হারানো বুকলেট ও উর্দু ছবির ঝলমলে জহির রায়হান, শবনম, কবরী ও এহতেশামেরা
জাগো হুয়া সাভেরা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়। এজে কারদার পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৯ সালের মে মাসের ২৫ তারিখে। ছবির কাহিনি নেওয়া হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি থেকে। বাংলা থেকে কাহিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন জহির রায়হান আর ইংরেজি থেকে উর্দুতে অনুবাদ করেন পশ্চিম পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। এর শ্যুটিংও হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে আর প্রধান প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন খান আতাউর রহমান, তৃপ্তি মিত্র প্রমুখ। ছবিটি অস্কারেও মনোনয়ন পেয়েছিল। এরপর ১৯৬২ সালে আরেকটি উর্দু ছবি চান্দা তৈরি হয়। তারপর পূর্ব পাকিস্তানে একে একে অনেকগুলো উর্দু ছবি তৈরি হয়।
প্রথম রঙিন ছবি
জহির রায়হান সঙ্গম তৈরি করেন ১৯৬৪ সালে। ঈদ উল আযহাতে গোটা পাকিস্তানে ছবিটি মুক্তি দেওয়া হয়। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র এটি। রোজী সামাদ, হারুন রশীদ, সুমিতা দেবী এতে অভিনয় করেন। দারুণ বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছিল সঙ্গম। ওই বছরের ডিসেম্বরে মুক্তি পায় ক্যারাভান। পাকিস্তানের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এসএম পারভেজ পরিচালিত এই ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। নেপালের রাজপ্রাসাদে চিত্রায়িত হয়েছিল ছবিটি। হারুন ও শবনম জুটির এই ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন রবিন ঘোষ। পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি বাহানাও তৈরি হয়েছিল ঢাকায়। জহির রায়হান ছিলেন পরিচালক এবং সংগীত পরিচালনা করেছিলেন খান আতাউর রহমান। কবরী ছিলেন এ ছবির নায়িকা। ১৯৬৫ সালের ঈদুল আযহায় এটি মুক্তি পেয়েছিল। ব্যবসা সফল এটিও।
ঢাকায় তৈরি হওয়া আরেকটি উল্লেখযোগ্য উর্দু ছবি ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পেয়েছিল, নাম দর্শন। রহমান পরিচালিত এ ছবির জুটি ছিলেন শবনম-রহমান। খুবই ব্যবসাসফল এ ছবিটিতে বশির আহমেদের লেখা, সুর ও গাওয়া কয়েকটি গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। চলচ্চিত্র ইতিহাসকাররা জানাচ্ছেন, ঢাকায় তৈরি শেষ উর্দু ছবির নাম জ্বলতে সূরয কে নিচে। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৪ সালে জানে আনজানে নামে একটি উর্দু ছবি ঢাকায় তৈরি হয়েছিল, সেটি অবশ্য পাকিস্তানে যায়নি কোনোদিন, স্বাধীন বাংলাদেশেই প্রদর্শিত হয়েছে।
১৯৫৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মোট ২২৪টি ছবি ঢাকায় তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯টি উর্দু ভাষায় নির্মিত। এগুলোর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানেও খুব জনপ্রিয়তা পায় চান্দা, তালাশ, সঙ্গম, মিলন, বন্ধন, কাজল, বাহানা, লাস্ট স্টেশন, চকোরি, দর্শন, ছোটে সাহেব, সোয়ে নদীয়া জাগে পানি, চান্দ আওর চান্দনি, কুলি, দাগ, আনাড়ী, শহীদ তিতুমীর প্রভৃতি। পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্রজগতে এগুলোর ভূমিকা অনেক। ঢাকার উর্দু ছায়াছবির জগৎ থেকে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে উল্লেখযোগ্য নাম হয়ে উঠেছিলেন শবনম, শাবানা, নাসিমা খান, সুলতানা জামান, রেশমা, কবরী, রহমান, আনোয়ার হোসেন, নাদিম প্রমুখ। পরিচালকদের মধ্যে আছেন এহতেশাম, মুস্তাফিজ, জহির রায়হান, নজরুল ইসলাম, খান আতাউর রহমান প্রমুখ। সংগীতকারদের মধ্যে রবীন ঘোষ, মুসলেহ উদ্দিন ও বশির আহমেদের নাম উল্লেখযোগ্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় আরো ১৮টি ছবি নির্মিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রোজিনা-নাদিমের হাম সে হ্যা জমানা, ববিতা-জাফর ইকবালের নাদানি, নাদিম-শাবানার হালচাল, রঙ্গীলা-রোজিনা-রাজ্জাকের সাত সহেলিয়া, নাদিম-শাবানার আন্ধি উল্লেখযোগ্য।
রানির আসনে ছিলেন ঝর্না
ঝর্না বসাকের জন্ম ১৯৪৪ সালে। ছোটবেলাতেই নাচ শিখেছিলেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে। তাঁর নাচ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন চিত্রপরিচালক এহতেশাম। আর সুযোগ দিয়েছিলেন এদেশ তোমার আমার ছবিতে অভিনয়ের। ঝর্নার নাম শবনম হয় মুস্তাফিজের হারানো দিন ছবির মাধ্যমে। পরের বছরই উর্দু ছবি চান্দা দিয়ে তারকাখ্যাতি পেয়ে যান। তার পরের তিন বছরের মধ্যেই শবনম পাকিস্তানের সেরা অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনেই ১৯৬৮ সাল থেকে করাচিতে বাস করতে শুরু করেন। সত্তরের শুরুতে তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকায় পরিণত হন, হয়ে যান উর্দু ছবির রানি। তাঁর অভিনীত আয়না ছবিটি পাকিস্তানের হলগুলোতে সবচেয়ে বেশি সময় চলার রেকর্ড তৈরি করে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের আমলের (১৯৭৮-৮৮) একটি পার্টির কথা এখনো অনেকে মনে করেন। জমকালো সে পার্টিতে নূরজাহান, মেহেদী হাসান, সাবিহা, নীলো, ওয়াহিদ মুরাদের মতো বাঘা বাঘা সব তারকা নিমন্ত্রিত ছিলেন। মালিকা-এ-তারান্নুম নূরজাহানের রূপে পার্টি ঝলকাচ্ছিল কিন্তু যেই না শবনম ঢুকল সব আলো ম্লান হয়ে গেল। ঈর্ষান্বিত না হয়ে উপায় ছিল না সেদিন মালিকা-এ-তারান্নুম নূরজাহানের। শবনম ১৫২টা উর্দু সিনেমার নায়িকা ছিলেন। ২৮ বছর দীর্ঘ হয়েছিল তার রাজত্ব। তেরো বার পেয়েছিলেন পাকিস্তানের সেরা নিগার পুরস্কার, উর্দু ছবির ইতিহাসে আর কেউ যা পায়নি। নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান থেকে আবার বাংলাদেশে চলে আসেন শবনম। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলেন, শবনমের মতো রত্ন উর্দু সিনেমা কখনোই পায়নি আর এটা বাংলারই অবদান।
রুনাও দিয়েছেন অনেক
উর্দু চলচ্চিত্রে রুনা লায়লার অবদানও কম নয়। সিলেটে রুনার জন্ম ১৯৫২ সালে। তাঁর মা ও বড় বোন দুজনেই সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন তাই রুনার সঙ্গীতের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে ছোটবেলাতেই। মাত্র ১৩ বছর বয়সে হাম দোনো ছবির জন্য শওকত আলী নওশাদের সুরে তিনি একটি গান রেকর্ড করেন। গানের কথা ছিল ইন কি নজরো সে জো মুহাব্বত কা পয়গাম সুনা। গানটি জনপ্রিয় হলে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের দরজা খুলে যায় রুনার জন্য। বহু সঙ্গীতকারের সঙ্গে গান রেকর্ড করেছেন তিনি। তবে নিসার বাজমির সুরারোপিত গান তাকে বেশি খ্যাতি এনে দেয়। পাকিস্তানে থাকাকালে তিনি দুবার নিগার অ্যাওয়ার্ড জেতেন। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৪ সালে তিনি পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসেন। তিনি বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি ও আরবিসহ ১৭ ভাষায় গান করেছেন।
রবিন ঘোষের নামও করতে হয়
রবিনের বাবা আন্তর্জাতিক রেড ক্রসে কাজ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোস্টেড ছিলেন বাগদাদে। ১৯৩৯ সালে রবিন জন্ম হয় বাগদাদেই। তাঁর বাবা বাঙালি খ্রিস্টান আর মা আরব খ্রিস্টান। বাগদাদের কনভেন্ট স্কুলে পড়াশোনা শুরু হয় রবিনের। তবে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তারা ঢাকায় ফিরে আসেন। ছোটবেলা থেকেই রবিনের সঙ্গীতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করতেন আর বাজাতেন হারমোনিয়াম। এন্ট্রান্স পাশ করে কলকাতা গিয়ে সলিল চৌধুরীর সংগীতদলে যোগ দেন। পরে চাকরি নেন ঢাকা রেডিও স্টেশনে। ঝর্না বসাকের (শবনম) সঙ্গে সেখানেই তার প্রথম পরিচয়। তারপর দুজনের বিয়ে হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৬০ সালে উর্দু ছবি 'হাম সফর' এর জন্য সংগীত রচয়িতা মুসলেহ উদ্দিনের সহকারী হিসাবে কাজ করেন রবিন।
তারপর থেকে রবিন অনেক হিট বাংলা ও উর্দু ছবির সংগীত পরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন যেগুলোর মধ্যে আছে চান্দা, তালাশ, চকোরী, পয়সা, তুম মেরে হো ইত্যাদি। রবিনের সংগীত আর শবনমের অভিনয় ছিল পাকিস্তানে খুবই জনপ্রিয়। তুম মেরে হো মুক্তি পাবার পর রবিন এবং শবনম প্রথম করাচিতে যান, সেখান থেকে লাহোর এবং সেখানে বহু বছর তারা কাজ করেছেন বহু ব্যবসা সফল ছবিতে। রবিন ছয়বার নিগার পুরস্কার পান।
হঠাৎ পাওয়া
খোলা একটা তাকে হঠাৎই চোখে পড়ল। সবগুলোই উর্দু ভাষায়, একাত্তরের আগের, বুক সাইজের চলচ্চিত্রের প্রচারণা পত্র। ৮ থেকে ১০ পৃষ্ঠার। নিউজপ্রিন্টে ছাপা। তবে প্রচ্ছদ হতো আর্ট পেপারে। এখানে একসঙ্গে এই জিনিস! প্রচ্ছদে সিনেমার পোস্টারই প্রিন্ট করা। হাতে নেবার পর ভেতরের পাতাগুলোয় গানের কথা, ছবির গল্প, কোনো কোনোটায় ছবির বিশেষ কিছু দৃশ্যও আছে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ লাইব্রেরির তাকটায় ৩০-৩৫টির মতো বুকলেট একটার পর একটা সাজিয়ে রাখা। সবগুলোই বেশ ভালো অবস্থায় আছে, কারুর ব্যক্তিগ্রহ সংগহ থেকে পেয়ে থাকবে আর্কাইভ, ধারণা হলো। খুটিয়ে দেখলে চোখে পড়ে প্রচ্ছদে নায়ক-নায়িকার মুখাবয়ব ও বিশেষ দৃশ্যের সঙ্গে নায়ক-নায়িকার নাম, পরিচালকের নাম ইংরেজি ও উর্দুতে লেখা। কেবল ছবির নামটি ইংরেজি লেখা, কিন্তু পাশাপাশি ওই নাম উর্দু সঙ্গে বাংলাতে লেখা।
প্রথম বুকলেটটি দরবার ছবির। সাবিহা-সন্তোষ-ইয়াসমিন অভিনীত ছবিটির পরিচালক রিয়াজ আহমেদ। ছবিটির গল্প এমন- হুসানাবাদ বলে এক রাজ্যের রাজা ছিলেন ন্যয়পরায়ণ। তাঁর সেনাপতি সুজাত খান ছিলেন মন্দ চরিত্রের। তাই রাজার নির্দেশে সেনাপতিকে অন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সুজাতের ছেলে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ওঠে আর রাজা-রানীকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে। কেবল রাজপুত্র কায়সার বেঁচে থাকে মুরাদ নামের এক সেনার সহায়তায়। কায়সার যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। সে গায়ের এক সুন্দরীর প্রেমেও পড়ে। ক্রমে ক্রমে সে তাঁর অতীত ইতিহাস জানতে পারে আর রাজ্য পুনর্দখলে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এক দিকে প্রেম আরেক দিকে যুদ্ধ, পারবে তো কায়সার দুই দিকই রক্ষা করতে? উত্তর খুঁজতে দেখতে হবে দরবার (বুকলেটে লেখা)।
তারপর দেখলাম শবনম-সুধিরের ম্যায় জিন্দা হু ছবির বুকলেট। এতে ছবির নাম বাংলায় লেখা হয়েছে আমি জীবিত। তারপর লাখো মে এক ছবির বুকলেট পেলাম। এর পাত্র-পাত্রী হলেন রাজা মির, শামীম আরা, ইজাজ, তালিশ প্রমুখ। গল্প এমন- ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে। আহমদ ও হরদয়াল দুই বন্ধু। হরদয়ালের মেয়ে শকুন্তলা দাঙ্গার ডামাডোলে হারিয়ে যায়। তখন খুঁজতে গেলে হরদয়ালের জীবন সংশয়। আহমদ কথা দেয় শকুন্তলাকে সে খুঁজে বের করবে এবং ভারতে হরদয়ালের কাছে পৌঁছে দেবে। আহমদ তাকে খুঁজে পায় এবং পিতৃস্নেহে বড় করতে থাকে। বড় হয়ে শকুন্তলা দিলদার নামের এক মুসলমান যুবককে হৃদয় দিয়ে ফেলে। ওদিকে কথা রাখতে আহমদ শকুন্তলাকে পৌঁছে দেয় হরদয়ালের কাছে। কিন্তু শকুন্তলার মন কেঁদে বেড়ায় কেবল দিলদারের জন্য। ওদের প্রেম কি পরিণতি পেয়েছিল শেষতক? জানতে চাইলে দেখতে হবে লাখো মে এক। লাহোরের এভারগ্রিন স্টুডিওজ ছবিটি প্রযোজনা করেছে। তারপর পেলাম নিলো-ইউসফ জুটির দরওয়াজা ছবির বুকলেট।
তাজমহল পিকচারসের আনজান ছবির বুকলেটও দেখলাম। ছবিটির গল্পের প্রধান বক্তব্য – রক্তের সম্পর্ক বড় কিন্তু অনেক সময় একে ছাপিয়ে যায় ভালোবাসার সম্পর্ক। এ ছবির হেয়ার স্টাইলে ছিলেন মতিন-মুকিম-নাসিম, ড্রেস ম্যান ছিলেন মাস্টার আকরাম। মো. আলী, রুখসানা, ফরিদা, তানি ছবিটির প্রধান পাত্র-পাত্রী। তারপর পড়লাম আনিলা ছবির গল্প। দুই পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে লেখা হয়েছে গল্পটি। বর্ণনা ধারাবাহিকও নয় বরং ঘোষণা স্টাইলে। যেমন আনিলা এক সরল মেয়ের গল্প যার সৌন্দর্য অতুলনীয় যে কোনো বন্ধনে বন্দী থাকতে চায় না। আবার বলা হচ্ছে, আনিলা এক পিতার গল্প যে মেকী আধুনিক জীবনে টিকতে পারেনি। আনিলা এক বড় বোনের গল্প যে আত্মপ্রত্যয়ী, নতুন যুগের নারীর প্রতিভু। আনিলা এক দায়িত্বশীল যুবকের গল্প যে অন্যায় সইতে পারে না। একদম শেষে উপসংহার এমন- আনিলা কোনো কাল্পনিক জগতের গল্প নয় বরং আজকের ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের বাস্তব উপস্থাপনা।
মাকসুদ পরিচালিত ইয়াসমিন-সাবিরা-হাবিব অভিনীত বার্মা রোড ছবির পোস্টার-প্রচ্ছদ দেখলাম। তাতে একজন সৈনিককে অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা যাচ্ছে, আরো আছে ধ্বংসযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে নায়িকার বিরহী মুখাবয়ব । বলা হচ্ছে – ইতিহাসের সেই সময়ের গল্প এই বার্মা রোড যখন জাপানী বোমায় ক্ষতবিক্ষত সিঙ্গাপুর, বার্মা, মালয়। সেলিমের পিতা বোমার আঘাতে মৃতপ্রায়। শেষ চিৎকারে তিনি সেলিমকে বলছেন পালাও পালাও, চলে যাও মালিকপুর, সেখানে জীবন শান্তির। পিতার শেষ কথা রাখতে সেলিম রওনা হয় কিন্তু পথে পদে পদে বিপদ।
তারপর নাগমা-এ-সাহারা ছবির গল্প পড়তে পারলাম। এক চমকপ্রদ আরবী মেয়ের অতুলনীয় প্রেমের কাহিনী নাগমা-এ- সাহারা। সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে ইউসুফ প্রেমে পড়ে নাগমার। কিন্তু ইউসুফের পিতা এ সম্পর্ক মেনে নিতে পারে না। অন্যদিকে নাগমার ভাই চায় এ সম্পর্ককে সুন্দর পরিণতি। কাজেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। কি ঘটবে শেষে তার বিবরণী মিলবে রূপালী পর্দায়। তারপর পরীস্তান, শাহজাদা, মা কি আসু ছবির প্রচারণা পত্রে চোখ বুলিয়ে থামলাম গিয়ে ইয়াহুদি কি লাড়কি ছবিতে। ছবিটির গল্প হলো, রোমান ধর্মগুরু ব্রুটাস ইহুদিদের ওপর খুব খেপে গেছেন। কারণ ছোট্ট শিশু আজরার ছোট্ট একটু ভুল। ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালায় ব্রুটাস। তবে আজরা পালাতে সক্ষম হয়। বড় হয়ে আজরা রুপে গুনে অতুলনীয়া হয়ে ওঠে কিন্তু শৈশবস্মৃতি তাঁর ধিকি ধিকি জ্বলে। একপর্যায়ে প্রতিশোধ নিতে সে বদ্ধপরিকর হয়। কিভাবে সে নিল প্রতিশোধ? যদি জানতে চাও, দেখে এসো, ইয়াহুদি কি লারকি।
কয়েকজনের নাম পরিচয়
শামীম আরা (১৯৩৮-২০১৬): তিনি ললিউডের (লাহোর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি)ছিলেন একাধারে অভিনেত্রী, পরিচালক এবং প্রযোজক। তার আসল নাম পুতলি বাই। তাঁর অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৫০ সালে, তিনি সক্রিয় ছিলেন নব্বইয়ের দশক অবধি। প্লেবয়, মিস কলম্বো, লেডি স্মাগলার, আখেরি মুজরা নামে বেশ কিছু ছবিরও তিনি পরিচালক। জীবনের শেষ দিকে তিনি লন্ডনে ছিলেন। তবে ২০১৬ সালে লন্ডনেরই একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান।
রঙ্গীলা (১৯৩৭-২০০৫): মোহাম্মদ সাঈদ খান বেশি পরিচিত ছিলেন রঙ্গীলা নামে। তিনি ললিউডের অভিনেতা. সংগীতশিল্পী এবং পরিচালক ছিলেন। তিনি ছিলেন উর্দু ছবির একজন সেরা কমেডিয়ান। চার দশকে তিনি তিনশরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেন। যুবাবয়সেই তিনি লাহোরে গিয়ে থিতু এবং বিলবোর্ড পেইন্টারের পেশা গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি রঙ্গীলা প্রোডাকশনস প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর দিয়া আউর তুফান ছবি দিয়ে পরিচালনায় তার অভিষেক ঘটে। পরের বছরের রঙ্গীলা ছবিতে তিনি নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। ২০০৫ সালে ৬৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
নীলো (১৯৪০-২০২১): সিনথিয়া আলেকজান্ডার ফার্নান্দেজ ললিউডে এসে নীলো নাম গ্রহণ করেন। হলিউডে ভবানী জাংশন ছবি দিয়ে তাঁর অভিষেক ঘটে ১৯৫৬ সালে। উর্দু ও পাঞ্জাবী ভাষার ১৩৪টি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। ঘুংঘট, বদনাম, সুলতানা ডাকু, জেনারেল বখত খান, জারকা, মুমতাজ, দরবার, শিকওয়া তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর অন্যতম।
কামাল (১৯৩৭-২০০৯): পুরো নাম সৈয়দ কামাল। তিনি ছিলেন পাকিস্তানী চলচ্চিত্র ও টিভি অভিনেতা, প্রযোজক এবং পরিচালক। ১৯৫৬ সালে পাকাপাকিভাবে পাকিস্তানে চলে আসার আগে পর্যন্ত বলিউডের ৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। ভারতের উত্তর প্রদেশের মীরাটে তাঁর জন্ম। ১৯৬৩ সালে তার অভিনীত তওবা ব্যবসাসফল হয়। বানজারা, বেহনা ভাই, রোড টু সোয়াত, ইনসান আউর গাধা তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর অন্যতম। তিনি বেশ কিছু ছবি পরিচালনাও করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সেহনাই, দর্দ-ই দিল, হানিমুন, আলিয়া ইত্যাদি।
সাবিহা (১৯৩৫-২০২০): আসল নাম মুখতার বেগম। পাকিস্তানী সিনেমার ফাস্র্ট লেডি নামে খ্যাত ছিলেন সাবিহা। দো আসু (১৯৫০), গুমনাম (১৯৫৬), সারফারোশ (১৯৫৬), মুখরা (১৯৫৮) তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর অন্যতম।
বুকলেটগুলোর কাজ ছিল কী
আমারও হলো, যে কারুরই হতো- কী কাজ ছিল বুকলেটগুলোর। একে ওকে শুধিয়ে তেমন ভালো কোনো উত্তর না পেয়ে আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্র গবেষক শামসুল আলম বাবুর দ্বারস্থ হলাম। তাঁর কাছে জানলাম, এগুলো মূলত প্রচারণাপত্র। আর এগুলো বিক্রিও হতো। মুখ ও মুখোশের বুকলেটের দাম ছিল যেমন ২ আনা। বাবু ভাই বলছিলেন, বলিউডে এর ব্যাপক চল ছিল। সে থেকে ঢাকা আর লাহোর ইন্ডাস্ট্রিতেও এগুলো চলে আসে। এগেুলো ৮-১০ পাতার হতো। ছবির যাবতীয় তথ্য যেমন পরিচালকের নাম, পাত্র-পাত্রীর নাম, প্রযোজনের প্রতিষ্ঠানের নাম, ছবির গল্প এতে থাকত। ছবির কিছু স্টিল আর পোস্টারও ছাপা হতো। তবে এগুলো ছিল মূলত গানের বই। বিক্রি হতো সিনেমা হলে। ছবি দেখার পর দর্শক কিনে বাড়ি নিয়ে যেত, পরিবারের অন্য সদস্যরাও দেখার সুযোগ পেত, গানের কথা লেখা থাকায় মুখস্থ করার সুযোগ মিলত।'
বাবু ভাই আরো বলছিলেন, আশির আগে কিন্তু টিজার বা ট্রেলারের প্রচলন সেভাবে ছিল না। বুকলেটগুলোই কিন্তু ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রচারণা মাধ্যম্য। আমাদের দেশে সত্তরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বুকলেট প্রকাশ হয়েছে। কলকাতা মানে টালিউডে এখনো অল্পস্বল্প হয়।
বলিউডেও কিন্তু সেকালে বুকলেটের চল ছিল। এখন এগুলোর আর্কাইভাল ভ্যালু তৈরি হয়েছে অনেকগুনে। উদাহরণ দিয়ে বলি, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় যে সোয়া দুইশ চলচ্চিত্র হয়েছে তার মধ্যে শতাধিক ছবির কোনো হদিশ নেই। সে ছবিগুলো সম্পর্কে এখন বুকলেটগুলোই শেষ ভরসা। এর মাধ্যমেই আমরা নায়ক-নায়িকা, পরিচালক, সংগীতকার সবার নাম জানতে পারছি। কারওয়া (১৯৬৪) নামে একটি ছবির কথা বলি- চিত্রালীর সম্পাদক এসএম পারভেজ এর পরিচালক ছিলেন। রবীন ঘোষ ছিলেন সংগীত পরিচালক। সে ছবির শুটিং হয়েছিল নেপাল রাজপ্রাসাদে। ওই ছবিটির কোনো কপি নেই কোথাও, অন্তত জানা যায় না। এখন বুকলেটটাই সম্বল।'
উল্লেখ্য কলকাতা থেকে টালিউডের ছবিগুলোর বুকলেট নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম প্রচ্ছদে বাংলা সিনেমার ফিল্ম বুকলেট বাছাই ১০০। সৌম্যকান্তি দত্ত ও সৌরদীপ বন্দোপাধ্যায় এটি সম্পাদনা করেছেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত বইটির প্রকাশক নীলাঞ্জনা প্রকাশনী।