নারীদের নিয়ে অশ্লীল গালি বন্ধ করাই সুনীল জাগলানের মিশন
জানুয়ারির এক শীতের বিকেল। উত্তর ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের শর্মাতলা গ্রামের মহিলারা একটি সরকারি নার্সারির বারান্দায় জড়ো হয়েছেন। আগ্রহভরে বক্তার কথা শুনতে মেঝেতেই বসে আছেন তারা। তাদের অদূরেই দাঁড়িয়ে গ্রামের পুরুষ এবং যুবকেরা। তারা মহিলাদের সাথে বসতে অনিচ্ছুক। সমাজকর্মী সত্যপ্রকাশ তাদেরকে চেয়ারে বসার অনুরোধ করছেন। বয়স্ক একজনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ''চাচা, বসে পড়ুন, আজকের আলোচনা 'গালি দেওয়া' নিয়ে''।
প্রধান বক্তা- সুনীল জাগলান। তিনি একজন ভারতীয় নারী অধিকারকর্মী। আলোচনার শুরুতেই সবার উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন করলেন তিনি। প্রশ্নটি এমন, ''আপনাদের মধ্যে কেউ কি মা, বোন বা নারী দেহের কোনো অঙ্গ নিয়ে কটূক্তিমূলক শব্দ ব্যবহার করেন? যদি করে থাকেন, তবে আপনার হাত উঁচু করুন''।
লোকজন তাদের হাত তোলার আগে এদিক-সেদিকে কিছুক্ষণ তাকাচ্ছিল। এরকম পরিস্থিতিতে স্বভাবতই নৈতিক সমর্থনের জন্য মানুষ চারপাশে তাকায়। শেষে একজন বললো, ''এখানে সবাই গালাগালি করে। এটা স্বাভাবিক''। একজন মহিলা পাঁচ বছরের শিশুর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ''এমনকি এই বাচ্চাটিও গালি দিতে জানে''।
এরপর জাগলান সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখলেন, ''এভাবে গালি দেয়াটা কি ঠিক?''
সাথে সাথেই উপস্থিত নারীরা উচ্চস্বরে বললেন, ''অবশ্যই না! গালি দেয়ার সময় কেন আমাদেরকে অথবা আমাদের শরীরকে টার্গেট করবেন? তারা আরও বলেন, 'লোকেরা কেন বোঝে না, যখন তারা অশ্লীল গালি দেয়, তারা আসলে তাদের নিজেদের মা-বোনদেরই লখ্যবস্তু করে? এটাই কি- আমরা আমাদের বাচ্চাদের শেখাচ্ছি!''
ভারতে অঞ্চলভেদে গালির শব্দগুলি ভিন্ন। তবে, গালিতে ব্যবহৃত শব্দাবলীতে নারীকে উপহাস করা, লজ্জা বা হুমকি দেয়ার বিষয়টি যেন সর্ব-সাধারণে প্রচলিত। ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারার অধীনে, জনসমক্ষে অশ্লীল কাজ, গান বা শব্দের জন্য দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের তিন মাস পর্যন্ত জেল হতে পারে। কিন্তু অনেক মানুষ আছেন, যারা আইন সম্পর্কে মোটেই অবগত নন।
সেদিনের আলোচনা শেষে সবাই সমস্বরে বলে ওঠেন, 'আমরা আর কখনো (নারীকে নিয়ে) গালি দেব না'।
জাগলনের এই যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল বিবিপুর গ্রামে। এখানেই তিনি বড় হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা কালে ২০১০ সালে তিনি গ্রামপ্রধান পদে নির্বাচন করার জন্য নিজ গ্রামে ফিরে আসেন।
হরিয়ানায় গালিতে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করা খুবই সাধারণ ব্যাপার। জাগলান বলেন, 'যখন কলেজে পড়তাম, অতসব চিন্তা না করে আমিও গালি দিতাম। একদিন এক বন্ধুকে একটি শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করলাম। এরপরেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এসব গালিতে ব্যবহৃত শব্দাবলী কতটা জঘন্য"।
২০১৪ সালে বিবিপুরের মহিলাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে, এসব 'অশ্লীল ভাষা পর্যবেক্ষণ ও নিয়নন্ত্রণ' করার জন্য তিনি একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। শিশুরা গালি দিলে, তাদের পিতামাতাকে পঞ্চায়েতের (নির্বাচিত জেলা কর্মকর্তা) কাছে পাঠানো হতো। পঞ্চায়েত পরিবারগুলিকে এসব বিষয়ে সতর্ক করে দিত।
জাগলান নারী ক্ষমতায়নের জন্য 'সেলফি উইথ ডটার' নামক একটি প্রচার অভিযানের প্রতিষ্ঠাতা। তিন বছর পরে তিনি তালোদা গ্রামে 'গালিমুক্ত ঘর' (কোন গালি নেই এমন গ্রাম) চালু করেন। এটি একটি গ্রামের এমন অবস্থাকে নির্দেশ করে যেখানে যেকোনো প্রকারের গালি দেয়া নিষিদ্ধ। কোনো একটি সম্প্রদায় অশ্লীল শব্দ ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলে তাকে গালিমুক্ত গ্রাম হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। গ্রাম প্রধানদের দ্বারা নথিভুক্ত পরিবারের জন্যও অনুরূপ উপাধি দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
জগলান তখন থেকেই বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে 'গালি-বন্ধ বা গালিমুক্ত গ্রাম' শব্দটি ছড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে, দ্রুত সমর্থন অর্জন করছেন সেসব নারীদের থেকে যাদেরকে এধরণের অশ্লীল শব্দের মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত।
এরকম একটি পদক্ষেপের পরে, একবার তালোদা গ্রামের ছয়জন মহিলা চারজন পুরুষের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করেন। পরবর্তীতে পুলিশ কর্মকর্তা, গ্রামপ্রধান এবং গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে দোষী পুরুষেরা প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার পরে এবং ভবিষ্যতে কখনও মহিলাদের অসম্মান বা এই ধরনের গালি না দেয়ার শর্তে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছিল।
তালোদার গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান মদন লাল বলেন, "এই বিষয়ে প্রচারণা শুধু পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেই নারীদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছে তা নয়। বরং, যে কেউ তাদের সাথে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করলে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিতও করেছে''।
হরিয়ানাবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রায় ৮০০টি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রচার কর্মসূচি চালু রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অভিযোগগুলি স্থানীয় গ্রুপে রিপোর্ট করা হয়। এই গ্রুপের প্রধান হিসাবে সাধারণত একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বা সেনা কর্মকর্তা হয়ে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে হোয়াটসঅ্যাপ নির্দিষ্ট গ্রুপে অভিযোগ জানানো হয়। অভিযুক্তকে একজন কাউন্সিলরের কাছে পাঠানো হয়। জাগলানের সংস্থা ২০০০ মহিলা এবং ১০০ জন পুরুষকে পরামর্শদাতা হিসাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এছাড়া রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। এরাই হোয়াটস্যাপ গ্রুপ, জরিপ পরিচালনা এবং স্থানীয় প্রোগ্রাম সমন্বয় করে থাকেন।
হরিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত, শর্মাতলা গ্রামের ১৯ বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবী, অঞ্জলি বলেন, "যে পুরুষরা নারীদের কথা শুনতে পছন্দ করেন না তাদের পক্ষে এটা কঠিন। ভারতের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই ধরনের বিষয়গুলি প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরাও লড়াই করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ"।
জাগলান ইতোমধ্যে নতুন একটি কার্যক্রম চালু করেছেন। এ কার্যক্রমের অংশ হিসাবে হরিয়ানার ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলগামীদের জন্য প্রশ্নাবলী ব্যবহার করে তাদের পরিবারের সাথে অবমাননাকর মন্তব্য করার বিরুদ্ধে কাউন্সিলিং করা হবে।
২০২১ সালে প্রতিবেশী রাজ্য রাজস্থান এবং উত্তর প্রদেশের কিছু গ্রামের প্রবীণরা সুনীল জাগলানের এই কার্যক্রমকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। জাগলান বলেন, ''এই বছর আমরা 'গালিমুক্ত ঘর' মডেল বাস্তবায়নের জন্য গোয়া, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি থেকে ৩০টিরও বেশি গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুরোধ পেয়েছি৷ এমনকি নেপালের এনজিওগুলো আমাদেরকে যেতে বলেছে এবং সেখানে আমাদের কার্যক্রমটি চালু করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে"।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান