ধ্রুবর খেলাঘর: গয়না বিক্রির টাকায় যেখানে চলে একদল শিশুর পড়াশোনার খরচ
খেলাঘর কথাটি শুনলেই আমাদের মনে আসে, এমন স্থান যেটি বাচ্চাদের খেলার জন্য তৈরি; কিন্তু ধ্রুব'র খেলাঘর এর ব্যতিক্রম। খেলাঘর নাম দেওয়া হলেও কয়েকজন শিশুর পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যত গড়ার পরিকল্পনা থেকে গৃহীত হয়েছে এই উদ্যোগ। আর এই কাজটি করতে যিনি লড়ে যাচ্ছেন, তিনি নিজেও কিন্তু শিশু অবস্থায়ই এটি শুরু করেন।
ধ্রুব সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। সে পড়াশোনা করছে ঢাকা কমার্স কলেজে। ধ্রুবর খেলাঘর যখন শুরু করা হয় তখন এই উদ্যোক্তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা যখন নিজেদের পড়াশোনার অবসরে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, আড্ডায় সময় কাটাচ্ছে, তখন এই বয়সের এক তরুণ পড়াশোনার পাশাপাশি টিপ, গয়না, মালা, চুরি, দুল বানিয়ে সেগুলো বিক্রি করে যাচ্ছে। ধ্রুবর এই অবিরাম কাজ করে যাওয়ার পেছনে উদ্দেশ্য একটাই- তাকে তার দায়িত্বে থাকা আরও ছয় শিশুর পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে হবে; এরা প্রত্যেকেই যেন ধ্রুবর কাছে তার নিজের বোন।
ধ্রুবর খেলাঘরের শুরু যেভাবে
ধ্রুব ছোটবেলা থেকেই অন্যদের জন্য ভাবতো। তার বয়সী ছেলেমেয়েরা যখন টাকা জমিয়ে নিজেদের শখ পূরণে ব্যস্ত, সেসময় ধ্রুব চিন্তা করতো কীভাবে সে অভাবগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করবে, তাদের পাশে দাঁড়াবে। তার এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত রূপ নেয় যখন সে দেখতে পায় অর্থাভাবে তার বাসায় দারোয়ানের দায়িত্বে থাকা মানুষটির মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ধ্রুব ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসত। মাঝেমধ্যেই সে টিপের মধ্যে রং দিয়ে বিভিন্ন নকশা আঁকত মায়ের জন্য। সেখান থেকেই ধ্রুবর মাথায় আসে টিপ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করলে কেমন হয়! সেই ভাবনা থেকেই খোলা হয় 'ধ্রুব'র খেলাঘর' ফেসবুক পেজটি।
প্রথম একমাস টিপ এঁকে বিক্রি করে ধ্রুব, প্রতিটি টিপের মূল্য ছিল ১০ টাকা। তারপর টিপ কেটে কেটে সেগুলোকে ডিজাইন করা এবং তার সাথে সংযুক্ত হয় কাঠের মালা। এভাবে ধীরে ধীরে ধ্রুব পুতির মালা, কানের দুল, হাতের বালা, পার্লের তৈরি বিভিন্ন গয়নার সেট বানাতে শুরু করে। প্রথম দিকে 'ধ্রুব'র খেলাঘর' পেজটিতে মাত্র ১ হাজার লাইক থাকলেও আস্তে আস্তে সেটি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪২ হাজারের কাছাকাছিতে।
ধ্রুবর ভাষ্যে, "আমি যখন প্রথমে এই কাজটা শুরু করি তখন আমার পরিবার ও আশেপাশের মানুষদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। কেউ কেউ আবার বলেছিল কেন ছেলে হয়ে মেয়েদের গহনা বানাচ্ছি? আমি তখন তাদেরকে বলেছিলাম আমার মা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন যেকোনো কাজ যা অন্যের উপকারে করা হয় তা সবসময়ই ভালো কাজ বলে গণ্য। তাই কোনো কাজই আমার কাছে ছেলেদের বা মেয়েদের বলে বিভাজন নেই"।
ধ্রুব ছোটবেলায় খুব কাছ থেকে দেখেছে তাদের মায়ের সংগ্রাম। তার মা পড়াশোনা, সুযোগ-সুবিধায় পিছিয়ে থাকা মেয়েদের সাহায্য করতেন। ধ্রুব নিজের মাকে দেখে অনুপ্রেরণা পায়। প্রথম দিকে একজন, দু'জন করে ১০-১৫ জনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিল স্কুলপড়ুয়া ধ্রুব। সেখান থেকে অনেকেই নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে ধ্রুবর ওপর থেকে নিজেদের দায়িত্বভার তুলে নিয়েছে। প্রথম যে মেয়েটির পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়ে ধ্রুব 'ধ্রুব'র খেলাঘরের' যাত্রা শুরু করেছিল, সেই সীমা নামের মেয়েটি ও ধ্রুব একসাথে গতবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দুজনেই এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। শুধু অন্যদের পড়াশোনার দায়িত্ব না, ধ্রুব নিজের পড়াশোনার খরচও নিজের উপার্জিত অর্থ থেকেই বহন করে। ধ্রুবর স্বপ্ন সে একদিন বড় একজন আর্টিস্ট হবে। স্বপ্ন পূরণে ফ্রান্সে গিয়ে আর্টের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য এখন থেকেই ছোট্ট ধ্রুব টাকা জমাতে শুরু করেছে।
প্রথম দিকে ছোট্ট ধ্রুব একা হাতে সবটা সামলে উঠতে পারেনি, তাই তার মা তখন তাকে সার্বিকভাবে সাহায্য করতেন। গয়না বানানোর বিভিন্ন সরঞ্জাম কোথায় কী পাওয়া যায় তা খুঁজে বের করতে ও কিনে আনতে ধ্রুব মায়ের সাহায্য নিয়েছিল। ধ্রুবর মা, তামান্না সেতু যিনি ছেলের এই উদ্যোগে সবসময় পাশে থেকে সহযোগিতা করে গেছেন- তিনি বলেন, "আমি মাঝে মাঝে অবাক হই আমার সেই ছোট্ট ধ্রুব আজ কতো বড় হয়ে গেছে, অন্যদের দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। আগে সবাই ধ্রুবকে আমার ছেলে পরিচয়ে চিনতো কিন্তু এখন অনেকে আমাকে চিনে ধ্রুবর মার পরিচয়ে। এটা আমার কাছে মা হিসেবে গর্বের যে আমার ছেলেকে মানুষ ভালোবাসছে, সে তার কাজ দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছে। আমি চাই এভাবেই ধ্রুব একদিন আরও বাচ্চাদের দায়িত্ব নিক।"
ঘরে বসে গয়না বানালেও ধ্রুব'র খেলাঘরের বেশিরভাগ গয়নাই তৈরি হয় ভারত ও চীন থেকে আমদানি করা পার্ল, সিলভার ও স্টোন থেকে। ধ্রুব'র খেলাঘরের মতোই মা-ছেলের আরেকটি সহ-উদ্যোগ 'রেনুবালা'। রেনুবালায় শুধু পার্লের তৈরি গয়না যেমন- কানের দুল, গলার মালা, ব্রেসলেট ইত্যাদি পাওয়া যায়।
ভারতীয় বিভিন্ন ডিজাইনের গয়নাও পাওয়া যায় ধ্রুব'র খেলাঘরে। জয়পুরি গয়নার সেট, বাহারি রঙের মিনা করা গয়না এর মধ্যে অন্যতম। প্রতিটি গয়নার সেট বানাতে ধ্রুবর সময় লাগে সর্বনিম্ন ১০-১৫ মিনিটের মতো। আবার কিছু কিছু গয়না আছে যেগুলোতে সময় ব্যয় হয় এক থেকে দেড় ঘণ্টার ওপর। শুরুতে ধ্রুব একাই সব গয়না বানানোর কাজ করলেও বর্তমানে কারিগর হিসেবে দু'জন মেয়ে ধ্রুবকে সাহায্য করে। ভাই হিসেবে এই দুজনের পড়াশোনার দায়িত্বও নিয়েছে ধ্রুব।
ধ্রুব তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পাশে পেয়েছে চেনা-অচেনা অনেক মানুষকে, ভালবেসে তাদের সবাইকে ধ্রুব ডাকে 'খালামণি'। সম্পর্কে আত্মীয় বা পরিচিত না হলেও তারা ধ্রুবকে আপন করে নিয়েছে এবং তার কাছ থেকে নিয়মিত গয়না কিনে তার মহৎ উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে; এদের মধ্যে রয়েছেন একাধিক জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পীও।
বিশ্বাসই ছিল ভরসা
'ধ্রুব'র খেলাঘর' শুরু থেকেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ক্যাশ অন ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে ডেলিভারির জন্য ৫০% বা সম্পূর্ণ টাকা আগে পরিশোধ করতে হয়, ধ্রুব'র খেলাঘর সেখানে তাদের পণ্য আগে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেয় কোনরকম অগ্রিম ডেলিভারি চার্জ ছাড়াই। ক্রেতাদের পছন্দ হলে তারপর তারা টাকা পাঠিয়ে দেন। এজন্য অনেক সময় টাকা পেতে দেরি হয়, আবার অনেক ক্রেতা একসাথে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করেন না।
ধ্রুব জানায়, "আমি এই কাজটি করি সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে। আমার বিশ্বাস আমার এই কাজের উদ্দেশ্য যারা জানেন তারা কখনো আমাকে ঠকাবেন না। তারপরেও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিমাসেই ঘটে। অনেকেই পণ্য নিয়ে আর যোগাযোগ করেন না, যোগাযোগের নম্বরটি বন্ধ করে রাখেন। কিন্তু সে সংখ্যা খুবই কম। তারপরেও আমি বিশ্বাস হারাইনি। তাই ধ্রুব'র খেলাঘর আগে পণ্য পাঠানোর নীতিতেই কাজ করে যাবে।"
বাংলাদেশ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, উত্তর আমেরিকা ও ভারতে ধ্রুবর অনেক ক্রেতা রয়েছেন যারা নিয়মিত এখান থেকে পণ্য অর্ডার করে থাকেন। প্রতিমাসে ভারত থেকে অন্তত ২০ জন ক্রেতার অর্ডার আসে ধ্রুব'র খেলাঘরের কাছে। একবার দেশের বাইরে থেকে ধ্রুব'র খেলাঘরে ৪৬ হাজার টাকার অর্ডার এসেছিল। সেখানেও যথারীতি কোনরকম অগ্রিম (এডভান্সড) টাকা নেওয়া ছাড়াই পণ্য পাঠানো হয়।
ধ্রুবর মা জানান, "দেশের বাইরে ফেডেক্স, ডিএইচএল সার্ভিস ব্যবহার করে আমরা পণ্য পাঠিয়ে থাকি। সেক্ষেত্রে পণ্য পৌঁছাতে ও তারপরে আমাদের কাছে টাকা আসতে অনেকটা সময় লেগে যায়। কিন্তু আমার ছেলে ধ্রুবর বিশ্বাস তার থেকে পণ্য নিয়ে টাকা পাঠাতে দেরি হলেও মানুষজন তাকে ঠকাবে না। সেই বিশ্বাস থেকেই সে এখনো পণ্য পাঠিয়ে যাচ্ছে।"
করোনাকালীন দুই বছর ধ্রুব'র খেলাঘরকে নানারকম সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। গয়না বানানোর সরঞ্জাম দেশের বাইরে থেকে আনা সম্ভব হয়নি সেসময়, তাই কাজ অনেকটাই থেমে ছিল। আবার দেশের বাইরে ও ভেতরে তখন ডেলিভারি সার্ভিসগুলো তাদের সেবা বন্ধ রাখার ফলে ঠিক সময়ে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠানোও সম্ভব হয়নি। গয়নার ওজন ও আকার তেমন বড় না হওয়ায় প্রায় সময় সেগুলো কুরিয়ার সার্ভিস থেকে হারিয়ে যায় বা অন্য ভারি জিনিসের চাপে ভেঙ্গে যায়। যার জন্য ধ্রুবকে বেশ লোকসান গুনতে হয়।
শুধু গয়না বানানোর কাজই নয়, ধ্রুব এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের ছবি আঁকা শেখাচ্ছে। ভবিষ্যতে ধ্রুবর ইচ্ছা তার 'ধ্রুব'র খেলাঘর' এর জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় শো-রুম খুলবে, যেখানে ক্রেতারা নিজেরা এসে সামনে থেকে দেখে পণ্য বাছাই করতে পারবে। এভাবেই ছোট ধ্রুব বড় বড় দায়িত্ব পালন করে অন্যের জন্য অবদান রেখে যাচ্ছে।