বরফহীন শুষ্ক বেইজিং যেভাবে শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করছে
এবছর বেইজিংয়ে তুষারপাত হচ্ছে না বললেই চলে। শুষ্ক শহরে শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করতে তাই চীনকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হচ্ছে মানবসৃষ্ট তুষারের উপর।
বেইজিংয়ের উত্তরে ইয়ানকিংয়ে আয়োজকরা একদম শূন্য থেকে স্কি ভেন্যু তৈরি করেছেন। ঝাংজিয়াকো শহরেও ফ্রিস্টাইল স্কিইং, স্কি জাম্পিং এবং বায়থলন ইভেন্টগুলোর জন্য কৃত্রিম তুষার ব্যবহৃত হচ্ছে।
অত্যাধুনিক ইউরোপীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করে কয়েক মাস ধরে তুষার তৈরি করার ফলেই এখন মাঠে নামতে পেরেছে শীতকালীন অলিম্পিক।
চলুন জেনে নেওয়া যাক এই কৃত্রিম তুষারের খুঁটিনাটি-
তৈরির প্রক্রিয়া
সাধারণত পরাগ বা ধূলিকণার মতো ক্ষুদ্র কণাদের আঁকড়ে ধরে মেঘের উপর উঠে বসে জলীয় বাষ্পের কণারা। সেখানেই তৈরি হয় প্রাকৃতিক তুষার।
বৈজ্ঞানিক ভাষায়, এই কণাগুলোকে বলা হয় নিউক্লিয়েটর। এরা একসাথে মিলে তুষার নিউক্লিয়াস তৈরি করে, যা পরবর্তীতে অন্য জলীয় অণুকে আকর্ষণ করে। এরপর সব মিলিয়ে তৈরি হয় তুষারফলক।
তুষার তৈরির যন্ত্রেও এই প্রক্রিয়াকেই নকল করার চেষ্টা করা হয়। এতে যান্ত্রিকভাবে নিউক্লিয়েটর তৈরি করে এর উপর পরমাণুযুক্ত পানি স্প্রে করা হয়। ক্ষুদ্র বরফের স্ফটিক নিউক্লিয়েটরটিই তুষারফলকের বীজ হিসেবে কাজ করে৷
১৯৮০ সালের নিউ ইয়র্ক অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছিল কৃত্রিম তুষার। এরপর থেকে শীতকালীন খেলাধুলার আসরগুলোতে এই তুষার তৈরির প্রক্রিয়া অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে।
তুষারের বন্দুক
এবারের বেইজিং অলিম্পিকে তুষার তৈরির সরঞ্জামাদি সরবরাহ করার চুক্তি পেয়েছে টেকনোআলপিন নামের এক প্রতিষ্ঠান।
অলিম্পিকের স্কিইং এবং স্নোবোর্ডিং ভেন্যুগুলোতে বরফ জোগাতে ২৭২টি তুষার নিক্ষেপের বন্দুক বসিয়েছে ইতালীয় কোম্পানিটি। বসিয়েছে ৮২টি স্টিক ল্যান্সও।
ফ্যানসমেত তুষার বন্দুকগুলো দেখতে ছোট জেট ইঞ্জিন বা বড় আকারের হেয়ার ড্রায়ারের মতো। এসব তুষার বন্দুককে ব্লুটুথ ব্যবহার করেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
অলিম্পিকের পানি সংকট
গোবি মরুভূমি থেকে খুব বেশি দূরে নয় বেইজিং এবং ঝাংজিয়াকু। এই দুই শহরে তাই পানির সংকটও প্রচুর।
চীন এই অলিম্পিক আয়োজন করার জন্য যখন প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করে, তখনই তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)। ২০১৫ সালে বেইজিংয়ের পরিকল্পনাকে পর্যালোচনা করে আইওসি বলে, এই দুই শহরে বার্ষিক তুষারপাতের পরিমাণ একেবারেই কম এবং এখানে শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজিত হলে তা পুরোপুরি কৃত্রিম তুষারের উপর নির্ভর করে হতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য কারণে বেইজিং-ঝাংজিয়াকু এলাকা ক্রমশ শুষ্ক হয়ে উঠছে বলেও উল্লেখ করা হয় আইওসির পর্যালোচনায়।
অলিম্পিকের জন্য কৃত্রিম তুষার তৈরিতে করতে প্রায় পাঁচ কোটি গ্যালন পানি লাগবে বলে ধারণা করছে চীন। এই পরিমাণ পানি ৭৪টি অলিম্পিক সুইমিং পুলকে ভরিয়ে দিতে সক্ষম। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের এই অনুমানের চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে পানি খরচ করতে হবে তাদের।
কৃত্রিম তুষার কি পরিবেশের ক্ষতি করছে?
কৃত্রিম তুষার তৈরিতে কিছু পরিবেশগত উদ্বেগ আছে। বিশেষ করে, উচ্চ তাপমাত্রায় পানি জমা করতে মাঝে মাঝে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, এবং পুরো সিস্টেমের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ। এগুলো কার্বন ফুটপ্রিন্ট উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে দিতে পারে।
তবে আইওসি জানিয়েছে, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত মানদণ্ড মেনেই এই তুষার তৈরি করছে চীন।
আইওসির মতে, চীনের সমস্ত গেমস ভেন্যু এবং পরিষেবাগুলো বায়ু ও সৌরশক্তিতে চলছে। এবং তুষার তৈরিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে না কোনো রাসায়নিক।
ক্রীড়াবিদরা কী বলছেন
কৃত্রিম তুষার নিয়ে ইতোমধ্যে অসন্তোষটি প্রকাশ করেছেন অনেক ক্রীড়াবিদ। তাদের দাবি, কৃত্রিম তুষার খেলায় বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে আসে। স্কিয়ার এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবসৃষ্ট তুষারের আর্দ্রতা বেশি। যার ফলে এটি দ্রুত শক্ত হয়ে যায়।
এস্তোনিয়ান অলিম্পিক বায়াথলেট জোহানা তালিহার্ম গত মাসে বলেন, কৃত্রিম তুষার দ্রুত শক্ত হয়ে যাওয়াও ক্রীড়াবিদদের গতি বেড়ে যাচ্ছে এবং খেলাগুলো আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
আইওসি অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাদের দাবি, এই কৃত্রিম তুষারের ফলে বরং সামনে থেকে পিছনে এবং উপর থেকে নীচে সামঞ্জস্যপূর্ণ পৃষ্ঠ তৈরি হয়।
"আমরা এখন যে তুষার পাচ্ছি তা একেবারেই নিখুঁত। এরচেয়ে ভালোভাবে আপনি তুষারের ব্যবস্থা করতে পারবেন না," বলেন আইওসির এক মুখপাত্র।
সূত্র: এবিসি নিউজ।