স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে ৬টি ভুল ধারণা
স্নায়ুযুদ্ধ ছিল মূলত পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটি আদর্শগত লড়াই। সাম্যবাদ বনাম পুঁজিবাদের লড়াই; পেপসি বনাম কোকের লড়াই। শেষের লাইনটি মজার ছলে বলা হচ্ছে মনে হলেও আক্ষরিক অর্থে এটিই সত্যি। পূর্ব-পশ্চিমের এই লড়াই চলেছে কয়েক দশক ধরে। কয়েক প্রজন্ম সাক্ষ্য হয়েছে এই দ্বন্দ্বের। ১৯৪০ থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত এই উত্তেজনা কখন সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নেয়, এই ভয় সব সময় কাজ করেছে সবার মনে।
আবার এই সময়টিই ছিল ২০ শতকের সবচেয়ে ভুল ধারণাযুক্ত অধ্যায়গুলোর মধ্যে একটি। বছরের পর বছর ধরে গোপন প্রচারণা এবং প্রপাগান্ডার ইতিহাসের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক জল্পনা আর ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে।
এরকম ৬টি ভুল ধারণা নিয়েই আজকের আলোচনা:
'কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময়ই কেবল বিশ্ব পারমাণবিক যুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছেছিল'
অতীতে সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা পারমাণবিক যুদ্ধের কথা ভাবলে কেবল ষাটের দশকের কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের কথায়ই মাথায় আসে। মনে হয় যেন, সামান্য বিচক্ষণতার অভাব হলেই চোখের পলকে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। তবে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটই একমাত্র সংকট নয় যখন সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।
১৯৮৩ সালের নভেম্বরে 'অ্যাবল আর্চার' ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও পারমাণবিক যুদ্ধের অনেক কাছাকাছি চলে গিয়েছিল সে সময়ের মার্কিন-সোভিয়েত।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর একটি সামরিক প্রশিক্ষণ অনুশীলনের নাম অ্যাবল আর্চার। পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হলে কী ঘটতে পারে এবং তখন কী করতে হবে তা অনুশীলনই এই প্রশিক্ষণের মূল বিষয়। বিশাল বিমানবহর এবং ১৯ হাজার সৈন্যের অংশগ্রহণে চলত অ্যাবল আর্চার। আসল বিমানে লোড করা হতো নকল বোমা। এমনকি রেডিও সিগনালের মাধ্যেও বিভ্রম বজায় রাখা হতো সর্বত্র, যেন পরিস্থিতিকে বাস্তব বলে মনে হয়।
আশির দশকের এক নভেম্বরে যখন ন্যাটো অ্যাবল আর্চারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক তখনই মার্কিনীদের ভুল বুঝে বসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভেবে সোভিয়েতও পাল্টা জবাবের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিল। ন্যাটোর মতো তারা আসল বিমানে নকল বোমা নয় বরং আসল বিমানে আসল বোমা লোড করেই রওনা হয়েছিল আর্কটিকের দিকে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরও একটি ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে পৃথীবিকে বাঁচাতে ভূমিকা রেখেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল লিওনার্ড পেরুটস। তিনি ছিলেন ইউরোপে মার্কিন বিমান বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ। সোভিয়েত কীভাবে মার্কিন প্রশিক্ষণ মহড়ার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে তা সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন তিনি। বুঝতে পেরেছিলেন তাৎক্ষণিকভাবে কিছু না করলে পারমাণবিক যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা চরমে উঠবে।
সত্যিকারের যুদ্ধ আঁচ করতে পেরে পেরুটস তার ঊর্ধ্বতনদের মহড়া আর না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার পরামর্শ কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যুক্তরাজ্যে নিয়োজিত একজন কেজিবি এজেন্ট সোভিয়েত সরকারকে এ কথা জানায়। আর এরমাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে পারমাণবিক সংঘাতের উত্তেজনা কমে আসে।
এই ঘটনার ওপর বই লিখেছেন লেখক নেট জোনস। তার মতে, "পেরুটস যদি সোভিয়েতদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ না করে পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজিত করে তুলতেন, তাহলে যুদ্ধের ভীতি সম্ভবত যুদ্ধেই পরিণত হতো।"
'স্নুযুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের ওপর নজর রাখতে শুধু গোপনেই গুপ্তচর নিয়োগ দেওয়া হতো'
রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্য লাভে গুপ্তচর বা গোয়েন্দা নিয়োগ দিয়ে থাকেন শাসকরা। সমর কৌশলবিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ 'দ্য আর্ট অফ ওয়ার'-এ সান জু গুপ্তচরবৃত্তির সুবিধা নিয়ে বিশদভাবে লিখেছেন। কীভাবে রোমান সম্রাটরা গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জর্জ ওয়াশিংটন গুপ্তচরবৃত্তি থেকে কতখানি সুবিধা পেয়েছিলেন তা ইতিহাসের পাতা থেকে মোটামুটি সবারই জানা।
কিন্তু আধুনিক যুগে অধিকাংশের ধারণা, কেবল গোপনেই শত্রুর দেশে নিয়োগ দেওয়া হয় গুপ্তচর তথা গোয়েন্দা অফিসারদের। এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঊর্ধ্বতনদের আদেশ অনুযায়ী অভিযান সম্পন্ন করতে শত্রুর দেশে পাড়ি দেন। এরকম ধারণা তৈরি হওয়ার পেছনে জেমস বন্ডের মতো হলিউড সিনেমার একটি বড় প্রভাব থাকতে পারে। তবে বাস্তব চিত্র কিন্তু সেরকম নয়।
বাস্তবে গুপ্তচরেরা তাদের প্রতিপক্ষের অজান্তেই শুধু অবৈধ অভিযান বন্ধের উদ্দেশ্যে কাজ করেনি বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা প্রতিপক্ষের কাছে উষ্ণ অভ্যর্থনাও পেয়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধকালীন সোভিয়েত এবং পশ্চিমের মধ্যে গুপ্তচর নিয়োগ সম্পর্কিত একটি চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তির মাধ্যমে দুইপক্ষের কিছু সংখ্যক গোয়েন্দা অফিসারকে জার্মানিতে উভয় পক্ষের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। মূলত পরাশক্তিদের মধ্যকার উত্তেজনা কমাতেই নেওয়া হয়েছিল এই উদ্যোগ, যা সফলভাবেই কাজ করেছিল সে সময়।
মূল কথা হল, আপনি যদি নিজের কর্মকাণ্ডের ওপর আপনার প্রতিপক্ষকে কিছুটা নজর রাখার সুযোগ দেন, তাহলে এটি নিঃসন্দেহে উত্তেজনা কমাবে এবং প্রতিপক্ষকে মানসিক শান্তি দেবে। কার্যত এই জিনিসই ফলপ্রদ প্রমাণিত হয়েছিল পূর্ব-পশ্চিমের স্নায়ুযুদ্ধে।
'বেশিরভাগ আমেরিকান মহাকাশ প্রতিযোগিতাকে সমর্থন করেছেন'
স্পেস রেস বা মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতা স্নায়ুযুদ্ধকালীন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ষাটের দশকের শেষের দিকেই চন্দ্র জয় করবে, তখন আমেরিকানদের জন্য এটি ছিল বিশাল কিছু প্রাপ্তি।
অবশেষে ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে চাঁদে মানুষ পাঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মানবজাতির ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে এ ঘটনা।
ষাটের দশকে চন্দ্রযান অ্যাপোলোর উৎক্ষেপণে খরচ হয়েছিল ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আজকের দিনে হিসাব করলে দাঁড়াবে অন্তত ১৫২ বিলিয়ন ডলারে। এতো খরচের কারণেই মূলত সে সময়ে চাঁদে অভিযান চালানোর ব্যাপারটি আমেরিকার বেশিভাগ নাগরিক সমর্থন করেননি। উল্লেখযোগ্য একাংশ এই ব্যয়ের সমালোচনা করেছিলেন।
১৯৬৫ সালের এক জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৩৯ শতাংশ মার্কিন নাগরিক ক্ষয়-খরচা নির্বিশেষে চন্দ্র অভিযানের পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
'স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়টিই ছিল উত্তেজনাপূর্ণ'
স্নায়ুযুদ্ধের কথা চিন্তা করলেই দুইপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে এমন একটি উত্তেজনাপূর্ণ সময়ের কথা মাথায় আসে। ইতিহাস পড়লে চল্লিশ থেকে আশির দশক পুরোটা সময়জুড়েই এই উত্তেজনা চলেছে বলে মনে হতে পারে। তবে বাস্তবে ঘটনা ছিল কিছুটা ভিন্ন।
এ কথা সত্যি যে, পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকজুড়ে উত্তেজনা ছিল চরমে। কিন্তু এরপর ৭০-এর দশকে আবার দুইপক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা অনেকটাই কমে এসেছিল। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং সোভিয়ের নেতা লিওনিড ব্রেজনেভের।
১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট সরকারি সফরে মস্কো ভ্রমণ করেছিলেন; তিনি আর কেউ নন, রিচার্ড নিক্সন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সফর স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা অনেকটাই প্রশমিত করতে পেরেছিল। এ সময় দুই দেশের নেতার মধ্যে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বেশ কয়েকটি চুক্তি হয়েছিল, যা উভয় পক্ষই যথাযথভাবে মেনেছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এটিকে 'ডিটেন্ট' বা 'নিবারণ কৌশল' হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে এই শিথিলতা টিকে থাকেনি খুব বেশি দিন।
১৯৭৪ সালে ওয়ারগেট কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদত্যাগের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবারও আগের পরিস্থিতিতেই ফিরে যায় সোভিয়েত-মার্কিন সম্পর্ক।
'সোভিয়েত সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত ছিল'
যদি কেবল সে সময়ের প্রচারণাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা হয়, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সম্পূর্ণভাবে একটি 'সন্ন্যাস রাজ্য' হিসেবে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে পরিস্থিতি ঠিক সেরকম ছিল না।
নিজেদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাইরেও সোভিয়েত সরকার প্রায়ই ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে আমেরিকান চলচ্চিত্র ক্রয় করত। বিশেষ করে, মার্কিন কমেডি সিনেমাগুলো বেশ চলতো সোভিয়েত ইউনিয়নে।
এর পাশাপাশি স্নায়ুযুদ্ধকালীন বহুল পরিচিত আমেরিকান ব্র্যান্ড পেপসিও ব্যাপক ব্যবসা চালিয়েছে সোভিয়েত অঞ্চলে। পেপসিই ছিল সোভিয়েভ ইউনিয়নে প্রবেশ করা প্রথম কোনো মার্কিন ভোক্তা পণ্য। ১৯৭৪ সাল থেকে সোভিয়েতে পেপসির আমদানি শুরু হয়। কিন্তু সে সময়েও রুশ মুদ্রা রুবলের ওপর ছিল মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। তাই আমদানিকারক কোম্পানি পেপসির বিপরীতে অর্থ দিতে না পেরে বিনিময় সম্পন্ন করেছিল নিজেদের তৈরি ভদকা দিয়ে। এর মাধ্যমে সোভিয়েত পেল মার্কিন পেপসি। আর যুক্তরাষ্ট্র পেল সোভিয়েত ভদকা।
ধারণা করা হয়, আশির দশকের শেষের দিকে প্রতি বছর এক বিলিয়নেরও বেশি পেপসি রপ্তানি হতো সোভিয়েত ইউনিয়নে।
এর কিছু সময় পরে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে যখন সোভিয়েত ভেঙে পড়তে লাগলো, তখন অন্যান্য মার্কিন ব্র্যান্ড যেমন- ম্যাকডোনাল্ডস এবং পিৎজা হাট, এগুলোও ধীরে ধীরে মস্কোর আশেপাশে ব্যবসা পেতে বসতে শুরু করে।
'সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমেই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে'
১৯৯১ সালের ক্রিসমাসের রাতে অনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় এবং ধরে নেওয়া হয় এর মাধ্যমেই স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে।
কিন্তু বাস্তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হওয়ার কয়েক বছর আগেই অবসান ঘটেছিল স্নায়ুযুদ্ধের। আশির দশকের শেষের দিকে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ধীরে ধীরে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে আরও খোলামেলাভাবে আলোচনা শুরু করেছিলেন। ১৯৮৮ সালের মে মাসে যখন একজন সাংবাদিক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি এখনও সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি 'কুখ্যাত সাম্রাজ্য' বলে মনে করেন কিনা, জবাবে রোনাল্ড রিগ্যান বলেছিলেন, "আমি এখন নয় অন্য সময়ের, অন্য যুগের কথা বলছি।" অথচ এর কিছুদিন আগেও হোয়াইট হাউজ থেকে এই ধরণের বক্তব্য ছিল কল্পনাতীত।
এর পরের বছর ১৯৮৯ সালেই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয়। একই বছর মাল্টা সম্মেলনে দেখা করেন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ এবং মিখাইল গর্বাচেভ। এ সময় পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতের জন্য একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছিলেন তারা। মূলত সে বছরই শেষ হয়ে যায় স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা।
- সূত্র: মেন্টাল ফ্লস