যে ছবি বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী যুগের কথা বলে
চলচ্চিত্রশিল্পী এমএ সামাদ (১৯৩৭-২০০৪) বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভকে একটি তিন তাকের মজবুত আলমিরা দিয়েছেন যার সম্মুখ দেয়াল কাঁচের। তাই সহজেই দেয়াল ভেদ করে ভিতরের মণিমানিক্য নজর কাড়ে। এর মণিমানিক্য মানে চলচ্চিত্রের স্থির চিত্র। বিভিন্ন আকারের মানে ৩ ইঞ্চি, ৫ ইঞ্চি, ৭ ইঞ্চি ইত্যাদি নানা আকারের ছবি আছে। ছবিগুলো সূত্র ধরিয়ে দিল সেসময়ের কিছু মানুষ ও তাদের কাজকর্মের। এমএ সামাদের কথাই ধরা যাক। ৫০টির মতো চলচ্চিত্রের তিনি চিত্রগ্রাহক। এগুলোর মধ্যে আছে রূপবান, ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন, সূর্যগ্রহণ, সূর্যসংগ্রামের মতো ছবি। চিত্রগ্রাহক হিসাবে তার প্রথম ছবি ছিল কাজী জহিরের 'বন্ধন' (১৯৬৪)। তিনি বিলেতে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টার হতে। কিন্তু লন্ডন ফিল্ম স্কুল থেকে আলোকসজ্জা ও চিত্রগ্রহণ বিষয়ে অধ্যয়ন করে দেশে ফেরেন। তিনি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র গানস অব নাভারনের সহকারী চিত্রগ্রাহক ছিলেন । সুযোগ পেয়েছিলেন বিবিসিতে কাজ করার কিন্তু তাও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনায় হাত দেন। সূর্যগ্রহণ, সূর্যসংগ্রাম, শিরি ফরহাদ তারই প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবি। বাংলাদেশ ক্যামেরাম্যান এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। প্রশিক্ষিত চলচ্চিত্রকর্মী তৈরি করতে যেয়ে এফডিসিতে প্রথম চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
সামাদ সাহেবের আলমিরায় চিত্রনায়িকা নতুনের মাস্টার ক্লোজ শটের একটা দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের স্টিল ফটো আছে। তখন অতো বড় ছবি প্রিন্ট করানোর প্রযুক্তিও ছিল নতুন। চিত্র পরিস্ফুটনকারীর জন্য তখন এমন ছবি প্রিন্ট করা চ্যালেঞ্জের ব্যাপারই ছিল। তারপর আজিম-সুজাতার একটি ছবি পেলাম। সেটা মধুমালা ছবির। ছবিটি তৈরি হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। আজিজুর রহমান ছিলেন এর পরিচালক। আজিজুর রহমানের খুবই নামকরা আরেকটি ছবি 'ছুটির ঘণ্টা'। তিনি ১৯৩৯ সালে বগুড়ার সান্তাহারে জন্মগ্রহণ করেন। চারুকলা আর্ট ইনস্টিটিউটে তিনি কমার্শিয়াল আর্টে ডিপ্লোমা করেছেন। ১৯৫৮ সালে এহতেশামের সহকারী হিসাবে 'এ দেশ তোমার আমার' ছবিতে তার হাতেখড়ি হয়।
১৯৬৭ সালে ময়মনসিংহের লোককথা নিয়ে প্রথম নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র 'সাইফুল মূলক বদিউজ্জামান'। মোট ৫৪টি চলচ্চিত্র তিনি নির্মাণ করেন যার মধ্যে অশিক্ষিত, আলিবাবা চল্লিশ চোর, জনতা এক্সপ্রেস, যন্তর মন্তর, বস্তির রানী, জমিদার বাড়ির মেয়েও আছে। তার 'মধুমালা' ছবিটি ছিল জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলন নিয়ে। তার 'ছুটির ঘণ্টা' ও 'জনতা এক্সপ্রেস' ছবি দুটি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য। কামাল আহমেদের অঙ্গার ছবির একটি স্থিরচিত্র দেখলাম তারপর। শাবানা-বুলবুল আহমেদ ওই ছবির পাত্রপাত্রী। ছবিটি ১৯৭৬ সালে নির্মিত। কামাল আহমেদ ১৯৮৩ সালে 'লালু ভুলু' এবং ১৯৯০ সালে 'গরীবের বউ' ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রশংসিত হয়েছেন অশ্রু দিয়ে লেখা (১৯৭২), রজনীগন্ধা (১৯৮২), অধিকার (১৯৭০), অনুরাগ (১৯৭৯) ছবির জন্যও।
সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর 'ঘুড্ডি' ছবিটি দেশে তো বটেই বিদেশেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ ছবির একটি স্থিরচিত্র পেলাম তাতে মিড ক্লোজ শটে নায়ক-নায়িকা হাসছে। ১৯৮০ সালে নির্মিত ছবিটির প্রধান পাত্র-পাত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা এবং রাইসুল ইসলাম আসাদ। ছবিটির জন্য জাকী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার পুরস্কার লাভ করেন। ছবিটির প্রধান চরিত্র আসাদ ফকিরাপুলের পানির ট্যাংকির নীচে এক টিনের ঘরে থাকে। সে শিক্ষিত কিন্তু বেকার। বন্ধুর গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় ঘুড্ডির (সুবর্না) সঙ্গে তার পরিচয় হয়, তারপর তাদের সম্পর্ক প্রেমে গড়ায়। এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন লাকী আকন্দ আর গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী। সোনাকান্দা দুর্গ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত আর হিমছড়িতে ছবিটির দৃশ্যধারণ করা হয়েছে। তারপর কামাল আহমেদের প্রথম ছবি উজালার (১৯৬৬) একটি স্থিরচিত্র পেলাম। রোমান্টিক দৃশ্যের একটি ছবি। এতে আছেন নায়ক হাসান ইমাম এবং নায়িকা নাসিমা খান। হাসান ইমাম কোট টাই পরা আর নাসিমার পরনে সাদা শাড়ি ও কালো ব্লাউজ, গলায় পুতির মালা ও কপালে টিপ। এক বেণী করা তার কোকড়া লম্বা চুল। সম্ভবত হাসান ইমামের প্রেমের প্রস্তাবে সে খানিক আড়ষ্ট। নাসিমা খানের জন্ম ১৯৪৪ সালে। চলচ্চিত্রের সাদা-কালো যুগের নায়িকা তিনি। এজে কারদারের 'জাগো হুয়া সাভেরা' চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি ছায়াছবির জগতে আসেন। তবে নায়িকা হন ১৯৬১ সালে 'যে নদী মরু পথে' ছবিতে। তিনি আশির দশক পর্যন্ত বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন । তার অভিনীত আরো ছবি হলো ধারাপাত (১৯৬৩), ঢেউ এর পর ঢেউ (১৯৭০), মেঘের পর মেঘ (১৯৭৮) ইত্যাদি।
তারপর বিখ্যাত ছুটির ঘণ্টা ছবির একটি স্থিরচিত্র পেলাম। তাতে মাস্টার সুমন ও সুজাতাকে দেখা যাচ্ছে। সুজাতার পরনে সাদা কাপড় ও কালো ব্লাউজ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। সুমনের পরনে সাদা হাফ শার্ট ও হাফ প্যান্ট। সুমনের স্কুলে যাওয়ার সময় সুজাতা তার থুতনিতে হাত রেখে আদর করছে।
নায়ক রহমান আর নায়িকা শবনমের একটি স্থিরচিত্রও পাওয়া গেল। সেটা রাতের দৃশ্যের। রহমান গাছে হেলান দিয়ে শবনমের কথা শুনছে। রহমানের হাতে ঘড়ি বাঁধা। ১৯৬১ সালের হারানো দিন ছবির দৃশ্য এটি। ছবিটির পরিচালক মুস্তাফিজ। উল্লেখ্য বড় ভাই এহতেশামকে অনুসরণ করেই চলচ্চিত্রে আসেন মুস্তাফিজ। তিনি ১৯৬২ সালে উর্দু ছবি 'তালাশ' দিয়ে বক্স অফিস সফলতা পান। এছাড়া মালা, কুলি, আনাড়ি, পায়েল, মুন্না আউর বিজলী, ডাকবাবু, আলো ছায়াও তার ব্যবসাসফল ছবি। তবে 'হারানো দিন' ছিল সবচেয়ে হিট। তাঁর পুরো নাম মুস্তাফিজুর রহমান, তিনি ১৯৯২ সালে মারা যান।
ফতেহ লোহানী পরিচালিত 'আসিয়া' ছবিরও একটি স্থিরচিত্র পেলাম। ছবিটির প্রধান পাত্র ও পাত্রী শহীদ ও সুমিতা দেবী। নদীতে নৌকা বাইছে শহীদ আর সুমিতা কোনো একটা হাসির কথা বলছে। সুমিতার খোপায় ফুল গোঁজা। ছবিটি পূর্বানী চিত্রের ব্যানারে প্রযোজিত আর পরিবেশনায় ছিল পাকিস্তান ফিল্ম ইনস্টিটিউট। ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র হিসাবে পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পদক পায়। আব্বাসউদ্দিন আহমদ এ ছবিতে সুরসংযোজন করেছেন, সমর দাস ও আব্দুল আহাদ ছিলেন সংগীত পরিচালক। ছবিটির জারিগানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আব্দুল হালিম ও হাজেরা বিবি। উল্লেখ্য ফতেহ লোহানীর (১৯২৩-১৯৭৫) পুরো নাম আবু নজীর মোহাম্মদ ফতেহ আলী খান। কোলকাতার সেন্ট মেরিজ ক্যাথিড্রালে থেকে তিনি মেট্টিক পাস করেন, রিপন কলেজ থেকে বিএ পাস করে লন্ডনে চলে যান। সেখানকার ওল্ডভিক থিয়েটার স্কুলে নাট্য প্রযোজনা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পাকাপাকিভাবে ঢাকায় আসেন ১৯৫৪ সালে। তিনি অভিনেতা, গীতিকার, আবৃত্তিকার এবং সাংবাদিকও ছিলেন। ৪৪টি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন।
সুভাষ দত্তের 'সুতরাং' ছবির কথা অনেকেরই মনে পড়বে। মিষ্টি মেয়ে কবরীর এ ছবি দিয়েই চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। এ ছবিরই একটি স্থিরচিত্র দেখলাম। ছবিটায় দেখা যাচ্ছে গাছের গুঁড়ির আড়ালে আপন জনের মতো ঘনিষ্ঠ কবরী আর সুভাষ দত্ত। কেউ কারোর দিকে তাকিয়ে নেই, দুজনেই আপনার ভিতর নিমগ্ন। মনে হচ্ছে কোনো একটা একান্ত অনুভূতি নিভৃতে ভাগ করে নিচ্ছে দুজনে। সুভাষের গোঁফ আর কবরীর কানের দুল নজর কাড়ে। কবরীর আসল নাম ছিল মিনা পাল। সুরকার সত্য সাহা সুভাষ দত্তকে তার খোঁজ দেন। 'সুতরাং' ছবিতে তার চরিত্রের নাম ছিল জরিনা। কবরীর স্টিল ছবি দেখে সুভাষ দত্তের পছন্দ হয় এবং অডিশনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ডেকে পাঠান। কণ্ঠ ও সংলাপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি জরিনা চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হন। তারপর সুভাষ দত্ত সুতরাংয়ের লেখক সৈয়দ শামসুল হককে বলেন মিনার জন্য একটা সুন্দর নাম রাখতে। শামসুল হক তার নাম রাখেন কবরী। ষাট ও সত্তর দশকে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন কবরী। লালন ফকির (১৯৭২) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি বাচসাস পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)- এ রাজার ঝি এবং সারেং বৌ (১৯৭৮) এ নবিতুনের চরিত্র করে প্রশংসিত হয়েছেন। তার সুজন সখী (১৯৭৫) এবং দুই জীবনও (১৯৮৮) আলোচিত ছবি। তার অভিনীত সাত ভাই চম্পা চলচ্চিত্রটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সেরা দশ বাংলাদেশি চলচ্চিত্র তালিকায় দশম স্থান লাভ করে। প্রায় ৫০ বছরের অভিনয় জীবনে কবরী দেড়শর বেশি ছবিতে অভিনয় করেন।
তারপর বেশ কয়েকটি স্থিরচিত্র দেখলাম, সেগুলোর পাত্র-পাত্রী শমী কায়সার, ঈশিতা, মোমেনা, আজিজুল হাকিম ও জাহিদ হাসান। কোথাও নাটক বা চলচ্চিত্রটির নাম দেখতে পেলাম না। ছবিগুলো ১৭.০৪.৯৫ তারিখে তোলা। জাহিদ হাসান ট্যারা চোখের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। একটা ছবিতে জাহিদ আর হাকিম কাঠের টুলের ওপর বসে দা দিয়ে বাঁশের ঝুল ছাড়াচ্ছে। আরেকটি ছবিতে বাঁশের স্তুপের ওপর বসে মোমেনা আর শমী গভীর কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে। শমীর পায়ের চপ্পলটি একেবারেই সাদামাটা। পরনে তার ডুরে শাড়ি, চুলে একটা বেনী করা। আরেকটা ছবিতে কাঠের হাতলওয়ালা ছাতা, পানের ডাব্বা, ধান ভানার কুলা, টিনের তৈরি ভাতের হাড়ি ইত্যাদি দেখলাম। মনে পড়ল সেকালের অনেক ছবিতেই গাছের ডাল ধরে প্রিয়জনের অপেক্ষায় থাকা অথবা নদীর ধারে নৌকা ভিড়ানোর দৃশ্য ছিল। টর্চলাইট নিয়ে বিকালে বাজারে যাচ্ছে নায়ক– এমন দৃশ্যও দেখা যেত। একটা স্থিরচিত্রে ঈশিতাকে দেখলাম এক হাতে লাটাই আর অন্য হাতে দা নিয়ে এক চ্যাংড়াকে শাসাচ্ছে। এসব ছবি দেখে তেমন একটা সময়ে ফেরত যাওয়া যায় যখন বাংলাদেশ ছিল নদীমাতৃক বা পরিবেশবান্ধব। ওই সময় আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল জোড়ালো, মানুষ মানুষকে ভালোবাসত গভীরভাবে।
এরপর দেখলাম চলচ্চিত্রের কিছু ওয়ার্কিং স্টিল। এসব আলোকচিত্র চলচ্চিত্রের দৃশ্য নয় বরং ছবি করতে যাওয়ার প্রস্তুতিমূলক ছবি। একটি যেমন আলমগীর পিকচার্স প্রযোজিত 'ডিসকো ডান্সার' ছবির মহরত অনুষ্ঠানের। উল্লেখ্য আলমগীর পিকচার্সের কর্ণধার একেএম জাহাঙ্গীর খানকে বলা হতো 'মুভি মুঘল'। টালিগঞ্জে তো বটেই বলিউডের লোকেরাও তাকে চিনত। তিনি ছিলেন এফডিসির সবচেয়ে বড় প্রযোজক। ছেলে একেএম আলমগীর খানের নামে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আলমগীর পিকচার্স। জাহাঙ্গীর খানের জন্ম ১৯৩৯ সালে। তিনি জগন্নাথ কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতক হয়েছিলেন। তিনি ঢাকার প্রথম ড্রাই ডক ইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার আটটি জাহাজ ছিল। আমদানি-রপ্তানির বড় ব্যবসাও ছিল। স্ত্রী বদরুন নাহারের নামে নাহার কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নাহার নারিকেল তেলও নামকরা ছিল। সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখেই তিনি চলচ্চিত্রে আগ্রহী হন। উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনের অনুরাগী ছিলেন তিনি। সত্তর দশকে তার প্রযোজিত দুটি ছবি 'সীমানা পেরিয়ে' ও 'নয়নমনি', সময়ের তুলনায় ছিল অনেক এগিয়ে। জোনাকী সিনেমা হলটিও তিনি লিজ নিয়ে অনেকদিন চালিয়েছেন। তিনি ষাটের বেশি ছবি প্রযোজনা করেছেন। ১৯১৫ সালে তিনি মারা যান।
এরপর হাতে এলো কোনো একটি ফ্যান্টাসি ছবির বেশ কয়েকটি স্থিরচিত্র। চলচ্চিত্রটির নাম পেলাম না কোথাও। তবে বোঝা গেল ছবিটির নায়ক ছিলেন জাভেদ। তিনি একটি একটি দস্যুদলের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। দস্যু সরদার নায়িকাকে বন্দি রেখেছে। দস্যুদের গোঁফ-দাড়ি নকল, ছবির সেটও কৃত্রিম। আলগা একটি সেতুও বসানো হয়েছে যার নীচে গরম পানির নহর। দস্যুদের ডেরায় হীরা জহরতের সিন্দুক, হাতে খাঁজ কাটা তরবারি, তাদের পরনে কালো আলখাল্লা আর মাথায় পাগড়ি।
আরেকটি স্থিরচিত্রে দেখলাম আদালতের দৃশ্য। এখানে নায়ক আলমগীর উকিলের পোশাক পরা। নায়িকা অনজু কাঠগড়ায়। কৌতুক অভিনেতা দিলদারের একটি মুখ ভ্যাঙচানো ছবিও দেখলাম। এরও নামধাম নেই। এরপর রঙিন নয়নমনি ছবির পোস্টার নেগেটিভ দেখলাম। আলমগীর পিকচার্সের এই ছবিটির পরিচালক মতিন রহমান। এতে লেখা, ১২ই সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ দেশব্যাপী শুভমুক্তি। দীর্ঘ বন্যায় স্থবির হয়ে যাওয়া সিনেমা ব্যবসা চাঙ্গা করতে আসছে রঙিন নয়নমণি। তারপর একটি স্মরণসভার ছবি দেখলাম। আলমগীর পিকচার্স এটি আয়োজন করেছিল চিত্রগ্রাহক সাধন রায়ের আত্মার শান্তি কামনায়। কোনো এক ফ্যান্টাসি ছবির আরেকটি স্থিরচিত্র হাতে পেলাম। তাতে বড় চাঁদ ও খেজুর গাছ দিয়ে সেট বানানো হয়েছে। শাবানা এই ছবির নায়িকা ছিলেন। নায়ককে চিনতে পারলাম না, তার হাতে আরবী বাদ্যযন্ত্র রাবাব দেখলাম।
একটা ছবির অ্যাকশন স্টিল পেলাম। তাতে লড়ছে জাম্বু ও সোহেল রানা। এরপর কোনো এক মার্শাল আর্ট ছবির একটি স্টিল ফটোতে নায়ক রুবেলকে দেখলাম হাতের আঘাতে পাথর ভাঙছে। আরেকটি ছবিতে সেসময়কার ডান্সবারের চেহারা দেখলাম। তার চেয়ারগুলো কাঠের, টেবিলে বিয়ারের বোতল, নায়িকা টপস আর স্কার্ট পরে নাচছে। ফোক ছবি 'রূপের রানী চোরের রাজার'ও স্টিল দেখলাম। এই চলচ্চিত্রের নায়ক জাভেদ আর নায়িকা সুচরিতা। শহীদুল আমিন ছিলেন এর পরচালক।
তারপর পেলাম আজহার পরিচালিত জোকার ছবির স্টিল ফটো। নায়করাজ রাজ্জাক এ ছবির নায়ক। এতে রাজ্জাককে দেখলাম রক্তাক্ত। এই ছবিতে আরো অভিনয় করেছেন জুলিয়া, নারায়ণ চক্রবর্তী, আশীষ কুমার। ছবিতে নবাগত ছিলেন কাজরী।
এরপর কয়েকটি কাটআউট স্টিল ফটো পেলাম। এগুলো পোস্টারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল বোধকরি। একটিতে যেমন নায়িকা নতুন মাথায় মুকুট পরা, কানে লম্বা দুল। তার চাহনিতে আবেদন রয়েছে। আরেকটি 'দিল' ছবির কোলাজ কাটআউট। অনেকগুলো পাত্রপাত্রী এতে, শাবনাজ-নাঈম, আহমেদ শরীফ, আফসানা মিমি, এটিএম শামসুজ্জামান। কারোর ভঙ্গিতে প্রেম, কারোর চোখে ক্রোধ।
মাত্রই সোয়াশ বছর বয়স চলচ্চিত্রের। অল্পদিনেই এটি হয়ে উঠেছে সেরা বিনোদন মাধ্যম। টিকেট কাটতে পয়সা জমানো, গরুর গাড়ি ভাড়া করে আসা, নায়িকার বাড়ির দরজায় অনশন, নায়ক বিয়ে করায় কেঁদে বালিশ ভেজানো, তাঁবু টানিয়ে প্রেক্ষাগৃহ সংলগ্ন মাঠে রাত কাটানোসহ অনেক অনেক ঘটনা আছে চলচ্চিত্রের। চলচ্চিত্র সময়েরও বয়ান। ঢাকা শহর যেমন ছিল ত্রিশ বছর আগে বা চল্লিশ বছর আগে কেমন ছিল গাঁয়ের মানুষের পোশাক-আশাক অথবা পঞ্চাশ বছর আগে জীবনান্দের ধানসিঁড়িতে পানি বইত কি না- ছবিগুলো সময়গুলোকে ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনল। তাই ছবিগুলো স্থির হলেও যেন কথা বলল অনেক।