ভারতবর্ষের একদার প্রবল প্রতাপের ফার্সি ভাষা যেভাবে ইতিহাস হয়ে গেল!
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে যদি জনৈক সংস্কৃত বলা ব্যক্তি কোনো আবেস্তীয়ভাষীর সাথে মোলাকাত করতেন, তাহলে হয়তো দু'চারটে দরকারি কথা চালানো তাদের জন্য মুশকিল হয়ে উঠত। তারপরও ওই দুটো ভাষার মধ্যে অনেক কিছুরই মিল ছিল।
সংস্কৃতে 'নামন' মানে নাম। আবেস্তীয় ভাষাতেও 'নামান' দিয়ে নামকে বোঝানো হতো। একইভাবে সংস্কৃতে মা ও বাবা'র জন্য 'পিতর' ও 'মাতর' শব্দদুটি ব্যবহার করা হয়। আবেস্তীয় ভাষায় এগুলো ছিল 'পাতার' ও 'মাতার'।
তবে গণ্ডগোলটা যদি কোথাও বাধত, তবে সেটা হতো ধর্মসম্পর্কিত বিষয়ে। সংস্কৃতে দেবতা বোঝাতে ব্যবহৃত 'দেবা' শব্দটি আবার আবেস্তীয়তে 'শয়তান' বোঝাত। এর দ্বারা হয়তো দুই জাতের মধ্যকার ধর্মীয় দ্বন্দ্বের দিকটাই ফুটে উঠেছিল। যদিও দুটো গোষ্ঠীরই ভাষাগত ও জাতিগত উৎপত্তির এক অভিন্ন সংযোগ ছিল।
ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবার থেকেই সংস্কৃত ও আবেস্তীয় ভাষার উৎপত্তি। ৪০০০ থেকে ৫০০০ বছর আগে এ ভাষা পরিবার দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি হয় পারসিক (অধুনা ইরান) শাখা, যেটার অংশ আবেস্তীয় ভাষা। অন্যটি ইন্দো-আর্য শাখা, যেটার অংশ ছিল সংস্কৃত ভাষা।
বর্তমানে আবেস্তীয় কেবল ধর্মপুস্তকের ভাষা হিসেবে জরথুস্ত্রীয়দের মাঝে ব্যবহৃত হয়। তবে এখন পর্যন্ত টিকে থাকা ফার্সি ইত্যাদির মতো আধুনিক ইরানিয়ান ভাষায় এখনো আবেস্তীয় ভাষার প্রভাবের দেখা মেলে।
ফার্সি ভাষার উৎপত্তি সরাসরি আবেস্তীয় ভাষা থেকে হয়নি। তবে আকেমেনিড ইত্যাদির মতো সুপ্রাচীন পারস্যের বিভিন্ন শাসনামলে প্রধান ভাষাতাত্ত্বিক মাধ্যমের ভূমিকা পালন করেছিল আবেস্তীয়। এরপর মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন বহু-নৃতাত্ত্বিক মুসলিম সাম্রাজ্যের সময়গুলোতে আবেস্তীয় লিংগুয়া-ফ্রাঙ্কা হিসেবে কাজ করেছিল।
আধুনিক যুগের শুরুতে কয়েকশ বছর ধরে মোগল সাম্রাজ্যের রাজদরবারে বিভিন্ন হিন্দু সভাসদেরা ফার্সি ভাষায় কথা বলতেন। সংস্কৃতি থেকে তৈরি হওয়া উর্দু ও হিন্দির মতো ভাষার পাশাপাশি ফার্সি ভাষাও ব্রিটিশরা আসার আগে ভারতের সম্ভ্রান্ত মানুষজনদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
এমনকি ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার সময়েও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক মুসলমান পণ্ডিতেরা ফার্সি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। পাকিস্তানের জাতীয় কবি মোহাম্মদ ইকবালের মতো অনেকেই ফার্সিতে দুর্দান্ত সব সাহিত্য রচনা করেছেন।
'ফার্সি ও সংস্কৃত, দুইটি ভাষাই বনেদী ভাষা হিসেবে বিবেচিত হতো এবং এগুলোর ব্যবহারকারী সম্ভ্রান্ত হিসেবে বিবেচিত হতেন,' এমনটাই লিখেছেন ইন্ডিয়া ইন দ্য পার্সিনেট এইজ: ১০০০- ১৭৬৫ শীর্ষক গ্রন্থের প্রণেতা রিচার্ড ইটন।
তিনি জানান, দুইটি ভাষারই শব্দভাণ্ডার ছিল ধনী। ধর্মীয় ক্ষেত্রে দুটো ভাষাই ব্যবহার করা হলেও, কোনো ধর্মের আবহে সীমাবদ্ধ ছিল না ভাষা দুইটি।
মহান সব রাজত্ব
সিন্ধু নদীর তীরঘেঁষা ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল প্রথম পারস্য সাম্রাজ্যের একটি অখণ্ড অংশ ছিল।
পারস্যের বৃহৎ আকেমেনিড সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইরাস দ্য গ্রেট। উপমহাদেশের উত্তরের অনেক অংশও দখলে নিয়েছিল পারসিকরা।
ভারতকে অধীনস্থ করা পারসিক শাসক ও ভারতীয় অভিজাতদের মধ্যকার সুসম্পর্ক ছিল। ভারতীয় ধনীরা পারসিক শাসকদের উপহার পাঠানোর অনেক প্রমাণ রয়েছে। এছাড়া পারসিক বিভিন্ন লেখায় ভারতীয় মানুষদের কথার উল্লেখ পাওয়া যায়।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট আকেমেনিড সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটান। তখন মেসিডোনিয়ার সেলুসিড, ইরানের পার্থিয়ানস, ও নব্য-পারসিক সাসানিয়রা সাবেক আকেমেনিড সাম্রাজ্যের অনেক অঞ্চল শাসন করতে শুরু করে।
৭ম শতকে সাসানিয়দের পরাজিত করে আরবের মুসলিমেরা। ইসলামের উত্থানের ফলে পারস্য-ভারত সম্পর্কে ভিন্নরকম দুইটি মোড় নেয়।
মুসলমানদের পারস্য বিজয়ের পর জরথুস্ত্রীয়দের বড় একটি অংশ নিপীড়নের ভয়ে ইরান থেকে ভারতে পালিয়ে যায়। তারা গুজরাটসহ অন্যান্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ভারতে তাদের পরিচিতি হয় পারসি হিসেবে।
বলা বাহুল্য, এই পারসিরা এখন আর ইরানি ভাষায় কথা বলেন না। ভারতে দ্বিতীয় পারসিক প্রভাবের সূচনা ঘটে ফার্সিভাষী মুসলিমদের থেকে। এরা মূলত তুর্কি ও ইরানি বংশের।
ভারতীয়, পারসিক, ও তুর্কি সংস্কৃতির মিলন
মধ্যযুগে দক্ষিণ এশিয়ায় পারসিকদের থেকে অনুপ্রাণিত যে সংস্কৃতির উৎপত্তি ঘটেছিল, সেটি ছিল মধ্য এশিয়ায় তৈরি হওয়া তুর্কি-পারসিক সংস্কৃতির অংশ।
যাযাবর তুর্কি জাতির মানুষেরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে বিভিন্ন ফার্সিভাষী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। তুর্কি ও পারসিক সভ্যতার এ সংস্কৃতি মুসলিমদের অভিযানের সাথে সাথে আরও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ে।
১১ শতকে তুর্কি সেনাপতি মাহমুদ গজনি উত্তর ভারত জয় করেন। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় পারসিক সংস্কৃতির প্রভাব সৃষ্টির একটি প্রাথমিক প্রভাবক।
গজনবি, ঘুরি, মামলুকদের শাসনামালে পারসিক সংস্কৃতিকে উৎসাহ প্রদান করা হয়। খিলজি, তুঘলক, সাইদ, ও লোধি শাসনামালে ফার্সি ছিল দাপ্তরিক ভাষা।
এনসাইক্লোপিডিয়া ইরানিকা'র তথ্যমতে, ১২০৬ সালে দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠার পর মধ্য এশিয়া ও পারস্য থেকে অনেক কবি দিল্লিতে আসেন। এভাবে ভারতের বহুজাতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায় পারসিক সাহিত্যও।
তুর্কিভাষী তিমুরিদ যুবরাজ বাবর ১৬ শতকে ভারতবর্ষ আক্রমণ করে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য তার আগেই ভারতে পারসিক সংস্কৃতি অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে, আমির খসরুর মতো বিখ্যাত কবির সৃষ্টি হয়েছে।
বাবরের উত্তরাধিকারীদের সময় ইন্দো-পারসিক সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা দেখা মেলে ভারতে। পারসিক স্থাপত্যরীতির ধাঁচে তৈরি হয় তাজমহল, জামে মসজিদের (দিল্লি) মতো স্থাপনাগুলো।
একইসাথে ভারতবর্ষে ধীরে ধীরে ছড়াতে থাকে মোগল রান্নাপ্রণালীও। এসবের মধ্যে বিখ্যাত কিছু মোগল খাবার হলো বিরিয়ানি, নিহারি, ও বিভিন্ন ধরনের কাবাব।
ইন্দো-পারসিক এ মিলনে সমৃদ্ধ হয় উর্দু ভাষাও। হিন্দি, এবং মোগল দরবারের ফার্সির প্রভাব পড়ে উর্দু ভাষার ওপর। মোগল শাসনামলে আরও তৈরি হয় অসংখ্য মিনিয়েচার চিত্রকর্ম, ফার্সি ভাষায় লেখা বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম।
ভারতে ফার্সির বিলুপ্তি
মোগল সাম্রাজ্যের পতন ও ব্রিটিশ শাসনের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে ফার্সিরও বিলুপ্তি ঘটে ভারতে। প্রথমদিকে দাপ্তরিক কাজে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফার্সি ভাষার ব্যবহার করে। আমলাতান্ত্রিক ভাষা হিসেবে তখনও ফার্সির প্রচলন ছিল ভারতে।
১৮০০-এর দশকেও ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ অফিসারদের শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ফার্সি ভাষা। তবে ভারতবর্ষে ইন্দো-পারসিক এ ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা বা ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে ইংরেজদের এ খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা একটি বিতর্কিত বিষয় ছিল খোদ ইংরেজদের কাছেই।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ নয়াদিল্লির তাবরিজ আহমেদ মনে করেন, ইংরেজদের মধ্যে একটা অংশ ছিল যারা 'ওরিয়েন্টাল'দের প্রথাকে সংরক্ষণ করতে চাইতেন। আরেকদল চেয়েছিলেন যতদিন পর্যন্ত ফার্সি ভাষা ব্যবহারের উপযোগিতা ছিল, কেবল ততদিনই এ ভাষা দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত হোক।
শেষ পর্যন্ত উপযোগিতাবাদীরাই জয়লাভ করে। ভারতে যখন ব্রিটিশরা শক্তপোক্ত ঘাঁটি গড়ে তুললো, তখন ১৮৩২ সালে দাপ্তরিক কাজে ফার্সির বদলে ইংরেজির ব্যবহার শুরু হলো।
দক্ষিণ এশিয়ায় সুন্নিভাবাপন্ন দেওবন্দী নেতারা ইসলামকে বহিরাগত প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য ইসলামের মূল পবিত্র গ্রন্থগুলোর ক্ষেত্রে ফার্সি ভাষার বদলে আরবি ভাষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।
যেটুকু প্রভাব টিকে আছে
ব্রিটিশদের নীতির কারণে উপমহাদেশ থেকে ফার্সি ভাষা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে সত্য, তবে এ অঞ্চলের শিল্পী ও কবিদের এখনো উৎসাহ জাগায় এ ভাষাটি।
নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের প্রধান ড. আবদুল হালিম বলেন, 'ফার্সি ভাষা, সাহিত্য, ও সংস্কৃতি দক্ষিণ এশিয়ায় এত গভীরে প্রোথিত হয়েছে যে এটাকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দেওয়া অসম্ভব।'
'১৮৩৫ সালের পর থেকে মির্জা গালিব, মোহাম্মদ ইকবালসহ অন্যান্য মহাজ্ঞানী সব চিন্তাবিদ, কবি, দার্শনিকের উপস্থিতিই প্রমাণ করে এ অঞ্চলে ফার্সি ভাষা ও সংস্কৃতি কখনো এর লড়াই থামায়নি,' বলেন এ অধ্যাপক।
হালিম মনে করেন, ফার্সি জ্ঞান ছাড়া ভারতের কোনো ইতিহাস সম্পূর্ণ নয়। তার পরামর্শ, এ ভাষাটি পুনরুজ্জীবিত করলে তাতে ভারতীয় ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় জাতি তাদের অতীত ইতিহাস আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করা বেশিরভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পারসিক প্রভাব অবিচ্ছেদ্য; সেটা হোক তাদের আবাসস্থলে, তাদের খাবারে, বা তাদের ভাষায়।
বেশিরভাগ ইন্দো-আর্য ভাষায় অসংখ্য ফার্সি শব্দ মিলিত হয়ে এ ভাষাগুলোর অংশ হয়ে গেছে এখন। আসমান, দরিয়া, জমিন, বাজার, দরজা ইত্যাদি এরকম কয়েকটি ফার্সি শব্দের উদাহরণ যেগুলো এখন বাংলা ভাষার অংশ।
সূত্র: মিডল ইস্ট আই