চিরায়ত প্রথা ভাঙলেন প্রিয়া: ঘোড়ায় চড়ে বিয়ের আসরে কনে!
সোনালি-হলুদ লেহেঙ্গা ও মাথায় লাল পাগড়ি পরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বিয়ের আসরে হাজির প্রিয়া আগারওয়াল। বিয়ের আমেজ পুরোদস্তুর ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে। কিন্তু বিয়ের দিনেই খবরের শিরোনাম হয়েছেন ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ২৭ বছর বয়সী এই নারী। কারণ তিনি বিয়ের আসরে প্রবেশ করেছেন ঘোড়ায় চড়ে! আর এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন ভারতীয় সমাজের হাজার বছর পুরনো পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম।
চলতি মাসের শুরুতে হরিয়ানার আম্বালায় বিয়ের পিঁড়িতে বসেন প্রিয়া আগারওয়াল। যেখানে ভারতীয় সমাজে অহরহ দেখা যায়, মহা ধুমধামে ঘোড়ায় চড়ে বিয়ের আসরে প্রবেশ করছেন বর; সেখানে প্রিয়া নিজেই সাদা মাদি ঘোড়ায় চড়ে নাটকীয় এন্ট্রি নিয়েছেন!
বিয়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর দেখা যায়, ঘোড়ার পিঠে পা ছড়িয়ে বসে উল্লাস করছেন প্রিয়া, তার পাশে পাশেই হাঁটছেন এবং গানের তালে নাচছেন স্বজন ও বন্ধুরা।
সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে প্রিয়া বলেন, "আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম। এদেশের প্রতিটা ছেলেই স্বপ্ন দেখে, সে বিয়ের দিন ঘোড়ায় চড়ে বরযাত্রী হিসেবে আসবে। কিন্তু কনেদের ক্ষেত্রে এমনটা হয়ই না। আমার নিজেকে একজন সম্রাটের মতো মনে হচ্ছিলো! মনে হচ্ছিলো আমি একজন সেনাপতি যে কিনা তার দলের শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছে!"
তবে প্রিয়া আগারওয়ালই ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিয়ের আসরে আসা প্রথম নারী নন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এরকম আরও কিছু ঘটনা ঘটলেও তা লোকের নজরে পড়েনি।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে ঘোড়ায় চড়ে বরযাত্রী নিয়ে আসাকে 'বারাত' বলা হয়ে থাকে।
বিবাহ আচার ও নীতি সম্পর্কিত একটি বইয়ের লেখক রাম নারায়ণ কগাতা বলেন, "বিয়ের এই দিনটা বরের জন্য বিশেষ দিন। তাকে খুব বিশ্বস্ত একজনের সাথে তুলনা করা হয়, যে কিনা আড়ম্বর সহকারে আসবে এবং নববধূকে নিয়ে যাবে। তার গায়ে থাকবে সিল্কের জমকালো পোশাক এবং নানা অলঙ্কার, আর কোমরে থাকবে তলোয়ার। যদি কোনো অশুভ শক্তি নববধূকে চুরি করার চেষ্টা করে তাহলে বর তা প্রতিহত করবে।"
রাজস্থান ও হরিয়ানার কিছু কিছু এলাকায় বিয়ের আগে একদিন কনেকে ঘোড়ায় চড়িয়ে তার বাড়ির আশেপাশে ঘুরানো হয়। কিন্তু নারায়ণ কগাতা জানালেন, বিয়ের আসরে ঘোড়ায় চড়ে এর আগে কোনো কনেকে আসরে দেখেননি তিনি।
বিবাহ বিশেষজ্ঞ নীতা রাহেজার ভাষ্যে, ভারতীয় নারীরা লজ্জাবশত এসব প্রথার বাইরে পা রাখে না। কিন্তু ঘোড়ায় চড়ে বিয়েতে আসাও একটা সাহসী পদক্ষেপ।
তিনি আরও বলেন, "এখনকার দিনে কনেরা মাথা নিচু করে বিয়ের আসরে প্রবেশ করে না। বরং ধুমধাম করে, বাদ্য-বাজনা সহযোগে আসরে ঢোকে। কনের সঙ্গীসাথীরা দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকে ফুল নিয়ে, তাকে উৎসাহ দেয়।"
কিন্তু রাহেজা মনে করেন, ঘোড়ায় চড়ে বিয়েতে আসার মাধ্যমে একটি নারীবাদী অবস্থান নিয়েছেন প্রিয়া আগারওয়াল, "এখানে বার্তাটা খুব স্পষ্ট। তিনি বলতে চাইছে যে, হ্যাঁ, আমিও তোমাদের সমান।"
এদিকে প্রিয়া জানিয়েছেন, পরিবার থেকে বাধা নয়, বরং তার বাবা নারিন্দার আগারওয়ালই তাকে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
পেশায় ব্যবসায়ী নারিন্দার জানান, তিনি লিঙ্গ সমতায় বিশ্বাসী। তিনি বলেন, "আমি আমার মেয়েকে কখনো ছেলের চাইতে আলাদা দৃষ্টিতে দেখিনি। গত বছর আমার ছেলে নিজের বিয়েতে ঘোড়ায় চড়ে এসেছিল, আমার মেয়েও তার বিয়েতে সেটাই করেছে।"
ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে পুরুষতান্ত্রিকতার মাত্রা অনেক বেশি। এখানে মেয়ে শিশুদের যথাযথ যত্ন নেওয়া হয় না। নব্বইয়ের দশকে যখন প্রিয়ার জন্ম হয়, তখন রাজ্যে নির্বিচারে মেয়ে শিশুর ভ্রুণ হত্যা করা হতো। বেশিরভাগ পরিবারের চাওয়া ছিল শুধু ছেলে সন্তান। ২০০১ সালের এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, ০-৬ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে আম্বালায় প্রতি ১০০০ জন ছেলের বিপরীতে মেয়ে আছে মাত্র ৭৮১ জন।
কিন্তু আগারওয়াল বলেন, প্রিয়ার জন্মের সময় তার পরিবারে উৎসবের রোল পড়ে যায়। হাসপাতালে মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে তারা সেই আনন্দ উদযাপন করে্ন। নিজের মেয়েকে 'লাকি চার্ম' বা ভাগ্যবতী মনে করেন প্রিয়ার মা।
তিনি বলেন "আমার মেয়ে হবে শুনে যখন আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই, সেটা দেখে হাসপাতালের অনেক বয়োঃবৃদ্ধরা ভেবেছিলেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! আমার মেয়ে যে ঘোড়ায় চড়ে বিয়ের আসরে গেছে, তার জন্য আমি গর্বিত।"
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন প্রিয়ার এই শোভাযাত্রার ভিডিও ভেসে বেড়াচ্ছিল, সেটি লাইভ দেখেছেন তার বর আরব গুপ্ত। পেশায় আইনজীবি আরব হাসতে হাসতে জানান, প্রিয়া ও তার পরিবার এটি সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছিল, সুতরাং তার কোনো ধারণাই ছিল না এই এন্ট্রি সম্পর্কে!
তিনি বলেন, "আমি আমার পরিবার-পরিজনকে নিয়ে এটা দেখেছি। আমরা খুব চমকে গিয়েছিলাম, আবার ভালোও লেগেছে। আমি খুবই গর্বিত ছিলাম যে, আমি এমন একজন সাহসী নারীকে বিয়ে করছি।"
সূত্র: বিবিসি