তবে কি মুনিয়ারা হারিয়ে যাবে ঢাকা শহর থেকে?
গল্পটা বেশিদিন আগের নয়। মাত্র ৫ বছর আগের। সাল, ২০১৭। দ্বিতীয় বর্ষে পড়তাম তখন। ছুটির দিনগুলোতে ভোরবেলা নিয়মিত ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাখি দেখে বেড়াতাম। উত্তরা, দিয়াবাড়ি, খিলক্ষেত, মিরপুর, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা, বলধা গর্ডেনসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছুটতাম। সকালবেলা নিশ্চুপ ঢাকা ছিল একেবারে অন্যরকম। বিশেষ করে উত্তরা, দিয়াবাড়ি, খিলখেত থেকে সূর্যোদয়ের মুহূর্ত। ঢাকার আশপাশের এই এলাকাগুলোতে গেলে, জায়গাগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে ধারণা করা যায় ঢাকা একসময় প্রাকৃতিক পরিবেশে সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল। কিন্তু ওই এলাকাগুলো কি এই চার বছরে আগের মতোই আছে?
দক্ষিণ এশিয়ার আয়তনে খুব ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু ওরিয়েন্টাল নামক প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চলে অবস্থানের কারণে এই দেশ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। জীববৈচিত্র্যের মধ্যে এক অন্যতম জায়গাজুড়ে রয়েছে এদেশের বিচিত্র রং, বর্ণের, গঠনের, আকৃতির অনন্যসুন্দর ৭০০-র অধিক প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি। যাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় সবাই।
তেমনই একটি সুন্দর পাখি মুনিয়া। Passeriformes বর্গের Estrildidae পরিবারের অন্তর্গত ৬ প্রজাতির এই পাখির দেখা মেলে সারা দেশে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে মানবসৃষ্ট সমস্যা, দ্রুত নগরায়ন, আবাসস্থল ধ্বংস, শিকারসহ বিভিন্ন কারণে এই পাখিরা আজ বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশের ৬ প্রজাতির মুনিয়া ২ টি গণে বিভক্ত। Lonchura গণে ৫টি এবং Amandava গণে একটি পাখি রয়েছে। ইংরেজিতে Lonchura গণের পাখিদের Munia এবং Amandava গণের পাখিদের Avadavat বলে ডাকা হয়। ছোট আকৃতির এই পাখিদের চঞ্চু কোনাকার, যা বীজ-জাতীয় খাবার গ্রহণে সহায়ক।
১৭ শতকের দিকে গোড়াপত্তন হয় ঢাকা নগরীর। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে কিছু বসতি ছাড়া উত্তর দিকের মিরপুর, পল্টন, তেজগাঁও, কুর্মিটোলা ছিল বিশাল জঙ্গল আর দক্ষিণের কামরাঙ্গীরচর ছিল বিশাল বাদাবন। এবং এই এলাকাগুলোতে বাঘ, বিশাল অজগর, বুনো শূকর, বন্য বিড়াল, মেছো বিড়াল, সোনালি বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণীর আনাগোনাও ছিল। ৫০ বছর আগেও ঢাকা ছিল আবাসস্থল, অফিস, দোকান আর রাস্তার চেয়ে জলা, বনজঙ্গল, তৃণভূমির সমন্বয়ে গঠিত এক অপূর্ব ক্যানভাস। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, তখন বর্তমানে ঢাকার বর্তমান ব্যস্ত এলাকাগুলোতেও আনাগোনা ছিল বন্যপ্রাণীদের। ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। কাঁটাবন থেকেও পাওয়া যেত শিয়ালের ডাক। একসময় দেশি ময়ূর, লাল বনমোরগ, মেটে তিতির, কালো তিতিরদের বিচরণের এলাকাগুলো পরিণত হয়েছে ইটকাঠ আর জঞ্জালের স্তূপে। আর তারা হয়েছে ঢাকা থেকে বিলুপ্ত। বুনোহাঁস, সারসদের জলাশয়গুলো প্রাণ হারিয়ে পঁচা ডোবা আর বিভিন্ন ধরনের সংক্রমক ব্যাধির মূল উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষ নিজেই তৈরি করছে তার মৃত্যু কফিন। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে তার ভারসাম্য। চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু যেন প্রতিদিনের ঘটনা।
ঢাকা শহরের পাখিদের মধ্যে অন্যতম মুনিয়া নামক পাখিরা। আকারে চড়ুইয়ের মতো আকৃতি এই পাখির।
ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকা, আশেপাশের ঘাস বন, পার্ক ইত্যাদি এলাকায় যে মুনিয়া পাখিটিকে সব থেকে বেশি চোখে পড়ে তা হলো তিলা মুনিয়া বা ইংরেজিতে Scaly-breasted Munia. বৈজ্ঞানিক নাম Lonchura punctulata. এরা আমাদের দেশের আবাসিক পাখি। সারা দেশেই সহজে দেখা মেলে এই পাখিদের। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এদের প্রজননকাল। কাশবন, ঘাসবন বা ঝোপঝাড়ে গোলাকার বাসা তৈরি করে এরা।
আর এক প্রজাতির মুনিয়া যাদের ঢাকা শহরে বেশি দেখা যায় তারা হলো দেশি চাঁদি ঠুটি। ইংরেজিতে Indian Silverbill এবং বৈজ্ঞানিক নাম, Lonchura malabarica. খুব মোটা, কোনাকার, ছোট ধূসর চঞ্চু পাখিটিকে দিয়েছে এক অনন্য সৌন্দর্য। দিবাচর এই পাখিটিকে দলবদ্ধ ভাবে দেখা যায় শহরে সর্বত্র। সাধারণত শষ্যদানা, বীজ আর পোকামাকড় খেয়ে থাকে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর এদের প্রজনন ঋতু। এরাও গোলাকার বাসা তৈরি করে, সাধারণত ঝোপঝাড়ে।
কালোমাথা মুনিয়া বা ইংরেজিতে Chestnut Munia। বৈজ্ঞানিক নাম, Lonchura atricapilla. গাঢ় বাদামি রঙের সুন্দর ছোট এই পাখিটির মাথা ও পেট কালো।
রূপালী-নীল বর্ণের ছোট, মোটা চঞ্চু পাখিটিকে দিয়েছে এক অনন্য সৌন্দর্য। এদেরকে সারা দেশের কাশবন, ঘাসবন, নলখাগড়ার বনে দেখা যায়। শহরের আশপাশের ঘাসবনেও এদের দেখা মেলে। দিবাচর এই পাখিরা ছোট কিংবা বড় দলে, দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। শস্যদানা, বীজ এবং পোকামাকড় খেয়ে এরা বেঁচে থাকে। প্রজননকাল মে থেকে নভেম্বর মাস। এরাও গোলাকার বাসা তৈরি করে। ঢাকা শহরের আশপাশের কাশ, ঘাসবনে সহজেই এই পাখিদের দেখা মেলে।
তিনরাঙা মুনিয়া দেখতে কালামাথা মুনিয়ার মতোই, কিন্তু পেটে সাদা পট্টি রয়েছে। ইংরেজি নাম Tricolored Munia, আর বৈজ্ঞানিক নাম Lonchura malacca. প্রজননকাল সাধারণত বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতু। ছোট গ্রুপে বসবাস করে। সাধারণত কালোমাথা মুনিয়ার ঝাঁকে দেখা মেলে। শস্যদানা, বীজ এবং পোকামাকড় খেয়ে এরা বেঁচে থাকে। এরাও গোলাকার বাসা তৈরি করে।
ধলাকোমর মুনিয়া বা White-rumped Munia অন্যান্য মুনিয়া থেকে একটু কম দেখা যায়, বিশেষ করে শহরে। সাধারণত ঘাসবন, ঝোপঝাড়ে এই পাখিদের দেখা মেলে। শস্যদানাই এদের প্রধান খাদ্য। মে থেকে সেপ্টেম্বর এদের প্রজনন ঋতু। গাছের ডালে, বাঁশবাগানে ছোট গোলাকার বাসা তৈরি করে। দিবাচর এই পাখিরা ছোট গ্রুপে বিচারণ করে। ধলাকোমর মুনিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম Lonchura striatastriata.
Amandava গণে এক প্রজাতির মুনিয়ার দেখা মেলে। আমাদের দেশে এর বৈজ্ঞানিক নাম Amandava amandava বা Red Avadavat, আর বাংলা নাম লাল মুনিয়া। লাল রংয়ের হওয়ায় এই মুনিয়া সবার কাছে খুবই আকর্ষণীয়। পুরুষ লাল মুনিয়ার প্রজনন মৌসুমে উজ্জ্বল লাল দেহ এবং তার উপর সাদা ফোঁটা আকৃষ্ট করে সবাইকে। লাল আইরিশ, লাল চঞ্চু পাখিটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এরা দিবাচর পাখি। ছোট দলে ঘাস, কাশ ও নলখাগড়ার বনে বিচরণ করে। সারা দেশে থাকলেও এদের দেখা পাওয়া খুব সহজ নয়। জুন থেকে ডিসেম্বর মাস এদের প্রজনন ঋতু আর এই সময়ে ঘাস, কাশ অথবা নলখাগড়ার বনে গোলাকার বাসা তৈরি করে। শহরের আশপাশেও এদের দেখা মেলে।
ঢাকায় ক্রমেই বাড়ছে মানুষের চাপ। অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভারে আজ সে বসবাসের অনুপযোগী নগরী। আর অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য দরকার অধিক খাদ্য, বাসস্থানের পাশাপাশি উৎপন্ন হচ্ছে অধিক পরিমাণে পরিবেশ দূষণকারী পদার্থ। আর এই সমস্ত কিছুর চাপ গিয়ে পড়ছে পরিবেশের ওপর। ক্রমেই কমছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। বন্যপ্রাণীরা ক্রমেই হারাচ্ছে তাদের প্রকৃতিক আবাসস্থল এই শহরে। আর এমনি সুন্দর মুনিয়া পাখিদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এই শহর থেকে।
উত্তরা, দিয়াবাড়ি, খিলক্ষেতের সেই প্রকৃতিক পরিবেশ আর নেই। নেই সেই কাশবনের জৌলুস, নলখাগড়ার বন। নেই সেই জলাশয়গুলো। সেখানেও দাঁড়িয়ে গেছে দৈত্যসমান অট্টালিকা। বুনো জীবদের প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা ভাবার সময় আর কারও নেই। তাদেরও যে একটু আবাসস্থল দরকার, তা কেউ ভাবেনি। যতগুলো পাখি টিকে আছে, তারাও আজ হুমকির মুখে। যার ফলে শহর থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে এই পাখিরা।
পাশাপাশি শহরগুলোতে এখন প্রায়ই মুনিয়া পাখি অবৈধভাবে বিক্রি হতে দেখা যায়, যা এই পাখিগুলো কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। যদিও বুনোপাখি বিক্রি প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের।
উপরের চিত্রটা শুধু ঢাকা শহরের হলেও পুরো বাংলাদেশে কিন্তু বলতে গেলে একই অবস্থা। সমস্ত মুনিয়া পাখি আইইউসিএন বাংলাদেশ-এর ২০১৫ সালের তথ্যমতে, ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হলেও যেভাবে এই পাখিরা আবাসস্থল হারাচ্ছে, তাতে অচিরেই হয়তো হারিয়ে ফেলব আমরা এই পাখিদের আমাদের শহর থেকে।
বর্তমান সময়ে আমাদের নগরায়ন জরুরি। কিন্তু সেটা দরকার পরিকল্পনামাফিক। শহরে সবুজ আচ্ছাদন জরুরি। দরকার আশপাশের কাশবন, ঘাসবন, নলখাগড়ার বন সংরক্ষণ; জলাশয়গুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা। বুনো পাখিদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা ব্যতীত কখনোই এই পাখিদের সংরক্ষণ সম্ভব নয়।
শিশুদের সচেতন করা খুবই জরুরি। বনের পাখিরা বনে সুন্দর, খাঁচায় তার জীবনের গল্প তিলে তিলে শেষ হয়—এটা বুঝাতে হবে ছোট বাচ্চাদের। আর ছোট অবস্থায় যে শিক্ষালাভ, তা তার সারা জীবনে প্রতিফলিত হবে। তাদের হাতেই রক্ষা পাবে আগামীদিনের পৃথিবী। রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র্য। রক্ষা পাবে এই ছোট, সুন্দর পাখিরা।
- আশিকুর রহমান সমী: ওয়াইল্ড লাইফ ইকোলজিস্ট, সিইজিআইএস বাংলাদেশ; শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়