কফি মেশিন হাতে ইউক্রেন থেকে ভারতে এলো যে কনে
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে তখন তুমুল বোমাবর্ষণ চলছে। এমনই এক দিনে আনা হোরোডেটস্কা (৩০) তার অ্যাপার্টমেন্টে তালা দিয়ে ভারতে চলে আসেন। সঙ্গে এনেছিলেন গুটিকয়েক টি-শার্ট আর একটি কফি মেশিন! এতোকিছু থাকতে কফি মেশিন কেন সে উত্তর মিলবে একটু পরই।
আইটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আনা যেদিন দিল্লি এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছলেন ক্যালেন্ডারের পাতায় সেদিন ১৭ মার্চ। আনাকে এয়ারপোর্টে স্বাগত জানান অনুভব ভাসিন (৩৩)। অনুভব পেশায় আইনজীবী।
সিনেমার মতো হাঁটু গেড়ে, আংটি পরিয়ে প্রেমিকা আনাকে সেদিনই বিয়ের প্রস্তাব দেয় অনুভব। কে জানে আনা যখন 'হ্যাঁ' বলেন, তখন অনুভবের কল্পনায়ও সিনেমার মতো ভায়োলিন বেজে চলছিল নাকি!
আনার এক বছর মেয়াদী ভিসায় উল্লেখ আছে, তার ভারত সফরের উদ্দেশ্য হলো, অনুভব ভাসিনকে বিয়ে করা। ঠিকই রোববার এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিয়ে সেরেছেন এই দম্পতি। এ মাসের শেষ দিকে আইনগত বৈধতার জন্য তারা আদালতে বিয়ে নিবন্ধন করবেন বলে জানিয়েছেন।
ভাবছেন কীভাবে দুই মহাদেশের দুই মানুষের হৃদয় এক হলো! এ যুগলের পরিচয় ২০১৯ সালে। আনা তখন 'সলো ট্রিপে' ভারতে এসেছিলেন। এক বারে প্রথম দেখা হয় আনা আর অনুভবের। পরিচয় শেষে ফোন নম্বর বিনিময়, ইনস্টাগ্রামে একে অপরকে অনুসরণ এবং বাকিটা ইতিহাস!
দুই মহাদেশের মাঝে ভৌগলিক বিভক্তি, মহামারি, কোয়ারেন্টাইন আর ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞা এবং সর্বশেষ আনার দেশে রাশিয়ান আগ্রাসন- এরপর কতোবার যে দেখা হতে হতে হয়নি দু'জনের!
২০২০ সালের মার্চে আনা তার একজন বান্ধবীর সাথে আবার ভারতে আসেন; সে সময় অনুভব তাদের আগ্রার তাজমহল এবং রাজস্থানের মরুভূমি ঘুরিয়ে আনে।
সে সময়ই ভারতে করোনা মহামারির ফলে লকডাউন শুরু হয়ে যায়। ফলে অনুভব আনাদের দিল্লিতে তার পরিবারের সাথে এসে থাকতে বলে।
"আস্তে আস্তে আমরা একে-অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। আমরা বুঝতে পারি, ব্যাপারটা শুধু আর পছন্দ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই- এটি তার চেয়েও বেশি কিছু। ও কিয়েভে ফিরে গেলেও আমরা তাই প্রতিদিন ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে শুরু করি", বলেন অনুভব।
পরের বছর দুবাইতে তারা ফের দেখা করেন। অনুভবও মাঝে একবার কিয়েভ যান। ডিসেম্বরে আনা আরেকবার ভারতে এলে অনুভবের মা নিজ থেকেই তাদের বিয়ে করে নেবার প্রস্তাব দেন।
তাই বলে সত্যিই যে সব এতো দ্রুত হয়ে যাবে, সে বিষয়ে ধারণা ছিলো না আনা-অনুভবের।
তার ওপর অনুভব হিন্দু এবং আন্না খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। ফলে ভারতীয় আইন অনুযায়ী, তাদের বিয়ে একটি বিশেষ আইনের অধীনে আদালতে নিবন্ধন করতে হবে আর তার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হতে এক মাসেরও বেশি সময় নিতে পারে।
সব ভেবে এ যুগল সিদ্ধান্ত নেন, মার্চের শেষে আনা ভারতে এসে এসব আইনি প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করবেন এবং কয়েক মাস পর পাকাপাকিভাবে ভারতে চলে আসবেন।
বিধি বাম! তখনই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে!
আনার ভাষ্যে, "আমরা জানতাম যে কূটনৈতিকভাবে সফল হওয়া যায়নি তবে ভেবেছিলাম যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হবে। আমাদের মধ্যে অনেকেরই বিশ্বাস ছিল আক্রমণগুলো সীমান্ত কেন্দ্রবর্তী হবে এবং কিয়েভ নিরাপদ থাকবে।"
কঠিন সে সময়ে
"২৪ ফেব্রুয়ারির সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে বোমাবাজির শব্দে। আমার মনে তখন প্রথম যে কথাটা আসে তা হলো, আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো! এরপর অনুভব আর অন্যদের মেসেজ দেখি; নিশ্চিত হই যে, আমাদের আক্রমণ করা হয়েছে।"
গোলাগুলির তীব্রতা বাড়লে পরের দিন আনা তার মা এবং পোষা কুকুরটি সাথে নিয়ে একটি বাঙ্কারে ওঠেন।
তিনি বলেন, "সেটি তখন লোকে-লোকারণ্য ছিল। কারফিউ দেওয়া ছিল এবং আমরা যে বাঙ্কার ছেড়ে যাব সে অনুমতিও দেওয়া হয়নি। শহরটি ধোঁয়ার গন্ধে আচ্ছন্ন ছিল, আমার রীতিমতো দম আটকে আসছিল।"
রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনা শুরু হতেই অনুভব বারবার আনাকে চলে আসার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল। কিন্তু প্রিয় কুকুরটিকে ফেলে আসতে আনার মন সায় দিচ্ছিল না।
এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে আনা নিজেই ভারতে চলে আসতে চাইলে তখন অনুভব তাকে নিরুৎসাহিত করেন।
"ততোদিনে পরিস্থিতি পুরোই বিগড়ে গেছিল। প্রায়শই গোলাগুলি হচ্ছিল। রেল স্টেশন অনেক দূরে ছিল, তাদেরকে সেখানে নেওয়ার জন্য কোনও ট্যাক্সি ছিল না। আমি ভয় পেয়েছিলাম যে, সে রাস্তায় বেরোলে বড় কোন বিপদের মুখে পড়তে পারে। তাই আনাকে বললাম, আপাতত তার বাঙ্কারে থাকাটাই নিরাপদ," বলে যান অনুভব।
কিন্তু পরদিন সকালে আনা একটি ট্যাক্সি খুঁজে পেয়ে স্টেশনে পৌঁছাতে সক্ষম হন। মা এবং কুকুরটিকে দাদুবাড়ির গ্রামে যাবার ট্রেনে উঠিয়ে আনা নিজেও পশ্চিমা সীমান্তে যাওয়ার ট্রেনে চেপে বসেন।
ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে প্রথমে স্লোভাকিয়া, তারপর পোল্যান্ডে যান আনা। সেখানে তাকে দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। সে সময়ে অনুভব ভারতীয় দূতাবাসে আনার ভিসা ম্যানেজ করার চেষ্টা করছিলেন। অবশেষে দিল্লির উদ্দেশে বিমান ধরার জন্য আনা ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে পৌঁছান।
"ফ্লাইটে পুরোটা সময় আমি দু'চোখের পাতা এক করতে পারি নি। আমি জানতাম যে, আমরা কোন কনফ্লিক্ট জোনের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম না। তবু আমার ভেতরে এতটা ভয় কাজ করছিল যে, মনে হচ্ছিল যে কোন সময় দুর্বৃত্তরা ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা বিমানটি আঘাত করতে পারে যাতে আমরা বিধ্বস্ত হয়ে যাব।"
একবার যুদ্ধ শেষ হয়ে এলেই আনা কিয়েভে গিয়ে তার প্রিয় কুকুরটিকে নিয়ে আসবেন।
কফি মেশিনটির কথা বলতে তো ভুলেই গেছিলাম। এই জুটির মতে তাদের ভালবাসার গল্পে আসল নায়ক আসলে এই কফি মেশিনই।
শুনুন আনার মুখে, "কয়েক মাস আগে যখন আমি দাদীকে আমার বিয়ের পরিকল্পনার কথা জানাই, তখনই তিনি আমাকে বিয়ের উপহারের জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলেন।
অনুভবের এসপ্রেসো ভীষণ পছন্দ, আমি তাই আমাদের বিয়ে উপলক্ষে একটি কফি মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেই। কিয়েভ ছাড়ার সময়ও আমি এটিকে ফেলে আসতে পারিনি। ঠিকই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।"
"আনা একজন ট্রেইনড মেকআপ আর্টিস্ট। অথচ এখানে আসার আগে ও ওর যতো দামী দামী মেকআপ প্রডাক্ট ছিল সব রেখে এই কফি মেশিনটি নিয়ে এসেছে। আমার তো মনে হয়, আমাদের ভালবাসায় 'রিয়াল হিরো' এই কফি মেশিনটাই," যোগ করেন অনুভব।
- সূত্র-বিবিসি