হপ্তাবারের লালপাহাড়, টি টোকেন আর মাধবপুর লেক
চা গাছের সবুজ ছুঁয়ে বুক পেতে রাখা পাহাড়ে যখন উঠলাম, অবাক না হয়ে পারলাম না। মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার মতো সৌন্দর্য বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। তার ওপর পাহাড়টির মাথায় চড়ে আছে এক শিবমন্দির। সুজন গোয়ালা (ছদ্মনাম) আমাদের গাইড হয়েছিলেন আপনা থেকেই। কথা না বলে থাকতেই পারছেন না। বেশিরভাগই অবশ্য নিজের কথা- এখন আর কাজ করি না বাগানে। বউ করে। ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়েছি শরীরের রক্ত পানি করে। তবে ছেলে এমন এক ড্যাগার মেরেছে, এই হৃদপিণ্ডের ঠিক মধ্যিখানে।
কীভাবে মারল? শুধালাম, ছেলেটা বিয়ে করেছে ইচ্ছেমতো। বউটা আপন হয়নি। নাতিটাকে সুজন ভালোবাসেন খুব কিন্তু ছেলে- ছেলেবউয়ের ভয়ে ঠিকমতো আদরও করতে পারেন না।
সুজন গোয়ালা আরো বললেন বাগানের নতুন ম্যানেজারের কথা। ৩০ জন লেবারের কাজ করিয়ে নেয় ২০ জনকে দিয়ে। তাতে লেবারদের মুখে রক্ত উঠে যায় কিন্তু ম্যানেজার বাবু গা করে না। তবে সুজন ভালো পায় ছোট ম্যানেজারকে। দেবতার মতো মানুষ তার কাছে।
লাল পাহাড়ের গা বেয়ে চলতে চলতে বেশ বয়সী এক লিচু গাছ পাওয়া গেল। রোদ তখন মাথার ওপর। চা বাগানের শেড ট্রিগুলো রোদ ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। ফাল্গুনের টুকটাক বাতাস পাওয়া যাচ্ছে বলে কিছু রক্ষে। চলতে চলতে ম্যানেজার বাংলোর কাছে চলে এলাম। টিনের চালের ঢাকা বাংলোটা বেশ বড়, সামনেটায় বাগানও আছে। ভিতরে যেতে চাইলাম। সুজন গোয়ালা ভয় দেখালেন, বললেন ঢুকতে দিবে না।
তাই ইচ্ছেটা শিকেয় তুলে চলে এলাম বাগানের অফিস এলাকায়। একটা ভবনে বেশ কিছু নারী-পুরুষকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে দেখলাম। উৎসুক হয়ে তাকালাম সুজনদার দিকে। তিনি বললেন, আজ হপ্তাবার। মানে দাঁড়াল আজ বুধবার সপ্তাহের টাকা নিতে এসেছে বাগানের লেবাররা। এখন অবশ্য চা তোলার মৌসুম নয়। সুজনদার কাছেই জেনেছি বৈশাখের ১০ তারিখ থেকে আবার চায়ের পাতা তোলার কাজ শুরু হবে।
তাহলে এখন কিসের হপ্তা?
সুজনদা: হাবিজাবি কাজ, মানে বাগানে বেড়া দেওয়া, নালা পরিস্কার করা, বাগানে পানি দেওয়া ইত্যাদি কাজে যারা নিয়োজিত তারা হপ্তা পাচ্ছে।
লাল পাহাড়ের এই চা বাগানটির নাম ফুলছড়া। চায়ের রাজধানী বলে চেনা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় সদরের কাছেই এ বাগান। সারা দেশে যে ১৬৪টি চা বাগান আছে তার মধ্যে চল্লিশটিই শ্রীমঙ্গলে। সিলেটের মালনিছড়ায় চা বাগান হয় ১৮৫৪ সালে।
তারপর শ্রীমঙ্গলে চা বাগান গড়ে উঠতে থাকে। ব্রিটিশ আমলের শুরুর দিকে সিলেটসহ শ্রীমঙ্গল ঢাকা বিভাগের অধীন ছিল। ১৮৭৪ সালে ওই অঞ্চল আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। দেশের সবচেয়ে শীতল ও বৃষ্টিপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত শ্রীমঙ্গল। চা বাগানের শ্রমিকদের অধিকাংশই অবাঙালি। ব্রিটিশ আমলে তাদেরকে মধ্যভারত মানে বিহার, ছত্তিশগড় থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। কুলি নামে পরিচিত চা শ্রমিকরা বাগানের মধ্যে বাস করে। সারাদেশের মোট ৩ লাখ বাগানির ৭৫ ভাগই নারী। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান চা গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে এর নাম হয় বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট বা বিটিআরআই। ফুলছড়া চা বাগান থেকে বিটিআরআই খুব বেশি দূরে নয়। শ্রীমঙ্গলের ৪০টি বাগান থেকে বছরে প্রায় ৩ কোটি ২১ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়। দেশের দ্বিতীয় চা নিলাম কেন্দ্র চালু করা হয়েছে শ্রীমঙ্গলে।
চা বাগানের লেবার, শ্রমিক বা কুলিরা ২০১৬ সালেও দিনে মজুরি পেত আশি টাকার কম। এখন অবশ্য সোয়াশ টাকার মতো পায়। তাদের দিন বলতে ১২ ঘণ্টা প্রায়।
নীলকণ্ঠ যাবো বলে সুজনদা আর সঙ্গে থাকবেন না। আশি টাকা গাইড-ফি নিয়ে তিনি বিদায় নেওয়ার পরপর বাগানের অস্থায়ী বাজারটি দেখতে পেলাম। সেখানে শাক-সবজি আর চুরি ফিতার রকমারী পণ্য সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। হয়তো হপ্তাবার বলেই বসেছে এ বাজার। সনির একটা পুরোনো ডবল অডিও ক্যাসেট প্লেয়ার দেখে সঙ্গী মুনিয়া দাঁড়ালো কিছুক্ষণ। অনেকদিন পর যন্ত্রটা আবার দেখতে পেয়েছে সে। তখনো দোকানী ক্যাসেট বাজায়নি। সম্ভবত গাছগাছড়া বিক্রি করবে। খিদে পেয়েছে বলে দাঁড়ালাম না বেশিক্ষণ। নীলকণ্ঠে ১০ লেয়ারের চা পাওয়া যায়। প্রতি লেয়ারে ১০ টাকা করে দাম বাড়ে।
টি টোকেন
একসময় চালু ছিল টি টোকেন সিলেটের চা বাগানগুলোতেই বেশি আর এটা বাগান মালিকের লাভের জন্যই। প্রচলিত সরকারি মুদ্রায় শ্রমিকদের মজুরি দেওয়াটা ছিল মালিকদের জন্য অলাভজনক। তাই চা বাগানে তারা মজুরি হিসাবে ধাতব টোকেনের ব্যবহার শুরু করে। এটাই হলো টি টোকেন। তামা, দস্তা বা টিন দিয়ে তৈরি হতো টোকেনগুলো। আকারে হতো অষ্টকোণাকৃতির বা চন্দ্রাকৃতির, ত্রিভুজাকৃতির আর গোলাকারও হতো। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে এগুলো ছিল অচল। টোকেনের গায়ে ইংরেজীতে বাগানের নাম লেখা থাকত। সাধারণত রোমান হরফে লেখা হতো মুদ্রামান-১ আনা, ৪ আনা বা ৮ আনা।
আর. হিটন অ্যান্ড সন্স নামে বার্মিংহামের একটি প্রাইভেট টাকশালে এসব টোকেনের অনেকগুলোই তৈরি হয়েছিল, কিছু হয়েছিল কলকাতায়। টি টোকেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা পেত বাগান মালিকেরা। বাগানের বাইরে টোকেনগুলোর কোনো মূল্য না থাকায় শ্রমিকরা চাইলেও বাইরে যেতে পারত না মানে বাগান ত্যাগ করতে পারত না। অনেক বাগানেই তখন দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি দেওয়া হতো। আগের দিনের মজুরি-টোকেন পেত শ্রমিকেরা পরের দিন সকালে। বাগান মালিকদের নিয়োজিত এজেন্ট সপ্তাহে একবার বিনিময়মূল্য পরিশোধ করে দোকানদারদের কাছ থেকে টোকেনগুলো সংগ্রহ করে নিত।
দেশের নামী টি প্ল্যান্টার নাসিম আনোয়ার টি টোকেন নিয়ে একটি বই লিখেছেন, নাম হলো টি গার্ডেন টোকেনস মেথড অব পেমেন্টস (১৮৭২-১৯৩৮)। তাতে পাওয়া যাচ্ছে, ধাতব টি টোকেনের প্রচলন হয় ১৮৭০ সালে আর সবশেষ টোকেন লটের ফরমায়েশ দেওয়া হয়েছিল ১৯৩০ সালে। প্রথাটি অবশ্য টিকেছিল ১৯৫০ সাল অবধি। দেশভাগের পর সরকারি মুদ্রার ব্যাপক প্রচলনের ধকল আর সইতে পারেনি টি টোকেন। সিলেটের লুয়াইনি, উচাইল, রবি, শমশেরনগর, চাঁদপুর ও মুনু বাগানে টি টোকেনের প্রচলন নিশ্চিত হওয়া গেছে। এগুলোর টোকেন এজেন্টের নাম অক্টাভিয়াস স্টিল অ্যান্ড কোং। তারা ২৮টি বাগানে টোকেন সরবরাহ করত।
উল্লেখ্য নাসিম আনোয়ারের জন্ম ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রামে। ২০ বছর বয়সে তিনি জেমস ওয়ারেন কোম্পানিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হন। তিনি শ ওয়ালেস আর ডানকান ব্রাদার্সেও কাজ করেছেন। দেশের অনেক সফল চা বাগানের এগিয়ে যাওয়ার নেপথ্যের কারিগর তিনি, এসবের অন্যতম হলো কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট। তিনি মনে করেন সফল প্ল্যান্টার হতে গেলে অবশ্যই পরিশ্রমী হতে হবে আর শ্রমিকদের পরিচালনা করতে হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে। আরো বলেন, আমাদের গতানুগতিক প্ল্যান্টেশন থেকে সরে আসতে হবে। শ্রমিকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখার এটাই ভালো উপায়।
নাসিম আনোয়ারের শুরুটা হয়েছিল একজন স্কটিশ ম্যানেজারের অধীনে। তার নাম আলেকজান্ডার হেন্ডারসন। আলেকজান্ডারের বড় মেয়ে হেলেনই পরে ১৯৭৫ সালে হয় তার সহধর্মিনী। মধুচন্দ্রিমা উদযাপনে তারা মোটরসাইকেলে শিলং আর গোহাটি ঘুরে বেড়িয়েছেন।
শেষ হলো মাধবপুর লেক দিয়ে
ন্যাশনাল টি কোম্পানীর মাধবপুর চা বাগানের ভিতর মাধবপুর লেক। চা চাষে প্রচুর পানি লাগে। শ্রীমঙ্গল বৃষ্টিবহুল জায়গা হলেও ঢালু হওয়ায় পানি বেশি সময় আটকে থাকে না। তাই বাগান কর্তৃপক্ষ জলাধার তৈরি করান। মাধবপুর চা বাগান কর্তৃপক্ষও ১৯৬৫ সালে তিনটি টিলাকে বাঁধ দিয়ে পানি জমিয়ে গড়ে তোলেন মাধবপুর লেক। এর আয়তন ৫০ একর। লেকের পাড় ঘেঁষে হেঁটে বেড়ানোর সরু পথ আছে। এর পানিতে নীল পদ্ম ফুটে থাকে। হানিফ মোড়ল এবার আমাদের গাইড। সেটা ছিল ভ্রমণের তৃতীয় দিন।
আসলে তিনি মূলত অটোরিকশা চালক। শ্রীমঙ্গল সদর থেকে লাউয়াছড়া বনের পথ ধরে ভানুগাছ হয়ে যাওয়া যায় মাধবপুর লেক। কিন্তু হানিফ নিয়ে গেল লেমন গার্ডেন পার করে নূরজাহান টি এস্টেটের ভিতর দিয়ে। প্রায় ১২ কিলোমিটার পথের পুরোটাই চায়ের সবুজে সয়লাব। দুপাশেই চায়ের সবুজ টিলা। মিহি বাতাস বইছে, চোখেযেন সবুজের ঘোর লেগে গেছে। মাধবপুর লেকে পৌঁছাতে বিকাল গড়িয়ে গেল। খুব ভালো করে দেখার আগেই যেন ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে গেল।