মোহাম্মদ আলি যেভাবে বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের আইকন হয়ে ওঠেন
১৭ জানুয়ারি ছিল দ্য গ্রেটেস্ট মোহাম্মদ আলির জন্মদিন। মহান এই ক্রীড়াবিদ ছিলেন বিপ্লবেরই নামান্তর। গোটা ক্রীড়াজগতেই পরিবর্তনের হাওয়া বইয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
আজীবন লড়ে গেছেন নিপীড়িতদের পক্ষে। বর্ণবাদের চিরকালই বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। নিজেও ছিলেন বর্ণবাদের শিকার। এমনকি অলিম্পিক পদক জিতে যখন সুপারস্টার হয়ে উঠেছেন, তখনও বর্ণবাদ থেকে রেহাই পাননি আলি।
আত্মজীবনীতে আলি বলেছেন, একবার এক রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানকার ওয়েটাররা কৃষ্ণাঙ্গ আলিকে খাবার পরিবেশনে অসম্মতি জানায়। রাগে-ক্ষোভে নিজের একমাত্র অলিম্পিক পদকটি ওহাইয়ো নদীতে ফেলে দেন আলি!
মোহাম্মদ আলি ওরফে ক্যাসিয়াস মার্কেলাস ক্লে জুনিয়র-এর জন্ম ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকির লুইসভিলে। তার নাম রাখা হয়েছিল দাসপ্রথাবিরোধী রিপাবলিক রাজনৈতিক নেতা ক্যাসিয়াস ক্লে-র নামানুসারে।
আলির বক্সার হওয়ার গল্পটা চমকপ্রদ। ছোটবেলায় একবার তার সাইকেল চুরি যায়। পুলিশ চোরকে আটক করার পর ইন্সপেক্টর মার্টিনকে এক অদ্ভুত অনুরোধ করে বালক আলি। আবদার ধরে, চোরকে পেটাবে সে। আলির আবদার শুনে মার্টিন বলেন, চোরকে পেটাতে হলে ওকে লড়াই করা শিখতে হবে। পুলিশের চাকরির পাশাপাশি মার্টিন বক্সিং কোচও ছিলেন। এই মার্টিনের হাতেই শুরু হয় আলির বক্সিং শিক্ষা।
এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার গল্প। ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে মাত্র আঠারো বছর বয়সে আলি জিতে নেন স্বর্ণপদক। ম্যাচের সময় আলি কখনোই বাকিদের মতো মুখের সামনে হাত রাখতেন না। আর তার ঘুসি খেলে মনে হতো মৌমাছি হুল ফোটাল যেন। এরপ ১৯৬৫ সালে সর্বকনিষ্ঠ বক্সার হিসেবে প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন আলি।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নানা সময় নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে দ্য গ্রেটেস্টকে। নির্ভীক এই অ্যাথলেট রুখে দাঁড়িয়েছেন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। আমেরিকান আর্মির পক্ষ থেকে তাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই আদেশ প্রত্যাখান করায় ১৯৬৭ সালে বক্সিং থেকে ৩ বছর নিষিদ্ধ হন আলি। ৫ বছরের কারাদণ্ড পান। তবে চার বছর কারাভোগের পর ১৯৭০ সালে মুক্তি পান তিনি। খেলায় ফেরেন।
ক্রীড়াজীবন থেকেই নানা দাতব্য কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আলি। মানবদরদি এই অ্যাথলেট দাতব্য কাজ চালিয়ে গেছেন আমৃত্যু।
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের আমেরিকায় 'কালোদের ক্ষমতায়নে'র সূচনা হয় অনেকটা আলির হাত ধরেই। ১৯৬৮ সালে 'সে ইট লাউড—আয়্যাম ব্ল্যাক অ্যান্ড আয়্যাম প্রাউড' স্লোগান দিয়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন জেমস ব্রাউন। তবে তার চার বছর আগেই এই স্লোগানের শরীরী প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন আলি। তিনি হয়ে ওঠেন 'জনমানুষের চ্যাম্পিয়ন'।
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আলির লড়াই শুরু হয় যৌবনের শুরুতেই। ১৯৬৪ সালে লিস্টনকে হারিয়ে নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আলি ঘোষণা দেন, তিনি তার 'ক্রীতদাস নাম' ক্যাসিয়াস ক্লে পালটে মোহাম্মদ আলি নাম নিচ্ছেন।
এর পরের বছরগুলোতে অন্যায় ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদের মাধ্যমে সাধারণ বক্সিং চ্যাম্পিয়ন থেকে হয়ে ওঠেন আপামর জনতার চ্যাম্পিয়ন, নায়ক।
জনসাধারণের চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলি ক্লে মৃত্যুবরণ করেন ২০১৬ সালের ৩ জুন। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক বর্ণিল, বিপ্লবী অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।