শেরী পাড়া: সামাজিক বনায়ন ও ১৯৮৮-র বন্যা থেকে জন্মানো দেশের বৃহত্তম ফার্নিচার হাব
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার উত্তরে শেরী পাড়া সড়ক। প্রায় আধকিলোমিটারজুড়ে সড়কটির দুপাশে চোখে পড়বে সার সার শতাধিক ফার্নিচারের দোকান। রাস্তাটি একটি চৌরাস্তায় গিয়ে শেষ হয়েছে। সেখান থেকে আরেকটি নির্মাণাধীন রাস্তা পূর্ব দিকে করাতকল ও সংযোজন ইউনিটের দিকে চলে গেছে।
ঢাকার ব্র্যান্ডেড আউটলেটের তুলনায় টিনশেডের শোরুমগুলোকে অগোছালো লাগে দেখতে।
খোদাই করা হেডবোর্ড, ফুটবোর্ড ও বেডস্টেডের সাইডরেইল—সবকিছু টিনশেড সিলিং থেকে ঝুলন্ত কম ওয়াটের এলইডি বাল্বের আলোয় চকচক করছে।
বাতাসে মিনারেল স্পিরিট ও কাঁচা কাঠের গন্ধ।
জায়গাটা শেরপুরের বিখ্যাত ফার্নিচার মার্কেট। এখানে খুচরা ক্রেতাদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের সমাগমই বেশি। এই পাইকারি বাজারটি গড়ে ওঠে ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর।
৫৩ বছর বয়সি দক্ষ ছুতার জীবন সূত্র ধর জানালেন, 'বন্যার আগে স্থানীয় কাঠমিস্ত্রিরা আলাদা আলাদা কাজ করত। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তারা। ভয়াবহ বন্যার পরে টিকে থাকার জন্য তারা একত্রিত হয়।'
করিম ফার্নিচার মার্টে আসবাবপত্রে বার্নিশ লাগাচ্ছিলেন জীবন। কাঠ পালিশ করার জন্য তিনি মিনারেল স্পিরিট বা থিনারের সাথে রজন ও জাফরান গুঁড়া মিশিয়ে দেন। গত তিন দশকে তার দৈনিক আয় বেড়েছে চারগুণ।
তিনি জানান, কাকতালীয়ভাবে সামাজিক বনায়নের অংশ হিসাবে রোপণ করা প্রথম ব্যাচের গাছও ওই সময় কাটার উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল।
শেরী পাড়া ফার্নিচার মার্কেটে দোকান আছে প্রায় ২০০টি। প্রায় ২০ হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই বাজারের উপর নির্ভরশীল। এখানে কাজ করেন দেশে সবচেয়ে দক্ষ ছুতাররা। কাজ করেন শত শত স্থানীয় যুবক—যাদের অনেকেও এখনও পড়াশোনা করছে।
শেরী পাড়ার প্রথমদিকের ফার্নিচার ব্যবসায়ীদের একজন আজাদ আলী। তিনি বলেন, 'প্রতি বাজারের দিন সারা বাংলাদেশ থেকে পাইকাররা এখানে আসে, ফিরে যায় আসবাবপত্রভর্তি ট্রাক নিয়ে। ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের গ্রামের বাজারগুলোতে আমাদের পণ্য খুঁজে পাবেন।'
বাজারের আকার কত, সে সংখ্যা জানাতে রাজি হননি আজাদ। তবে তিনি জানালেন, একেকটি ব্যবসাকে টিকে থাকার জন্য সপ্তাহে অন্তত ৫০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতে হয়।
এ বাজারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো, এখানে সস্তা দামে আসবাবপত্র পাওয়া যায়। এখানে বেডস্টেড, ড্রেসিং টেবিল, শোকেস, ডাইনিং টেবিল ও অন্যান্য গৃহস্থালি আসবাবপত্র পাওয়া যায় এখানে। এখানকার ফ্ল্যাগশিপ পণ্য হলো ৬×৭ ফুট সাইজের বেডস্টেড। এর দাম ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। বার্নিশ না করা পণ্য বিক্রি হয় সবচেয়ে সস্তায়।
শেরী পাড়ার ফার্নিচার ব্যবসার মূল কারণ হলো শেরপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার আশেপাশের সামাজিক বনভূমি থেকে স্থানীয় ও বেলজিয়াম জাতের অ্যাকাশিয়া গাছ পাওয়া যায়।
করিম ফার্নিচার মার্টের ম্যানেজার আবদুর রহিম বলেন, 'অ্যাকাশিয়া সাধারণত কাঠপোকা-প্রতিরোধী।' ১৫ বছর আগে এ বাজারে ফার্নিচারের দোকান খোলেন রহিমের কাঠমিস্ত্রি বাবা আমির হোসেন।
শেরী পাড়ার ব্যবসায়ীরা শুধু রেডিমেড আসবাবপত্র বিক্রি করেন। সেগুনের মতো দামি কাঠের তৈরি সেরা মানের ও ব্র্যান্ডের বেডস্টেড কিনতে চাইলে আগে থেকেই অর্ডার দিতে হবে। একটি বেডস্টেডের চূড়ান্ত মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকে।
জীবিকা কেন্দ্র
ফার্নিচার হাবটি পূর্ব শেরী, বয়রা, পরানপুর, শেরী পাড়া, কুসুমহাটী, কসবা ও অষ্টমীতলা গ্রামে বিস্তৃত হয়েছে। স্থানীয়রা এই এলাকাগুলোকে ফার্নিচার গ্রাম বলে ডাকে।
৪৮ বছর বয়সি ব্যবসায়ী জাকারিয়া ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে পূর্ব শেরী গ্রামে ছুতারের কাজ শুরু করেন। স্থানীয় ওস্তাদ ছুতার বিশ্বনাথ সূত্র ধরের কাছ থেকে কাজ শিখে অটোবির জন্য কাজ করতে ঢাকায় চলে আসেন। ২০১৫ সালে তিনি সঞ্চয়ের ২ লাখ টাকা নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন।
এখন জাকারিয়ার কর্মীসংখ্যা ২০ জন। সপ্তাহে তিনি প্রায় ১০-১২টি বেডস্টেড বিক্রি করেন।
একদল অল্পবয়সি ছুতার কাজ করছিল তার টিনশেড কারখানায়। কেউ ছেনি দিয়ে কাঠ খোদাই করছে তো কেউ শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে কাঠ মসৃণ করছে। কারখানার বাইরে আরেকদল শ্রমিক উড প্ল্যানার ব্যবহার করে কাঠের আকার দিচ্ছে। কাঠগুলো কাটা হয়েছে পাশের করাতকলে।
মো. শামীম নামে একজন চটপটে তরুণ ছুতার কারিগর হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিলেন।
তিনি জানালেন, 'আমি দিনে তিনটি বেডস্টেড ফিট করতে পারি। কাজের চাপ থাকলে মাঝে মাঝে পাঁচটি বেড ফিট করি।'
তিন বছর আগে ঢাকায় কাজ করতেন ২২ বছর বয়সি এই ছুতার। সেখানে মাসে ১২ হাজার টাকার আয় করতে পারতেন না। 'এখন আমি সপ্তাহেই এই টাকা আয় করতে পারি,' জানালেন শামীম।
আরেক কারখানায় ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন নিরঞ্জন সূত্রধর ।
তিনি ঢাকা থেকে আনা হেডবোর্ড ডিজাইনের ক্যাটালগ দেখে সেগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের ডিজাইন বানান।
নিরঞ্জন উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ছুতার পেশায় যোগ দেন। প্রথমে তিনি খণ্ডকালীন কাজ করতেন। দক্ষ হয়ে ওঠার পর—বিশেষ করে ডিজাইনে—তিনি পূর্ণকালীন ছুতার হিসেবে কাজ শুরু করেন।
'এই ফার্নিচার মার্কেটে বাজার সারা বছরই চাকরি পাওয়া যায়। স্থানীয় যুবকরা ভালো আয় করে,' নিরঞ্জন বলেন।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্র স্বপন এখানে দৈনিক ২৫০ টাকায় সহকারী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। পাশের এক কারখানায় দেখা পেলাম আরেক কর্মী প্রলয় চন্দ্র বিশ্বাসের। শেরপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র তিনি। সেদিন তার ক্লাস ছিল না।
তার ও তার সহকর্মীদের ছবি না তুলতে অনুরোধ করে প্রলয় বললেন, 'দেড় বছর আগে শিক্ষানবিস হিসাবে আমি এই পেশায় যোগ দিই। এখন আমি মাসে প্রায় ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা আয় করি।
নিরঞ্জন বলেন, 'আমাদের অনেকের অভিভাবকই জানেন না যে আমরা এখানে কাজ করি। তারা জানুক, তা আমরা চাইও না।'
প্রলয়কে প্রশ্ন করলাম কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র হয়েও তিনি কেন ছুতারের কাজ করেন?
তিনি বলেন, স্থানীয় ছুতারদের কারুকাজ তার মতো তরুণদের মধ্যে এই কাজের সাথে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। 'দক্ষ কারিগর হতে পারলে টাকা রোজগার করা সম্ভব—স্থানীয় অনেক তরুণদের মধ্যে এই ধারণাটি খুব জনপ্রিয়,' বলেন তিনি।
শেরীর কারুকার্যের বিশেষত্ব কী?
তরুণ ছুতার কারিগর শামীম জবাব দিলেন, 'আমরা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ও বুদ্ধিমান। পাতলা বা মোটা যেকোনো কাঠ আমরা ফিট করতে পারি। প্রায়শই আমরা পাতলা কাঠে স্পাইক লাগাই। অন্য অঞ্চলের ছুতাররা এ কাজ করার সাহস করে না।'
এই তরুণ ছুতারের মতে, এই পেশায় সেরা হওয়ার জন্য কাঠের গড়ন বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আমরা কাঠের শস্যের বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারি, বিশেষ করে অ্যাকাশিয়ার।'
শেরী পাড়া ফার্নিচার মার্কেটে কালো মেঘ
বাজারের আকার ক্রমেই বাড়ছে। তবু ফ্যাকাসে চেহারায় ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন শাকিল ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী আজাদ আলী।
তিনি জানালেন, মাত্র দুই দশক আগেও ন্যায্য মূল্যে অ্যাকাশিয়া কাঠ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর ন্যায্য মূল্যে এই কাঠ পাওয়া যায় না।
আজাদ বলেন, 'কাঠভর্তি একটা মিনি-ট্রাকের পরিবহনভাড়া এবং টোল বাবদ ১২ হাজার টাকা খরচ পড়ত। এখন আমাদের একই পরিমাণ কাঠের জন্য খরচ হয় ৫০ হাজার টাকা। কেন? চাঁদাবাজির কারণে।'
অ্যাকাশিয়া কাঠ তিনটি রুটে পথ দিয়ে আসে: মধুপুর (টাঙ্গাইল)-শেরপুর, নালিতাবাড়ী-শেরপুর ও ঝিনাইগাতী-শেরপুর। 'প্রতিটি রুটেই আমাদের টোল দিতে হয়,' কারও নাম না করে বলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংগঠক আজাদ।
নির্ঝরনা ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী মো. জুয়েল মিয়া জানান, শেরী পাড়ার ব্যবসায়ীরা স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কয়েকবার সমস্যার কথা জানালেও কোনো লাভ হয়নি।
তাদের সমিতি কোনো উদ্যোগ নেয়নি কি না, জানতে চাইলে আজাদ বলেন, 'ফার্নিচার ব্যবসায়ীদের একটা সমিতি আছে। আমি এর উপদেষ্টা। কিন্তু সমিতি কার্যকর নয়। সমিতির সদস্যদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, সন্তোষজনক রিটার্ন পাওয়া সত্ত্বেও কিছু ব্যবসায়ী ঋণের কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।