এলিজাবেথ কখন বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি একদিন রানি হবেন?
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছেলেবেলা কেটেছে তার ঘোড়া এবং কুকুরের সাথে সময় কাটানোর মাধ্যমে। কিন্তু, তিনি ঠিক কখন তার আসন্ন ভাগ্যের আভাস পেয়েছিলেন?
রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) তার রানি হিসেবে দায়িত্ব পালনের ৭০ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু, তার রানি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তুলনামূলক কম।
১৯৩৬ এর ডিসেম্বরে রাজপরিবারে একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে। সে বছর আমেরিকান নাগরিক ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করার জন্য এলিজাবেথের চাচা ডেভিড অর্থাৎ রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড নিজের সিংহাসন ত্যাগ করে হতবাক করে দেন নিজ পরিবার ও পুরো বিশ্বকে।
রাজা এডওয়ার্ডের এই সিদ্ধান্তের কারণেই ১০ বছর বয়সী এলিজাবেথ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার সারিতে জায়গা করে নেন। অষ্টম এডওয়ার্ডের সিংহাসন ত্যাগের পর এলিজাবেথের বাবা প্রিন্স অ্যালবার্ট রাজা ষষ্ঠ জর্জ উপাধি গ্রহণ করেন।
কিন্তু ছোট রাজকুমারী এলিজাবেথ কি সত্যিই এত অপ্রস্তুত ছিলেন?
"পাপা রাজা হতে যাচ্ছে," এলিজাবেথ তার ছয় বছর বয়সী বোন মার্গারেট রোজকে সেই ডিসেম্বরের দিন জানায়। "তার মানে কি তুমি রানি হতে যাচ্ছ?" মার্গারেট তাকে জিজ্ঞেস করে। এলিজাবেথ সেসময় তাকে এ প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তরই দিয়েছিল বলে ইতিহাসবিদ বেন পিমলটকে বলেছিলেন মার্গারেট।
তাহলে, ১০ বছর বয়সী রাজকুমারী এলিজাবেথ আসলে কী জানতেন?
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্য রাজকীয় দায়িত্বভার পাওয়া প্রথম মডেল ছিলেন তার দাদা রাজা পঞ্চম জর্জ (১৮৬৫-১৯৩৬)। এলিজাবেথ তাকে 'গ্র্যান্ডপা ইংল্যান্ড' বলে ডাকতেন; যা তা রাজকীয় জীবন সম্বন্ধে উপলব্ধিই তুলে ধরে।
এলিজাবেথের বিখ্যাত পারিবারিক ডাকনাম 'লিলিবেট' এর উৎসও ছিলেন রাজা পঞ্চম জর্জ। ১৯২৯ সালের এপ্রিলে, এলিজাবেথের তৃতীয় জন্মদিনে তিনি 'প্রিন্সেস লিলিবেট' হিসেবে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে জায়গা করে নেন।
সে বছরই প্রথমবারের মতো রাজা জর্জ তার নাতনির ব্রিটিশ সিংহাসনে আরোহণ নিয়ে আশা ব্যক্ত করেন। এলিজাবেথের বাবাকে তিনি বলেছিলেন, "তোমার ভাই কখনোই রাজা হতে পারবে না।"
"আমরা সকলেই তখন তার এ কথাকে হাস্যকর ভেবেছিলাম," এ ঘটনার কয়েক বছর পর এলিজাবেথের মা স্মরণ করছিলেন সে দিনের ঘটনা।
কিন্তু, রাজা জর্জ ছিলেন তার বক্তব্যে অনড়। নিজের এক সহযোগীকে তিনি বলেছিলেন, "এডওয়ার্ড তার রাজত্ব ত্যাগ করবে।" রাজা এডওয়ার্ড তার সিংহাসন ত্যাগ করার ৭ বছর আগেই রাজা জর্জের এই বক্তব্য তার বিচক্ষণতারই প্রতীক।
পঞ্চম জর্জ শুধুমাত্র তার বড় ছেলেকে নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন না। বরং তার দ্বিতীয় ছেলে ডিউক অব ইয়র্ক, অর্থাৎ এলিজাবেথের বাবাকে নিয়েও ছিলেন উদ্বিগ্ন।
তাদেরকে নিয়ে সন্দিহান থাকার ফলেই ছোট লিলিবেটকে শিশু হিসেবে সিংহাসনে বসানোর কথা ভাবেন তিনি। রাজা জর্জের তৃতীয় ছেলে, এলিজাবেথের চাচা হেনরির তত্ত্বাবধানে তার সিংহাসনে আরোহণের সম্ভাবনা কেবল একজন অসুস্থ রাজার চিন্তার প্রতিফলন মনে হতে পারে।
কিন্তু সেবছর ব্যালমোরালে অবস্থান করার সময় এলিজাবেথের সিংহাসনের বসার সম্ভাবনাকে সমর্থন করেছিলেন তৎকালীন চ্যান্সেলর উইনস্টন চার্চিল। পরবর্তী সময়ে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শাসনামলে প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন চার্চিলই।
এলিজাবেথ সম্পর্কে তার স্ত্রী ক্লেমেন্টাইনকে চার্চিল লিখেছিলেন, "এই শিশুটির মধ্যে আশ্চর্যজনক কর্তৃত্ববোধের আভাস রয়েছে।"
ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠা দাদার সাথে ছোট এলিজাবেথ যখন বালি দিয়ে দুর্গ তৈরি করতো, তখনই তার ওপর রাজকীয় প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠতো।
১৯৩৬ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের রাজত্ব শেষ হওয়ার আগে তার নাতনির জন্য পাঠানো মানুষের অসংখ্য উপহার এবং পাবলিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতির জন্য অনুরোধের পরিমাণ এতই বেড়েছিল যে, তার পাবলিক কার্যকলাপ দেখাশোনার জন্য আলাদা একজন ব্যক্তি রাখা হয়।
১৯২০ এর দশকের শেষদিকে উইন্ডসর ক্যাসেলে প্রিন্সেস এলিজাবেথকে প্র্যামে করে চেঞ্জিং অব দ্য গার্ড দেখার জন্য নিয়ে আসা হতো। সেসময় অফিসার কমান্ডিং তাকে স্যালুটও জানাতেন।
"মার্চ করার অনুমতি পেতে পারি, ম্যাম?' বলে এলিজাবেথের কাছ থেকে অনুমতি চাওয়া হতো সেসময়।
কম বয়সেই গার্ডদের পরিচালনা করার ক্ষমতা পেয়ে এলিজাবেথের মনে স্বাভাবিকভাবেই রাজত্বের ধারণা জন্মাতে থাকে।
তিন/ চার বছর বয়সী একটি শিশু শুধুমাত্র হাত নাড়িয়েই যেখানে রয়্যাল গার্ডকে নির্দেশ দিতে পারছে, তখন সেই অভাবনীয় ক্ষমতা তার মনের উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে তা বোঝা কঠিন নয়।
এলিজাবেথের চতুর্থ জন্মদিনের পরপরই, ১৯৩০ সালে তার একটি মোমের মূর্তি মাদাম তুসোতে স্থাপিত হয়। এর দুই বছর পর নিউফাউন্ডল্যান্ডে প্রিন্সেসের ছবি আঁকা একটি ছয়-সেন্টের স্ট্যাম্প চালু হয়। এমনকি 'প্রিন্সেস এলিজাবেথ ল্যান্ড' নামক ৩ লাখ ৫০ হাজার বর্গমাইলের একটি জায়গাও তার নামে নামকরণ করা হয়।
১৯৩২ সালের বেলফাস্ট নিউজ লেটারে রিপোর্ট করা হয়, "যখনই সে পার্কে ড্রাইভ করার জন্য বের হতো, তখনই লোকেরা ছয় বছর বয়সী প্রিন্সেসকে নিজেদের টুপি ও রুমাল উঁচিয়ে সম্মান জানাতো।"
১৯৩৩ সালের এপ্রিলে নিজের সপ্তম জন্মদিনে এলিজাবেথ তার নিজস্ব স্টেশনারির চা-পার্টিতে একটি রাজকীয় মুকুটে হাজির হন তিনি।
সেসময় এলিজাবেথের বাবা-মার কমিশনে তার একটি ছবি আঁকেন চিত্রশিল্পী ফিলিপ ডি লাজলো। তাকে তিনি 'সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও একটি ছোট সুন্দর মেয়ে' হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
১৯৩৪ এর মে মাসে একটি সুপরিচিত মার্কিন প্রতিবেদনে উঠে আসে, রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড রাজত্বের দায়িত্ব চালানোর বিষয়ে আগ্রহী নন। ফলস্বরূপ, তখন থেকেই শিশুবয়সী প্রিন্সেস এলিজাবেথ 'ইংল্যান্ডের মুকুটের সরাসরি উত্তরাধিকারী' হিসেবে যথাযথ শিক্ষা পাচ্ছিলেন।
এলিজাবেথ ও মার্গারেটের পড়াশোনার বিষয়ে রাজা জর্জও বেশ গুরুত্ব দিতেন। তাদের গভর্নেসকে তিনি বলেছিলেন, "মার্গারেট ও লিলিবেটকে ভালোভাবে লিখতে শেখান। আমার সন্তানদের মধ্যে কেউই ঠিকভাবে লিখতে পারে না।"
এমনকি, এলিজাবেথ যাতে করে একজন যোগ্য রানি হয়ে উঠতে পারেন সেদিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন রানি মেরিও। একটি কনসার্টে এলিজাবেথকে অনেক উৎসাহের সাথে ঘোরাফেরা করতে দেখে তিনি তাকে একটি ট্যাক্সিতে করে প্রাসাদে পাঠান।
রানি মেরি চাননি যে তার বড় নাতনি আদর-যত্নে আসক্ত হোক। রানি ও তার স্বামী বুঝতে পেরেছিলেন যে আসলে সিংহাসনে বসার জন্য তাদেরকে কী মূল্য দিতে হয়েছে। সেভাবেই তারা প্রস্তুত করছিলেন এলিজাবেথকে।
রয়্যাল লেজেন্ড অনুসারে, ১৯৩৩ সালে লিলিবেট তার বোন মার্গারেটকে বলেছিলেন, "আমি ৩ এবং তুমি ৪।"
ছোট ৩ বছর বয়সী মার্গারেট ভেবেছিলেন এলিজাবেথ তাদের বয়সের কথা বলছিলো।
মার্গারেট ভাবতেও পারেন নি যে তার বোন আসলে দাদার পরে উত্তরাধিকারসূত্রে তাদের অবস্থানের ধারা বলছিলেন।
ছোট এলিজাবেথকে তখন থেকেই 'গ্র্যান্ডমা ইংল্যান্ড' হওয়ার জন্য ঘোড়া এবং কুকুরের মধ্যে বেড়ে উঠতে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়েছিল।
অবশেষে ১৯৫২ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন ২৫ বছর বয়সী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সিংহাসনে থাকা রানি তিনি।
১৯৯১ সালের ক্রিসমাস সম্প্রচারে তিনি ঘোষণা করেন, "আমরা নিজেদেরকে খুব বেশি গুরুত্বের সাথে না নেই। আমাদের কারোরই জ্ঞানের উপর একচেটিয়া অধিকার নেই।"
- ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ও বায়োগ্রাফার রবার্ট লেসির লেখা থেকে সংগৃহীত
- সূত্র: বিবিসি