটু জোরে কথা বলতে হয়। চেনা মানুষকে চিনতেও সময় নেন অনেক। তুলি-কলম-কালিতে একের পর এক জনপ্রিয় চরিত্র ফুটিয়ে তোলার পর আঁকাআঁকি করছেন না বছর তিনেক হয়। আজকাল কথাও বলতে পারেন না খুব একটা, বেশ কিছুদিন ধরেই ভুগছেন নানা রোগ-ব্যাধিতে। বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না।
ব্যক্তি নারায়ণ দেবনাথ আজ জরার কাছে কাবু হয়ে পড়েছেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠলেও, তিনি নিজে প্রচারের আলোয় আসেননি কখনোই। আর শেষ বয়সে এসে বাধ্য হয়েছেন একাধিক প্রকাশকের সঙ্গে কপিরাইট নিয়ে আইনি মামলায় জড়াতে। নারায়ণ দেবনাথের বই বিক্রি করে কিছু প্রকাশক বিস্তর মুনাফা করেছে, কিন্তু তিনি প্রাপ্য টাকা পাননি।
অথচ তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে নির্মল আনন্দে ভাসিয়েছে বাঙালিকে। এই দস্যি চরিত্রগুলোর কথা মাথায় আসত কী করে—এ প্রশ্নের জবাবে এক সাক্ষাৎকারে এই কিংবদন্তি বলেছিলেন, 'যেমন গল্পকাররা গল্প ভাবে, ঠিক সেরকমই আমার মাথায় এসেছিল। অত কিছু ভেবে তো লিখিনি। প্রথমে নন্টে-ফন্টে, তারপর বোর্ডিং, তারপর সুপারিনটেনডেন্ট, এদের নিয়ে গল্প তৈরি আর এদের নিয়েই কাহিনি।'
হাঁদা-ভোঁদা সিরিজ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। আবির্ভাবেই দুই বিচ্ছু বাঙালি ছেলে মন কেড়ে নেয় সর্বস্তরের পাঠকের। সাধারণ বাঙালির নিত্যদিনের জীবন থেকে নেওয়া বলেই বোধহয় ওদের গল্পগুলো এমন অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নারায়ণ দেবনাথের নিজের স্বীকারোক্তিতে, 'হ্যাঁ, তা ওই আমার পাড়ার মোড়ের ছেলেদের, যারা ছোটবেলায় সব খেলাধুলা করত, দুষ্টুমি করত, যা হয়, বাচ্চারা যা করে আরকি! ওই...ওইটা দেখেই আঁকতাম। যখন আমার কাছে প্রস্তাব এল, তখন ওই সমস্ত ঘটনাগুলোকেই গল্পাকারে সাজিয়ে ছবি এঁকে দিলাম। হয়ে গেল আরকি!'
নারায়ন দেবনাথের বাবা-কাকার সোনার দোকান ছিল পাড়ার মোড়ে। সেই দোকানে মাঝেমধ্যেই যেতেন তিনি। আর সেখানেই পাড়ার রকে দুষ্টুমি করত ছেলেমেয়েরা। সেসব দুষ্টুমি থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে হাঁদা-ভোঁদার কাণ্ডকারখানা লেখেন তিনি।
এরপর ১৯৬৫ সালে নারায়ণ দেবনাথ পরিকল্পনা করেন বাঁটুল দি গ্রেট-এর। ঘরোয়া সুপারহিরো বাঁটুলের গায়ে অসুরের শক্তি, তার আড়ালে লুকিয়ে আছে খুব কোমল একটা মন। আর নন্টে-ফন্টের আবির্ভাব ১৯৬৯ সালে।
তিনি যখন আঁকাআঁকি শুরু করেন, তখন কমিকসে আলাদা করে লেখকের নাম দেওয়ার চল শুরু হয়নি। কমিকস শিল্পীদেরও নামেমাত্র সম্মানী দেওয়া হতো। হাঁদা-ভোঁদা পত্রিকায় ছাপা হলে শিল্পীর নামই উল্লেখ থাকত না কমিকসে। নারায়ণ দেবনাথের নাম জানা যেত কমিকসের শেষে তাঁর একটা সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর থেকে।
হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টের মতো জনপ্রিয় চরিত্রগুলো ছাড়াও আরও অনেক চরিত্রের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু', 'বাহাদুর বেড়াল', 'পটলচাঁদ দ্য ম্যাজিশিয়ান', 'পেটুক মাস্টার বটুকলাল' প্রভৃতি। তবে এসবের বাইরেও গোয়েন্দা কৌশিক রায়ের মতো চরিত্রকে নিয়ে লিখেছেন গ্রাফিক গোয়েন্দা উপন্যাসও।
নারায়ণ দেবনাথের জন্ম শিবপুরে। ছেলেবেলা থেকেই ভালো কোনো ছবি দেখলেই কপি করতে বসে যেতেন। চল্লিশের দশকে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টস পেইন্টিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। শুরুর দিকে হরফশিল্পী হিসেবে তেল, পাউডার, সিঁদুর, আলতার লেবেল, সিনেমায় দেখানো ফিল্ম-স্লাইড লেখার কাজ করেছেন।
নারায়ণ দেবনাথের আত্মপ্রকাশ কিন্তু কমিকস শিল্পী হিসেবে নয়, অলংকরণ শিল্পী হিসেবে। বই-পত্রিকার পাতায়, প্রচ্ছদে, গল্প উপন্যাসে তাঁর বাস্তবসম্মত ইলাস্ট্রেশনে মুগ্ধ হয়েছেন অসংখ্য বাঙালি পাঠক। কিন্তু একসময় কমিকসের কাজে জড়িয়ে পড়ায় ইলাস্ট্রেশনের কাজ থেকে সরে এলেন।
কিন্তু নারায়ণ দেবনাথ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে অনেকবার স্বীকার করেছেন, কমিকস শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেলেও তাঁর বরাবরই পছন্দ ছিল সিরিয়াস ইলাস্ট্রেশন। তাঁর হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে আফ্রিকার গহন জঙ্গল, 'আঙ্কল টমস কেবিন' থেকে শুরু করে 'গালিভার্স ট্রাভেলস'-এর মতো বিশ্ব ক্লাসিক, এমনকি সুকুমার রায়ের 'আবোল তাবোল', 'পাগলা দাশু'ও।
তবে তিনি যে আজীবন কেবলই বাচ্চাকাচ্চাদের কমিকস বানিয়ে গেছেন, তা নয়। এই মহান শিল্পীর হাত থেকে বেরিয়েছে একের পর এক অ্যাডভেঞ্চার বা গোয়েন্দা কমিকসও। ব্ল্যাক ডায়মন্ড, গোয়েন্দা কৌশিক তেমনই কিছু সৃষ্টি।
আজীবন নিরলস কাজের স্বীকৃতি হিসেবে নারায়ণ দেবনাথ শেষ জীবনে এসে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। রবীন্দ্রভারতী তাঁকে দিয়েছে ডি'লিট।
কমিকসকে সাহিত্য বলতে নারাজ অনেক বোদ্ধাই। কিন্তু একে সাহিত্য বলা যাক বা না যাক, নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্ট চরিত্ররা যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আপামর পাঠককে বিমলানন্দে ভাসিয়েছে, তা তো আর মিথ্যে হয়ে যায়নি। নারায়ণ দেবনাথ নামটা আজ হয়ে উঠেছে বাংলা কমিকসের সমার্থক। আর তাঁর অবদানের কথা হয়তো উপলব্ধি করতে পেরে অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই ভারত সরকার ২০২১ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দিয়ে নিজেই সম্মানিত হয়েছে।
নারায়ণ দেবনাথ নামটা আজীবন জ্বলজ্বল করবে বাঙালি পাঠকের মনে। দূর ভবিষ্যতে কোনো বাংলা কমিকস পড়ে যখন কিশোর পাঠকের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠবে হাসির রেখা, তার মনের কোণে ঠিকই উঁকি দেবে এই মহান শিল্পীর নাম। তাঁকে ছাড়া যে বাংলা কমিকসের ইতিহাসটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।