বঙ্গবাজারের দোভাষীরা কথা বলতে পারেন আধডজন ভাষায়!
মো. আরমান তখন পুরান ঢাকার একটা বেকারিতে কাজ করেন। একবার এক ক্রেতা তাকে ইংরেজিতে খাবারের অর্ডার দিলেন। তার হাবভাবে বেশ ঔদ্ধত্য ছিল। ব্যাপারটা আরমানের পছন্দ হয়নি।
তাই 'লোকটা যখন কোক চাইল, আমি বলে দিলাম, নেই। ইংরেজিতে। ওই সময় লোকটার চেহারা যদি দেখতেন!' আরমানের কণ্ঠে গর্বের ছোঁয়া।
দারুণ সাবলীলভাবে ইংরেজি বলেন আরমান। শুনে প্রায় সহজাত মনে হয়। আসলে 'শো অফ' করা ক্রেতার গল্পটাও তিনি ইংরেজিতেই শোনাচ্ছিলেন।
অসাধারণ ব্যাপার হচ্ছে, প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোনো একজন মানুষ ইংরেজি, আরবি, ফারসি, ফরাসিসহ আধডজন ভাষায় কথা বলতে শিখে গেছেন। বাজারের অভিজ্ঞ দোভাষী আরমান জানালেন, 'আমি একদিনও স্কুলে যাইনি। কাজ করতে করতে, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি।'
শুধু আরমান না, গুলিস্তানের বঙ্গবাজারে তার মতো আরো ১৮ জন আছেন যারা বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারেন। তবে তারা এসব পড়তে বা লিখতে জানেন না। ভাষাগুলো তারা শিখেছেন দীর্ঘকাল বিদেশিদের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে।
তৈরি পোশাক পণ্যের জনপ্রিয় পাইকারি বাজার হলো বঙ্গ বাজার। এই দোভাষীরা বাজারে আসা বিদেশি ক্রেতাদের সাহায্য করেন, দোকান মালিকদের সঙ্গে দরাদরি করতে সাহায্য করেন।
বঙ্গবাজারের কাছে একটি ভবনের সিঁড়িতে রাবিয়া আর আরমানের সঙ্গে দেখা হয় আমাদের। দোভাষীরা সাধারণত গ্রাহক ধরার জন্য এখানে বসেই অপেক্ষা করেন ধৈর্য ধরে।
খানিকক্ষণ বোঝানোর পর আমাদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন তারা। তবে এক শর্তে—ছবি তোলা যাবে না। 'আমাদের ছবি তুলে লাভ কী? পরিবারের লোকজন খবরের কাগজে আমাদের ছবি দেখবে!'
বছর চল্লিশের শীর্ণকায় মহিলা রাবিয়া। হাতে ছোট্ট মোবাইল, বসে ছিলেন সাদা সাদা টাইলস করা সিঁড়িতে। চেহারায় চিন্তার ছাপ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 'সকাল থেকে একটাও গ্রাহক পাইনি।'
তার স্বামীও দোভাষী, কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় সেদিন আসেননি। রাবিয়ার কাছে তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। জিজ্ঞেস কলাম রাবিয়ার ভাষা-দক্ষতায় তাদের কৌতূহল হয় কি না।
তিনি জবাব দিলেন, 'মাঝে মাঝে আমি যখন কোনো বিদেশির সাথে ফোনে কথা বলি, তখন বাচ্চারা আমাকে বাক্যগুলোর অর্থ জিজ্ঞেস করে, এর বেশি কিছু না।'
তবে রাবিয়া ইংরেজির চেয়ে আরবিতে বেশি সাবলীল। আর দশজন কৌতূহলী বাঙালির মতোই আমরাও তাকে আরবি ভাষায় কিছু বলে শোনাতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন। বললেন, 'টেলিভিশনে যেমন শোনেন, ঠিক তেমনটাই। আলাদা কিছু না।'
আরমান ছোট মাপের দোভাষী। অনিশ্চিত এই পেশায় নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা বা উপার্জন নেই এ পেশায়। তাই তাকে কয়েক মাস বেকারিতে কাজ করতে হয়েছে।
পারিশ্রমিক হিসেবে গ্রাহকরা ২০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা—যেকোনো অঙ্কের অর্থ দিতে পারেন। পারিশ্রমিকের পরিমাণ নির্ভর করে তারা দোভাষীর সেবায় কতটা সন্তুস্থ হয়েছেন, তার ওপর। কখনও কখনও দোকান মালিকরা বিক্রির ভিত্তিতে তাদের কমিশন দেয়। কিন্তু শতাংশ কমিশন পান, তা জানাননি তারা।
পুরোনো কোনো গ্রাহক কল করে বা হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে না এলে বিদেশি ক্রেতারা আর বঙ্গবাজারে আসেন না। তাই আরমান, রাবিয়া, সুমি, কলি ও অন্য তাদের সহকর্মীরাও বাজারে নিয়মিত আসেন না।
কিন্তু একটা সময় ছিল যখন নির্দিষ্ট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট শিডিউলের উপর ভিত্তি করে তাদের নির্দিষ্ট কর্মদিবস ছিল। এয়ারলাইন্সের ক্রুরা ছিলেন বঙ্গ বাজারের শীর্ষ বিদেশি ক্রেতা।
আরমান বললেন, 'শুক্র-শনিবারে আমাদের প্রচুর ক্রেতা থাকত যারা সৌদি, কাতার এবং [সংযুক্ত আরব] আমিরাতে কাজ করেন। মঙ্গলবারে থাকত কিছু ফ্লাইট। তাই মঙ্গলবারে আমরা অনেক গ্রাহক পেতাম।'
তিনি জানালেন, আগে শেরাটন হোটেল (বর্তমানে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা) ও প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে ওঠা বিদেশি গ্রাহকদের জন্য বঙ্গবাজারে যাতায়াত করাই বেশি সহজ হতো।
কিন্তু যানজট ও বিমানবন্দরের কাছে নতুন নতুন হোটেল গড়ে ওঠার কারণে বিদেশি ক্রেতারা হোটেলের কাছাকাছি শপিং মলগুলো যেতেই পছন্দ করেন বেশি। আরমান বলেন, 'বসুন্ধরার মতো এলাকায় আরও কিছু দোকান আছে যেগুলোতে গার্মেন্টস পণ্য বিক্রি হয়। এয়ার-কন্ডিশনিং আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য একটু বাড়তি টাকা গুনতে ক্রেতারা আপত্তি করেন না।'
দোকানগুলো মাঝে মাঝে গ্রাহকদের ছাড় ও পরিবহন সেবা দেয় বলে জানালেন তিনি।
সব দোভাষীর সঙ্গে দেখা করতে পারলাম না। কারণ ব্যবসার অবস্থা খারাপ। তাই তাদের কেউ কেউ অন্য পেশায় চলে গেছেন (যেমন গ্রাহকদের কাপড় প্যাকিং ও বক্সিংয়ে সহায়তা করা)। নতুন দোভাষীরা কেন তাদের দলে যোগ দিতে পারেন না, জানালেন আরমান ও রাবিয়া।
তারা বলেন, 'নতুন কাউকে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করা যায় না। ধরেন, একজন গ্রাহক কয়েক লাখ টাকার পণ্য কিনলেন, আর নতুন দোভাষী সেগুলো নিয়ে পালাল, তখন? বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা সুনাম তো আর ধূলায় মিশে যেতে দিতে পারি না।'
স্ত্রী, বাবা-মা ও ভাইবোনদের নিয়ে পুরান ঢাকায় থাকেন আরমান। একটা ছোট দোকান ছিল তার। করোনাকালে লকডাউনের সময় দোকানটা বন্ধ করে দিতে হয় তাকে।
১৫ বছর ধরে দোভাষী হিসাবে কাজ করছেন আরমান। সেই অভিজ্ঞতার জোরে তিনি আত্মবিশ্বাসী, যে-কাউকে কথোপকথনের ইংরেজি শেখাতে পারবেন। মজার ছলে তিনি বললেন, 'আমি যদি এখন ভাষা ক্লাসে ভর্তি হই, ১০ মিনিটের মধ্যে সব কোর্স শেষ করে ফেলব!'
তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষ হওয়ার পর আরও কয়েকজন দোভাষীর সঙ্গে দেখা করার আশায় অপেক্ষা করছিলাম আমরা। কিন্তু সুমি জানালেন—তিনজনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম কথা বলছিলেন—অপেক্ষা করে লাভ নেই। একগাল হেসে বললেন, 'ওদের পাবেন না। কাস্টমারের খোঁজে সবসময় দৌড়ের ওপর থাকে ওরা।'
তার কথা শেষ হতে-না-হতেই একটা রুপালি ল্যান্ড রোভার এসে থামল কাছাকাছি। গাড়িটা দেখেই সেদিকে প্রায় দৌড়ে গেলেন সুমি। তাড়াহুড়ায় পা থেকে একটা চপ্পল খুলে গেল তার।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরমান বললেন, 'কাস্টমার বোধহয়!'