বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী যেসব ভাষা
কথিত রূপে আজো দুনিয়াজুড়ে টিকে আছে ৬ হাজারের বেশি ভাষা। এরমধ্যে ২ হাজারের বেশি ভাষায় কথা বলে এক হাজারেরও কম মানুষ। আর মাত্র ১৫টি ভাষাতেই পৃথিবীতে মোট কথাবার্তার অর্ধেক সম্পন্ন হয়।
তবে মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে বিশ্ব এখন পরস্পর সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। বহুভাষী সমাজের আন্তঃযোগাযোগে গড়ে উঠেছে এ ব্যবস্থা। উন্নত বিশ্বেও অভিবাসনের ফলে সমাজে একাধিক ভাষার সহাবস্থান বাড়ছে।
এ বাস্তবতায় সফলভাবে যোগাযোগ স্থাপনে বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতার গুরুত্বও দেখা দিচ্ছে দিনকে দিন। সাংস্কৃতিক সংযোগ, অর্থনীতি ও সামাজিক আয়োজনে অন্তর্ভুক্ত থাকতেও ভূমিকা রাখছে নতুন ভাষা শিক্ষা।
তাই প্রশ্ন জাগতেই পারে- কোন কোন ভাষা শিখলে উপকার বেশি?
এজন্য আগে জেনে নেওয়া উচিত ভাষা প্রদত্ত সার্বিক পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা:
১. ভৌগলিক: ভ্রমণের সুবিধা;
২. অর্থনীতি: কোনো বিশেষ অর্থনীতিতে যোগদানের সক্ষমতা;
৩. যোগাযোগ: আলোচনায় অংশগ্রহণের ক্ষমতা;
৪. জ্ঞান ও গণমাধ্যম: জ্ঞানার্জন ও গণমাধ্যমের কন্টেট উপলদ্ধির ক্ষমতা;
৫. কূটনীতি: আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যোগদানের সক্ষমতা।
কোন ভাষাগুলো সবচেয়ে শক্তিশালী?
বিভিন্ন মাধ্যমে দেওয়া আলোচিত সুবিধার আলোকে ভাষার একটি র্যাঙ্কিং বা সারণী তৈরি করা হয়। যাকে বলা হয় পাওয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ ইনডেক্স বা পিএলআই। এটি কোনো ভাষার প্রভাব নিরুপণে ২০টি সূচক বা মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করে। কোনো ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে একটি ভাষার উপযোগিতা পরিমাপ করে পিএলআই সারণী। অর্থাৎ, সার্বিকভাবে সকলের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। কোনো ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ/ অপছন্দ, ভৌগলিক অবস্থান ও অন্যান্য শর্তের আলোকে তা ভিন্ন ভিন্ন হয়। আরও জেনে রাখা উচিত, পৃথিবীর সব ভাষারই আছে নিজস্ব কৃষ্টি ও সৌন্দর্য। এই সারণী কোনো ভাষা বা সে যে সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে তার সৌন্দর্য বা উৎকর্ষ বিচারের মাপকাঠিও নয়।
নিচে প্রদত্ত টেবলটি পিএলআই সারণী অনুসারে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ১০টি ভাষাকে তুলে ধরেছে। এখানে শীর্ষে রয়েছে ইংরেজি। জি-৭ জোটভুক্ত উন্নত দেশগুলোর (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা) অধিকাংশের প্রধান ভাষা এটি। এককালে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভাবই ভাষাটির প্রভূত ক্ষমতার উৎস। যার প্রচলন আছে সাবেক কলোনিসহ বহু দেশের গণমাধ্যম, শিক্ষা ব্যবস্থা, সরকারি কর্ম ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। এক কথায় ইংরেজিই আজ দুনিয়ার- 'লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা' বা ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে আদানপ্রদানের প্রধান উপায়।
তারপরেই আছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনের ভাষা- মান্দারিন। ইংরেজির তুলনায় এর বহুমাত্রিক আবেদন অবশ্য অর্ধেক। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির বহু শব্দাবলী উদ্ভাবনে অবদান রেখে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ফরাসী ভাষা (ফ্রেঞ্চ)। শীর্ষ পাঁচে পরের দুই অবস্থান যথাক্রমে স্প্যানিশ ও আরবির। যষ্ঠস্থানে রয়েছে রুশ ভাষা।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই ছয়টি ভাষা আবার জাতিসংঘেরও আনুষ্ঠানিক ভাষা। অবস্থান অনুসারে শীর্ষ দশের বাকি চারটি ভাষা হচ্ছে- পর্তুগিজ, হিন্দি, জার্মান ও জাপানি। সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থানই জার্মানি ও জাপানের ভাষাকে অন্যতম শক্তিশালীদের কাতারভুক্ত করেছে।
ভাষা কেন গুরুত্বপূর্ণ:
প্রতিযোগী সক্ষমতার জন্য আবশ্যক হলো- ভাষাজ্ঞান। ভাষার এ প্রভাবের কারণেই লণ্ডন ও নিউইয়র্ক বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রগামী দুটি শহর। ইংরেজি চর্চার অবকাঠামো ও ঐতিহ্য থাকায় হংকং ও সিঙ্গাপুরই পেয়েছে একক ভাষার আধিক্য থাকা টোকিওকে পেছনে ফেলে এশিয়ার আর্থিক রাজধানীর মর্যাদা। আসলে বিশ্বের আর্থিক লেনদেনে শীর্ষ ১০ শহরের আটটিতেই রয়েছে ইংরেজি ভাষাভাষীর আধিক্য বা তাতে দক্ষ জনসংখ্যা।
ইংরেজি ভাষার এই শক্তিমান প্রভাবের ভালো ও মন্দ দুই দিকই রয়েছে। যেমন এটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দেয়। আবার একইসাথে একারণে চলছে অন্য ভাষার 'ইংরেজিকরণ'—অর্থাৎ ভিনদেশি ভাষায় ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এভাবে প্রতিযোগী ভাষার শব্দভাণ্ডার ও সমৃদ্ধ বৈশিষ্ট্যকে ক্ষয় করছে ইংরেজি নির্ভরতা। অনেক অঞ্চলে আবার স্থানীয় ভাষাকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করেছে ইংরেজি। ঠিক একারণেই ফরাসি ভাষায় ইংরেজির অনুপ্রবেশ বন্ধে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ফ্রান্স।
নিচের গ্রাফে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল কম্পিটেটিভ ইনডেক্স অনুযায়ী, ভাষার (পিএলআই স্কোর) সাথে প্রতিযোগী সক্ষমতার সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। এতে উঠে এসেছে সবচেয়ে প্রতিযোগী গুণের শীর্ষ ১০ অর্থনীতির মধ্যে চারটিতেই ইংরেজি হলো আনুষ্ঠানিক ভাষা। বাকি ছয়টি দেশে হয় ইংরেজিতে দক্ষ জনসংখ্যা অথবা এই ভাষাভাষীর আধিক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম জাপান।
ভাষার দক্ষতা বৈশ্বিক অভিজাত শ্রেণির গড়নেও রেখেছে বড় ভূমিকা। যেমন বৈশ্বিক পালাবদলে ভূমিকা রাখা অধিকাংশই হলেন ইংরজিভাষী। সে তুলনায় বড় জনসংখ্যা নিয়েও ইংরেজির দক্ষতা নিম্ন এমন দেশের জিডিপি বা তাদের বিলিয়নিয়ার সংখ্যা প্রত্যাশার চেয়ে কম। আবার বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণের বেশিরভাগ আলোচনাই হয় ইংরেজিতে। ফলে এ ভাষায় দক্ষ নয় এমন জাতির স্বার্থ সেখানে উপেক্ষিত হওয়ার সুযোগ থাকে।
- সূত্র: ডব্লিউই ফোরাম অবলম্বনে