বাংলাদেশের শিখ সম্প্রদায়: ৫০০ বছরের নিভৃত জীবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গুরুদুয়ারায় ঢুকে তাপস লাল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। তিনি বাংলাদেশের গুরুদুয়ারা ম্যানেজমেন্ট কমিটির ম্যানেজার। কয়েক মিনিটের মধ্যে একজন যুবক এসে পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনিই তাপস।
আমার বিভ্রান্ত চেহারা দেখে তাপস হেসে বললেন, 'হ্যাঁ, আমি পাগড়ি-কুর্তা পরি না, আমার লম্বা চুল-দাড়ি নেই, তবু আমি শিখ।'
স্বীকার করতে হবে, তার কথায় একটু বিব্রতই হয়েছিলাম। কারণ আমি আশা করেছিলাম, হাতে স্টিলের বালা আর পাগড়ি-কুর্তা পরা লম্বা দাড়িওয়ালা কাউকে দেখব।
তবে খানিক বাদেই জালাম, শিখ ধর্মের দুটি পথ বা পান্থ আছে—উদাসী ও আকালি। উদাসীর অনুসারীরা ৫ 'ক' পরেন না। পাঁচ 'ক' হলো—কঙ্গ (কাঠের চিরুনি), কারা (লোহা/ইস্পাতের বালা), কৃপাণ (ইস্পাতের ছোট তলোয়ার), কাচ্ছা (সুতির অন্তর্বাস) এবং কেশ (না-ছাঁটা চুল)। আকালির অনুসারীরা এই পাঁচ 'ক' পরে।
বাংলাদেশের শিখ সম্প্রদায়ের সিংহভাগই উদাসী পথের অনুসারী। তাপসও তা-ই।
তাপস সম্পর্কে সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য সম্ভবত এটা যে তিনি হিন্দু (বা সনাতন) বিশ্বাসেরও অনুসারী। অর্থাৎ তিনি দুর্গা-পূজা এবং অন্যান্য হিন্দু আচার পালনের পাশাপাশি শিখ ধর্মও পালন করেন।
তাপস জানালেন, 'কোনো নির্দিষ্ট একটা ধর্মের পরম সত্য বা এক ঈশ্বরের উপর একচেটিয়া অধিকার রয়েছে—শিখ ধর্ম এই দাবির ধারণাকে স্বীকার করে না। মূল বিশ্বাসের মধ্যে আছে এক স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস এবং সমস্ত মানবজাতির সমতা, সবার সুবিধা ও সমৃদ্ধির জন্য ন্যায়বিচারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং সৎ আচার ও জীবিকা। আর প্রতিটি ধর্ম এবং বিশ্বাসের মানুষের জন্য দরজা খোলা।'
দশ গুরু ও একটি পবিত্র গ্রন্থ
বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ধর্মগুলোর একটি শিখধর্ম। এই ধর্ম সুফি ও ভক্তি চিন্তাধারার সংমিশ্রণ। পাঞ্জাবি ভাষায় শিখ অর্থ শিক্ষার্থী বা শিষ্য। আর যারা শিখ সম্প্রদায়ে যোগ দিয়েছে—অর্থাৎ পান্থরা এমন লোক যারা আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার সন্ধানে থাকে।
এ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক দেব। তিনিই প্রথম গুরু হিসেবে পরিচিত। গুরু নানকের পর ১৫ শতকের শেষ দিক থেকে ১৭০৮ সাল পর্যন্ত ২৫০ বছরে ১০ জন গুরুর হাত ধরে এ ধর্ম বিকশিত হয়।
গুরু গোবিন্দ সিং ছিলেন শিখ ধর্মের শেষ গুরু। তিনি ১৭০৮ সালে শিখধর্মের পবিত্র গ্রন্থ 'শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিব'কে চূড়ান্ত শিখ গুরু হিসাবে মনোনীত করেন। পঞ্চম গুরু, গুরু অর্জুন ১৭ শ্তকে প্রথম এই পবিত্র গ্রন্থটি সংকলন শুরু করেন।
গুরু গ্রন্থ সাহিব-এ ১,৪৩০টি অঙ্গ (পৃষ্ঠা), ৫,৮৯৪টি শব্দ (লাইন রচনা) রয়েছে। এই শব্দগুলো ছন্দময় উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ফর্মে কাব্য আকারে সংকলিত করা হয়েছে।
শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিব হলো ছয় শিখ গুরুর শ্লোকের সংগ্রহ। এই ছয় গুরু হলেন গুরু নানক, গুরু অঙ্গদ, গুরু অমর দাস, গুরু রাম দাস, গুরু অর্জুন ও গুরু তেগ বাহাদুর। এতে হিন্দু ভক্তি আন্দোলনের ১৩ জন সন্ত কবি ও দুজন মুসলিম সাধু কবির স্তোত্র ও শ্লোকও রয়েছে।
তাপস জানালেন, যে-কেউ চাইলেই এ গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারে না। কোনো সম্প্রদায় গুরুদুয়ারা স্থাপন বা গুরু গ্রন্থ রাখতে চাইলে তার জন্য ভারতের অমৃতসরের গুরুদুয়ারায় আবেদন করতে হয়। অমৃতসর থেকে যোগাযোগ করে গুরুদুয়ারা ও গুরু গ্রন্থের যত্ন নেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ বা ব্যবস্থাপনা ক্ষমতা ওই সম্প্রদায়ের আছে কি না, তা যাচাই করা হয়। তারা সন্তুষ্ট হলেই কেবল আগ্রহী সম্প্রদায়কে গুরু গ্রন্থের অনুলিপি পাঠাবে।
প্রত্যেক গুরুদুয়ারায় পবিত্র গ্রন্থের একটি কপি থাকতে হয়। গুরুদুয়ারায় প্রতিদিন দুবার বইটি থেকে কিছু অংশ পড়া হয়—একবার সকালে ও আরেকবার সন্ধ্যায়। আর বিশেষ অনুষ্ঠানে, লঙ্গর (গুরুদুয়ারায় আসা সবাই ভাগাভাগি করে যে খাবার খায়) বা ভোজের দিন সারা দিনে গ্রন্থের পুরোটা পড়া হয়।
কিন্তু গ্রন্থিকে—পবিত্র গ্রন্থ পাঠের যোগ্য/বিশেষ পাঠকদ—তিন মাসের ভিসা নিয়ে এদেশে আসতে হয়। তারপর ভিসার মেয়াদ একাধিকবার বেড়ে সর্বোচ্চ এক বছরের জন্য পারমিট বাড়ে।
পবিত্র গ্রন্থটি গুরুমুখী ভাষায় লেখা। গ্রন্থিরা এ ভাষা শেখেন। সবাই এ গ্রন্থ পড়তে পারে না। আর বাংলাদেশে বেশিরভাগ প্রশিক্ষিত গ্রন্থিই আসেন ভারত থেকে।
বাংলাদেশে ৫০০ বছরের পুরোনো সম্প্রদায়ের সূচনা
১৪৬৯ সালে এক উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গুরু নানক দেবের।
কিংবদন্তি অনুসারে, 'পৈতা' পবিত্র সুতা পরার অনুষ্ঠানের সময় নানক তার বাবা-মার কাছে এমন একটি সত্যিকারের পবিত্র সুতা চেয়েছিলেন যা কখনোই পুরোনো হবে না, যা চিরকাল তার হৃদয়ে খোদিত হয়ে করা থাকবে।
কিন্তু চারপাশের বৈষম্য আর শোষণ দেখে নানক নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, ঈশ্বরই যদি সমস্ত মানুষকে সৃষ্টি করেন, তাহলে এই বর্ণপ্রথা কে সৃষ্টি করল? দুনিয়ায় এত দুঃখ-দুর্দশা কেন? নানক তখন নিজ সম্প্রদায় ছেড়ে একটি সত্য ধর্ম খোঁজার সিদ্ধান্ত নেন।
নিজের বাড়ি, পৈতৃক পরিচয় ত্যাগ করে তিনি বিশ্বভ্রমণে বের হলেন। ১৬ শতকের গোড়ার দিকে (১৫০৪ সালের দিকে) তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন। সফরকালে তিনি ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহে যাত্রাবিরতি নেন। এসব এলাকায় নানক স্থানীয় মানুষের জন্য কূপ খনন করেন। পরের ৫০০ বছরে ওই জায়গাগুলোতে আশ্রম বা গুরুদুয়ারা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত গুরুদুয়ারা নানক শাহী বাংলাদেশের প্রাচীনতম গুরুদুয়ারা হিসেবে স্বীকৃত।
নিভৃতে বাস করছে যে সম্প্রদায়
তাপস লাল চৌধুরী জানান, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ কিছু গুরুদুয়ার ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সে কারণে দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক শিখ দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়।
১৯৭১ সালে এমনই একটি ধ্বংসযজ্ঞে পুরান ঢাকার সঙ্গত টোলা গুরুদুয়ারা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের গুরুদুয়ারা ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক ব্যবস্থাপক পরেশ লাল বেগীর দাদাকে।
এই ধরনের ঘৃণ্য ঘটনায় অনেক শিখ ধর্মানুসারী ভয় পেয়ে গিয়েছিল এবং অনেকেই ওই সময়ে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। সময়ের সাথে সাথে শিখ জনসংখ্যা কমে যাওয়ার আরেকটি অন্তর্নিহিত কারণ এটি।
বাংলাদেশে ১৮টি ঐতিহাসিক গুরুদুয়ারা ছিল, কিন্তু এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র পাঁচটি। এই গুরুদুয়ারাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে পাঞ্জাবভিত্তিক দাতব্য সংস্থা কর সেবা সারহালি সাহিব। এই সংস্থাটি বিভিন্ন দেশের গুরুদুয়ারায় সেবা ও অন্যান্য সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ (বা সেবা) করে থাকে।
বাংলাদেশে শিখ ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা কত?
তাপস লাল চৌধুরীর জানালেন, বর্তমানে দেশে মাত্র ১৫-২০টি বাংলাদেশি শিখ পরিবার বসবাস করছে।
তিনি বলেন, 'ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে প্রায় ১৮-২০ হাজার লোক বাস করে। কিন্তু এই মানুষগুলোর সিংহভাগই এসেছে অস্থায়ীভাবে থাকার জন্য। বেশিরভাগই ব্যবসা, চাকরি এবং বিভিন্ন ভারতীয় হাইকমিশনে ডেপুটি হিসেবে এসেছে।
'এছাড়া আর একদল লোক আছে যারা ভারতীয় কিন্তু এই দেশে এসে বসতি স্থাপন করেছে।'
সিং বীর সিং শেষ দলভুক্ত। সিং যখন পাঞ্জাব থেকে প্রথম বাংলাদেশে আসেন তখন তিনি ছিলেন ২২ বছরের যুবক। ২০০৭ সালে কর সেবা সারহালি সাহিব তাকে কীর্তন গায়ক বা কীর্তন্য হিসেবে বাংলাদেশে পাঠায়।
গুরুদুয়ারায় যিনি পবিত্র রাগ গেয়ে থাকেন তিনিই কীর্তন্য। শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিবে মোট ৬০টি রাগ আছে। যে যন্ত্রের সাহায্যে রাগ বা শ্লোক গাওয়া হয় তাকে কীর্তন বলে।
সিং আর ভারতে ফিরে যাননি। চট্টগ্রামে কাঁকন দাস নামে এক বাঙালিকে বিয়ে করেন। স্ত্রী আর ১০ বছর বয়সি ছেলে ও ৩ বছর বয়সি মেয়েকে নিয়ে সিং এদেশেই স্থায়ী হয়েছেন। সিং এখন কীর্তন করেন। গুরুদুয়ারায় পবিত্র গ্রন্থও পড়েন তিনি। তার স্ত্রী কাঁকন স্কুল শিক্ষিকা।
জন্মভূমির কথা মনে পড়ে কি না, জানতে চাইলে সিং বলেলেন, 'বাড়ির কথা কার মনে পড়ে না? আমার পরিবারের সাথে যখন পাঞ্জাবে ছিল, তখন আমার স্ত্রী-ও ওর বাড়ি, ডাল-ভাত, বাংলায় কথা বলা মিস করেছিল। তারপর ওর জন্যই আমি বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।'
সিং আর কাঁকন আর কাঁকনকে কর সেবা সারহালি সাহেবের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী গুরুদুয়ার কাছে পাঞ্জাবী লেনে একটি অ্যাপার্টমেন্ট দেওয়া হয়েছে।
'তবে ১৪ বছর পর গুরপ্রীত [স্ত্রীকে তিনি এই নামে ডাকেন] এখন পাঞ্জাবী খাবার পছন্দ করে। আমরা সারসন দা সাগ [সরিষা পাতা], মাক্কি দি রোটি [ভুট্টার রুটি] এবং মাখন আর দুধ দিয়ে তৈরি লস্যি খাই,' হাসতে হাসতে জানালেন সিং।
তাদের সন্তানরাও বাংলা ও হিন্দিতে কথা বলে। তারা লস্যি পছন্দ করে। তাদের ছেলেও স্কুলে ভালোভাবেই পড়াশোনা করছে। স্কুলে কেউ তাকে বিরক্ত বা হয়রানি করে না।
সিং জানালেন, 'বাংলাদেশে আমার শিখ পরিচয়ের কারণে আমি কখনোই কোনো রকমের হয়রানি বা ওরকম কিছুর সম্মুখীন হইনি। ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতা ছাড়া এখানকার আর সবই ভালো লাগে।'
স্বীকৃতি নেই জাতীয় রেকর্ডে
তাপসের জাতীয় পরিচয়পত্রে তার ধর্ম হিসেবে 'হিন্দু' লেখা আছে। অথচ তিনি শিখ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চান। কিন্তু সে উপায় নেই।
'কেউ কেউ ধর্মীয় পরিচয় হিসেবে হিন্দু লেখে, আবার কেউ কেউ মুসলিম লেখে। মাত্র তিন বছর আগে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার সময় আমরা শিখকে আমাদের ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করার সুযোগ পাই,' বলেন তাপস।
সিং এখনও ভারতীয় পাসপোর্টের অধিকারী। তিনি এখনও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেননি। তাই এদেশে থাকার জন্য প্রতি বছরই তাকে নতুন করে অনুমতি নিতে হয়। সিংয়ের স্ত্রী জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হওয়ায় তার জন্য কাজটি তুলনামূলক সহজ।
কিন্তু গ্রন্থিরা সবসময়উই ভিসা নিয়ে সমস্যায় পড়েন। তাপস জানান, 'তাদেরকে তিন মাসের ভিসা দেওয়া হয়। এতে আমাদের খুব সমস্যা হয়ে যায়। গ্রন্থিদের দীর্ঘকালীন ভিসার সুযোগের জন্য আমরা বেশ কয়েকবার আবেদন করেছি, কিন্তু এখনও কোনো সমাধান পাইনি।'