হৃদপিণ্ডের কোষ থেকে তৈরি মাছ!
কৃত্রিম একটি মাছ ছন্দময়ভাবে তার লেজ নাড়াচ্ছে। মাছটি আমাদের স্পন্দিত হৃদয়ের মতো একই শক্তি ব্যবহার করে লবণ এবং গ্লুকোজ দ্রবণে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হার্ভার্ড এবং ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এরকমই একটি মাছ তৈরী করেছেন। মাছের মতো দেখতে এই ক্ষুদ্র ও ছিমছাম গোছের সংবহন ব্যবস্থাটি ১০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে সাঁতার কাটতে পারে।
মানুষের স্টেম সেল থেকে উদ্ভূত জীবন্ত হৃদপেশীর কোষ (কার্ডিওমায়োসাইট) দ্বারা গঠিত ছোট এই ডিভাইসের জন্য বিজ্ঞানীরা বেশ আশাবাদী। আমাদের হৃদযন্ত্রের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের একটি হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করার ক্ষমতা এবং আরেকটি হলো যান্ত্রিক গতি (মেকানোইলেক্ট্রিক্যাল সিগন্যালিং) দ্বারা বার্তা প্রেরণ ক্ষমতা। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করেই 'বায়োহাইব্রিড' মাছটি তৈরী করা হয়েছে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জৈব প্রকৌশলী কেভিন কিট পার্কার বলেন, "আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল একটি শিশুর অকার্যকর হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের জন্যে একটি কৃত্রিম হৃদপিণ্ড তৈরি করা"।
যদিও হৃদযন্ত্রের মতো দেখতে কোনোকিছু তৈরি করা যথেষ্ট সহজ। তবে এমন জিনিস তৈরি করা বেশ চ্যালেঞ্জিং যা আসল হৃদপিণ্ডের মতো কাজও করে।
পার্কার বলেন, "আমি প্লে-ডো থেকে হৃদযন্ত্রের একটি মডেল তৈরি করতে পারি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি একটি আসল হৃদযন্ত্র তৈরি করতে পারি। আপনি একটি থালায় কিছু এলোমেলো টিউমার কোষ বৃদ্ধি করতে পারেন যতক্ষণ না তারা একটি স্পন্দনশীল মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। একে 'কার্ডিয়াক অর্গানয়েড' বলে। এটি একটি চ্যালেঞ্জ এবং এ দিকটা নিয়েই আমরা কাজ করতে যাচ্ছি।"
লেজের পাখনার প্রতিটি পাশে কার্ডিওমায়োসাইটের দুটি স্তর রয়েছে যার মাধ্যমে বায়োহাইব্রিড মাছটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় পেশির একপাশ সংকুচিত হলে অন্য পাশ প্রসারিত হয়। এটি একটি ফিডব্যাক মেকানিজম। এ্যাসিনক্রোনাস পেশী সংকোচনের এই সিস্টেমটি পোকামাকড়ের উড্ডয়ন পেশীগুলোর সাথে সম্পৃক্ত।
শারীরিক সংকোচন হচ্ছে একপ্রকার যান্ত্রিক গতি যা পেশীতে আয়ন চ্যানেল গঠনকারী বৈদ্যুতিক সংকেতকে সক্রিয় করে তোলে। এই আয়ন চ্যানেলগুলো পেশীগুলোকে সক্রিয় এবং সংকোচনের জন্য উদ্দীপ্ত করে। সিস্টেমটিকে স্ট্রেপ্টোমাইসিন এবং গ্যাডোলিনিয়ামে উন্মুক্ত করার ফলে সাঁতারের গতি কমে যায় এবং অন্যদিকের পরবর্তী সংকোচনের যান্ত্রিক স্ট্রেচিং এবং ট্রিগারিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে যায়। আয়ন চ্যানেলগুলো যে আসলেই সংকোচনের সাথে জড়িত ছিল এটি তারই প্রমাণ করে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জৈব প্রকৌশলী কিল ইয়ং লি বলেন, "দুটি পেশীস্তরের মধ্যে কার্ডিয়াক মেকানো-ইলেক্ট্রিক্যাল সিগন্যালকে কাজে লাগিয়ে আমরা চক্রটি পুনরায় তৈরি করেছি। এখানে প্রতিটি সংকোচন বিপরীত দিকে প্রসারিত হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফলাফল দিতে পারে"।
পার্কার এবং দলের অন্যান্য গবেষকেরা বায়োহাইব্রিডের মধ্যে পেসমেকার-সদৃশ একটি সিস্টেমকে একীভূত করেছেন। এটি কোষসমূহের একটি বিচ্ছিন্ন ক্লাস্টার অবস্থা যা এই শারীরিক আন্দোলনের ফ্রিকোয়েন্সি এবং সমন্বয় দুই-ই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
বায়োফিজিক্স গবেষক সুং-জিন পার্ক বলেন, "দুটি অভ্যন্তরীণ পেসিং প্রক্রিয়া চালু থাকার ফলে আমাদের মাছ বেশিদিন বাঁচতে পারে, দ্রুত চলতে পারে এবং আগের তুলনায় আরও দক্ষভাবে সাঁতার কাটতে পারে"।
বায়োহাইব্রিড মাছের টিস্যুর সংকোচন-প্রসারণকে জেব্রাফিশের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এটির অনুকরণেই বায়োহাইব্রিডকে মডেল করা হয়েছে। এর ফলে ছোট ডিভাইসটি রোবোটিক সিস্টেমের চেয়ে আরও দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে।
পার্কার বলেন, "হার্ট ইমেজিংকে ব্লু প্রিন্ট হিসাবে ব্যবহার করার পরিবর্তে, আমরা হৃদযন্ত্রের বায়োফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করছি। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই হৃদপিণ্ডকে সচল রাখে। এগুলোকে ডিজাইনের মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার করে একটি জীবন্ত মাছ তৈরি করেছি। এবং আমরা সফল"।
- সূত্র- সায়েন্স এলার্ট