চুল হারিয়ে টাক হয়ে যাচ্ছেন? গবেষণাগারে তৈরি চুলের কোষ দিতে পারে সমাধান
সময়ে কিংবা অসময়ে মাথায় টাক পড়ে যাওয়াটা বহু প্রাচীন একটা সমস্যা। আজকাল ফ্যাশনসচেতন মানুষের জন্য এই সমস্যা আরও প্রকট আকার নিয়েছে। বাজারে অনেক রকমের টাক সারানোর ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। তবে এখন পর্যন্ত প্রকৃত কার্যকরী ওষুধের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
তবে এবার প্রকৃতপক্ষেই টাক সমস্যার সমাধান করতে পারেন গবেষকরা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বাধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে কাজে লাগাচ্ছেন কিছু স্টার্ট-আপে কর্মরত জীববিজ্ঞানীরা। গবেষণাগারে চুল গজানোর নতুন কোষ সৃষ্টি করছেন তারা। এর ফলে টাক হয়ে যাওয়া মানুষ চুল গজানোর ক্ষমতা ফিরে পাবেন।
এমআইটি টেকনোলজি রিভিউকে কয়েকজন গবেষক জানিয়েছেন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তারা গবেষণাগারে মানুষ, এমনকি প্রাণীর চুলের কোষও তৈরি করছেন। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউয়ের কাছে ডিনোভো নামে একটি স্টার্টআপের পাঠানো ছবিতে দেখা গেছে, একটি চুলবিহীন ইঁদুরের শরীরের একাংশে ঘন চুল গজিয়েছে। কোম্পানিটি বলছে, মানব-চুল গজানোর কোষ ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে তারা এ কাজে সাফল্য পেয়েছে।
ডিনোভার প্রতিষ্ঠাতা আর্নেস্তো লুজান—স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জীববিজ্ঞানী। লুজান বলছেন, তার কোম্পানি রক্ত, চর্বির মতো সাধারণ কোষকে জেনেটিক্যালি 'রিপ্রোগ্রাম' করে চুলের গ্রন্থিকোষের উপাদান তৈরি করে। এটা নিয়ে আরও কাজ করতে হবে, তবে চুল ঝরে যাওয়ার সুপ্ত সমস্যার সমাধান এই প্রযুক্তির মাধ্যমে করা যাবে বলে আশাবাদী লুজান।
চুলের সব ধরনের গ্রন্থিকোষ নিয়েই আমরা জন্মাই—কিন্তু বার্ধক্য, ক্যানসার, টেস্টোস্টেরন, জিনে কোনো ত্রুটি প্রভৃতি কারণে চুল সৃষ্টিকারী স্টেম সেল মরে যায়। এসব কোষ মরে গেলে আমাদের মাথার চুলও পাতলা হয়ে আসতে থাকে।
লুজান দাবি করছেন, তার কোম্পানি যেকোনো কোষের মধ্যে থাকা সক্রিয় জিনের প্যাটার্ন বদলে দিয়ে সেগুলোকে সরাসরি চুলের গজানোর কোষে পরিণত করতে পারে।
কোষ রিপ্রোগ্রামিং
একদিকে যখন মাথার চুল নতুন করে গজানো নিয়ে কাজ হচ্ছে, তখন অন্যদিকে কয়েকটি স্টার্ট-আপ কাজ করছে বার্ধক্য ঠেকানোর প্রযুক্তি আবিষ্কার নিয়ে। এ কাজটি তারা করতে চায় রিপ্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে।
লোকশ্রুতি আছে, এরকম কয়েকটি স্টার্টআপে বিনিয়োগ রয়েছে জেফ বেজোস ও ইয়ুরি মিলনারের।
এ-সংক্রান্ত গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ একটি সাফল্য আসে ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে। ওই সময় একদল জাপানি গবেষক যেকোনো ধরনের টিস্যুকে শক্তিশালী স্টেম সেলে পরিণত করার একটি সহজ-সরল ফর্মুলা আবিষ্কার করেন। এর পরই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, তারা সম্ভবত প্রায় সব ধরনের কোষই যত খুশি তত তৈরি করতে পারবেন।
যদিও রিপ্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা করে সাফল্য পাওয়ার নজির এখন পর্যন্ত খুব কমই দেখা গেছে। জাপানে গবেষকরা অন্ধদের চোখে রেটিনা কোষ ট্রান্সপ্লান্ট করার চেষ্টা করেছিলেন।
এরপর গত নভেম্বরে ভার্টেক্স ফার্মাসিউটিক্যালস নামে একটি মার্কিন কোম্পানি দাবি করে, ইনসুলিনের প্রতি সাড়া দেয় এমন বেটা কোষ শরীরে প্রবেশ করিয়ে তারা হয়তো মানুষের টাইপ ১ ডায়াবেটিস সারাতে পারবে।
স্টার্ট-আপগুলো ত্বকের কোষের মতো সাধারণ কোষগুলো রোগীদের শরীর থেকে সংগ্রহ করে। তারপর সেগুলোকে চুল সৃষ্টিকারী কোষে পরিণত করে। ডিনোভো ছাড়াও স্টেমসন নামে একটি কোম্পানি সাড়ে ২২ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে। কোম্পানিটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জিওফ হ্যামিল্টন বলেছেন, প্রযুক্তিটি পরীক্ষা করে দেখতে তারা রিপ্রোগ্রামড কোষ ইঁদুর ও শূকরের ত্বকে ট্রান্সপ্লান্ট করছেন।
হ্যামিল্টন ও লুজান দুজনেরই বিশ্বাস, টাকের চিকিৎসা করার এই প্রযুক্তির ভালো বাজার রয়েছে। পুরুষদের প্রায় অর্ধেকই জীবনের কোনো-না-কোনো পর্যায়ের টেকো হয়ে যান। অনেকের তো বয়স ২০ ছুঁতে-না-ছুঁতেই টাক পড়া শুরু হয় মাথায়। নারীদের চুল ঝরা শুরু হলে তারাও রীতিমতো আতঙ্কে ভুগতে থাকেন।
স্বপ্ন সত্যিই সত্যি হবে তো?
আসলেই কি স্টেম-সেল প্রযুক্তি টাক-সমস্যার সমাধান দিতে পারবে? নাকি স্রেফ আরেকটা মিছে আশা হয়েই থেকে যাবে? অতীতে এরকম টাক-সমস্যার সমাধান দেওয়ার ফাঁপা আশা দিয়েছে অনেকেই।
হ্যামিল্টন বলেন, সাফল্য পাওয়ার জন্য তাদের আরও অনেক গবেষণা করতে হবে সত্যি, কিন্তু সফল হওয়ার আশা ও সম্ভাবনাও আছে বিস্তর।
বাজারে এখন চুল ঝরার বেশ কিছু অনুমোদিত ওষুধ আছে, কিন্তু সেগুলোর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। আরেকটা প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি হচ্ছে, শরীরের যে অংশে এখনও চুল আছে সেখান থেকে খানিকটা চামড়া তুলে নিয়ে অপারেশন করে সেটা টাক পড়া অংশে ট্রান্সপ্লান্ট করে দেওয়া। লুজান বলছেন, ভবিষ্যতে গবেষণাগারে তৈরি চুল-গজানোর কোষও একই পদ্ধতিতে অপারেশন করে টাক ব্যক্তির মাথায় বসিয়ে দেওয়া যাবে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্ল কোয়েলার বলেন, এই প্রযুক্তি সফল হলে দারুণ ব্যবসায়িক সাফল্য আসবে। তবে এই চিকিৎসা-পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে বলেও জানান তিনি।
কোয়েলার আরও বলেন, ইঁদুরের শরীরে মানুষের চুল গজানোর ছবি নতুন নয়, আগেও দেখা গেছে। কিন্তু এই চিকিৎসা-পদ্ধতি মানুষের ক্ষেত্রে সফল করার পথে কোনো-না-কোনো বাধা থেকেই যায়।
কোয়েলার নিজেও ত্বকের নিচের অংশের চুল তৈরি করছেন গবেষণায়। কোয়েলার আসলে বধিরতার প্রতিকার খুঁজতে গিয়ে এই আবিষ্কার করে ফেলেন। অন্তঃকর্ণে 'হেয়ারলাইক সেল' সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে ত্বক তৈরি করে ফেলেন, তা-ও একেবারে চুলের গ্রন্থিকোষসহ।
দুর্ঘটনা থেকেই ঘটে গেছে দারুণ ব্যাপার। কোয়েলার এখন ত্বকের অর্গানয়েড তৈরি করেন। তাতে থাকে টিউবসদৃশ চুলের গ্রন্থিকোষ। কোয়েলারও আশা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে সত্যিই সম্ভব হবে টাক সমস্যার সমাধান করা।