কী হবে যদি আমরা প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করে দেই?
২০১৫ সালে বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত ৮,৩০০ মিলিয়ন টন ভার্জিন প্লাস্টিকের মধ্যে ৬৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু এগুলোর অধিকাংশই এখনও আমাদের সাথে রয়ে গেছে; আরো স্পষ্টভাবে বললে, পরিবেশের মধ্যেই রয়ে গেছে। অ্যান্টার্কটিক সাগরের বরফের তলদেশ থেকে শুরু করে সাগরে বাস করা প্রাণীকূলের পেটের ভেতরে এবং মানুষের খাবার পানিতেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এখানে ভার্জিন প্লাস্টিক বলতে বুঝানো হচ্ছে- সদ্য উৎপাদিত আসল প্লাস্টিক, যা পুনরায় কোথাও ব্যবহার হয়নি।
কিন্তু যদি আমাদের হাতে একটা জাদুর কাঠির থাকতো এবং সেই জাদুবলে পৃথিবীর সব প্লাস্টিক নিমিষে দূর করা যেতো, তাহলে কেমন হতো? পৃথিবীকে বাঁচানোর স্বার্থে নিঃসন্দেহে এর চেয়ে বড় উপকার আর হয় না! কিন্তু তার আগে একনজরে দেখে নেওয়া যাক প্লাস্টিক কিভাবে আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে; আর প্লাস্টিক ছাড়া আদৌ জীবন ধারণ সম্ভব কিনা।
মানুষ হাজার হাজার বছর আগে থেকেই পোকামাকড় থেকে নিঃসৃত রজকের মাধ্যমে রেজিন থেকে তৈরি প্লাস্টিকজাতীয় পদার্থ (যেমন- শেল্যাক) ব্যবহার করছে। কিন্তু বর্তমানে আমরা প্লাস্টিক বলতে যা বুঝি তা ২০ শতকের আবিষ্কার। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি প্রথম প্লাস্টিকের নাম ছিল 'বাকেলাইট', যা ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত সামরিক বাহিনী ব্যতীত অন্যদের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সিনথেটিক প্লাস্টিকের উৎপাদন শুরু হয়নি। এরপর থেকে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিকের উৎপাদন শুধু বেড়েই চলেছে। ১৯৫০ সালে যে প্লাস্টিকের উৎপাদন ছিল ২০ লাখ টন, ২০১৫ সালে তা ৩৮ কোটি টনে গিয়ে দাঁড়ায়। প্লাস্টিকের উৎপাদন যদি এই হারে বাড়তে থাকে, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যেই তেল উৎপাদন ২০ শতাংশ বাড়বে।
বর্তমানে প্যাকেজিং শিল্প প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় ভোক্তা বা ব্যবহারকারী। কিন্তু আমরা আরও হাজার রকমভাবে দীর্ঘমেয়াদীভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার করি। আমাদের ভবন, পরিবহনসহ প্রধান অবকাঠামোগুলোতে এবং মোবাইল ফোন, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি পণ্য, কার্পেট, টিভি, পোশাকসহ অসংখ্য জিনিসে আমরা প্লাস্টিক ব্যবহার করি।
এই সবকিছুতে প্লাস্টিকের ভূমিকা দেখেই বোঝা যায়, প্লাস্টিকবিহীন পৃথিবী চিন্তা করা আপাতত অসম্ভব। কিন্তু আমরা যদি একটু চিন্তা করি- প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করে দিলে আমাদের জীবনে কী কী পরিবর্তন আসবে, তাহলে হয়তো আমরা এটির সাথে টেকসই সংযোগ তৈরির একটা নতুন উপায় বের করতে পারবো।
প্লাস্টিক না থাকলে কী কী সমস্যা হবে?
প্রথমেই দেখা যাক হাসপাতালের চিত্র। 'প্লাস্টিক ছাড়া একটা ডায়ালাইসিস ইউনিট চালানোর কথা ভাবাই যায় না', বলেন যুক্তরাজ্যের কিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার শ্যারন জর্জ। হাসপাতালে ব্যবহৃত গ্লাভস, টিউবিং, সিরিঞ্জ, রক্তের ব্যাগ, স্যাম্পল টিউব- সবকিছুতেই রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। এক গবেষণা অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের হাসপাতালে একটি টনসিলের অস্ত্রোপচারেই আলাদা ১০০ টুকরা প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। অনেক ডাক্তারই হাসপাতালে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বেশি ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, কিছু চিকিৎসা উপকরণ রয়েছে যা না ব্যবহার করলেই নয়।
এছাড়াও, দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু বস্তুও প্লাস্টিকের তৈরি, যেমন- কনডম এবং ডায়াফ্রাম (জন্মনিরোধক) এর নাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত আবশ্যক চিকিৎসা উপকরণের মধ্যেই রয়েছে। এমনকি সার্জিক্যাল মাস্ক এবং রেসপিরেটরও প্লাস্টিকভিত্তিক। তাই এগুলো সরিয়ে নেওয়া মানে মানুষকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া।
প্লাস্টিক বাদ দিলে আমাদের খাদ্য ব্যবস্থায়ও আসবে বড় রকম পরিবর্তন। খাদ্যদ্রব্য আনা-নেওয়ার সময় যাতে নষ্ট না হয়, বেশি সময় সংরক্ষণ করার এবং পণ্যের প্রচারণা ও যোগাযোগের জন্যও প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়।
অন্যদিকে, প্লাস্টিক বাদ দিলে ভোক্তাদেরকে তাদের পুরো অভ্যাসের ধারাই বদলে ফেলতে হবে। বর্তমানে সুপারমার্কেটে প্যাকেটজাত খাবার রাখা হয় সবচেয়ে বেশি, সেখানকার সরবরাহ শৃঙ্খলও সেভাবেই তৈরি। প্লাস্টিক উঠে গেলে তাদেরকে এগুলো সরিয়ে ফেলে ভিন্ন চিন্তা করতে হবে। অ্যাসপারাগাস, সবুজ শুঁটি-মটরদানা ও বেরির মতো খাবার, যেগুলো ক্ষেত থেকে বহুদূরের পথ পেরিয়ে সুপারমার্কেটে জায়গা করে নেয়- সেগুলো দেখা যাবে ক্ষেতের মধ্যেই অযত্নে পড়ে আছে। টিনজাত খাদ্যের মধ্যে টমেটো ও শুঁটিজাতীয় সবজিও বাতিল হয়ে যেতে পারে। কারণ এগুলো সংরক্ষণ করতে টিনের ভেতরে প্লাস্টিকের প্রলেপ দেওয়া হয়।
শাকসবজি-ফল যদি একবারে প্রচুর পরিমাণে রাখা না যায়, তাহলে হয়তো আমাদের প্রায়ই বাজার করতে যেতে হবে। যুক্তরাজ্যের বর্জ্য অপসারণ সংস্থা র্যাপ ( WRAP) তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে যে, প্লাস্টিক প্যাকেটের কারণে ফ্রিজে রাখা ব্রকোলির শেলফ লাইফ (মেয়াদ) এক সপ্তাহ এবং ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কলার শেলফ লাইফ ১.৮ দিন বেড়ে যায়। কিন্তু মানুষ যদি যতখানি প্রয়োজন, শুধু ততখানি শাকসবজি-ফল কেনে, তাহলেও খাদ্য অপচয় কমানো সম্ভব বলে গবেষণায় দাবি করা হয়েছে।
প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ হলে পরিবেশের উপরেও এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব পড়বে। প্লাস্টিকের তুলনায় কাঁচের উপযোগিতা কিছুটা বেশি, যেমন-এটা সহজে পুনর্ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কাঁচ অবশ্যই প্লাস্টিকের চেয়ে ভারী; এক লিটারের একটি কাঁচের বোতলের ওজন হতে পারে ৮০০ গ্রাম, অন্যদিকে এক লিটারের প্লাস্টিক বোতলের ওজন মাত্র ৪০ গ্রাম। ফলে পরিবেশের উপর কাঁচ ব্যবহারের প্রভাব পড়বে। দুধ, জুসসহ নানা কোমল পানীয় তখন ভারি ভারি কাঁচের বোতলে নিয়ে ঘুরতে হবে, দূর-দূরান্তে নিয়ে যেতে হবে। ফলে কার্বন নিঃসরণ আরো বাড়বে। আর গাড়িগুলোতে প্লাস্টিকের বদলে অন্যকিছু বহন করা মানে গাড়িও ভারি হবে, এবং আরো বেশি কার্বন নিঃসরণ হবে।
তবে অন্যান্য দিক বিবেচনায় খাদ্যের প্যাকেজিং বা মোড়ক পরিবর্তন করা সবচেয়ে সহজ হবে। কিন্তু, আপনি কাঁচের বোতলে এক বোতল দুধ কিনলেও, দেখা যাবে ডেইরি শিল্পে গরু থেকে বোতলে দুধ ভরতে কোনো না কোনো জায়গায় প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছে। আবার কৃষিকাজে আগাছা সরিয়ে রাখতে বা পানি জমাতে প্লাস্টিক শিট ব্যবহার করেছে কৃষক। তাই সব মিলিয়ে প্লাস্টিক ছাড়া শিল্প কৃষি অসম্ভব।
কিন্তু এর বদলে আমাদের প্রয়োজন আরও সংক্ষিপ্ত ফুড চেইন। কৃষিপণ্যের দোকান এবং গোষ্ঠীভিত্তিক কৃষি প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু বিশ্বের অর্ধেক মানুষই এখন শহরে বসবাস করে, সেক্ষেত্রে আমরা কোথায়-কিভাবে খাদ্য উৎপাদন করবো, সেই প্রক্রিয়ায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এর জন্য শুধু যে সময়ই বেশি দিতে হবে তা নয়, সেই সাথে খাদ্যদ্রব্য ভোগের পরিমাণও কমিয়ে আনতে হবে।
এবার পোশাকের দিকে আসা যাক। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত টেক্সটাইল ফেব্রিকের ৬২ শতাংশই ছিল সিনথেটিক, অর্থত পেট্রোকেমিক্যাল থেকে তৈরি। তুলা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক তন্তু অবশ্যই এখানে ভালো বিকল্প হিসেবে কাজ করবে; কিন্তু বিশ্বব্যাপী মানুষের প্রচুর চাহিদার যোগান দিতে গেলে খরচ বেড়ে যাবে প্রচুর। এই মুহূর্তে বিশ্বের ২.৫ শতাংশ আবাদযোগ্য জমিতে তুলা উৎপাদিত হয়, কিন্তু ১৬ শতাংশ কীটনাশক ব্যবহারের পেছনে ফসল উৎপাদন দায়ী। এই কীটনাশকের ফলে আবার কৃষকদের স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং পানি দূষিত হয়। তাই প্লাস্টিক বাদ দিতে গেলে, আমাদেরকে ফাস্ট ফ্যাশনের ট্রেন্ডকে বাদ দিতে হবে এবং টেকসই জামাকাপড় পুনঃপুনঃ ব্যবহার করতে হবে।
প্লাস্টিক বাদ দিলে আমাদের জুতার স্টকও যাবে ফুরিয়ে। সিনথেটিক প্লাস্টিক আসার আগে মানুষ শুধু চামড়ার তৈরি জুতা পরতো। কিন্তু এখন বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ শুধু চামড়ার জুতা দিয়ে সম্ভব না।
প্লাস্টিকবিহীন পৃথিবীর ইতিবাচক দিক
তবে প্লাস্টিককে আমাদের জীবন থেকে একেবারে সরিয়ে দিলে এর ইতিবাচক দিকও রয়েছে অনেক। এর মাধ্যমে আমাদের স্বাস্থ্যের উপর প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।
তেল ও গ্যাসকে প্লাস্টিকে রূপান্তর করলে তা থেকে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয় যা বায়ু দূষণ করে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া, প্লাস্টিক উৎপাদনের সময় যেসব রাসায়নিক যোগ করা হয়, তা এনড্রোসিন সিস্টেমকে (এক ধরনের হরমোন তৈরি করে যা আমাদের দেহের বৃদ্ধি ও বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে) বাধাগ্রস্ত করে। এরকম দুটি বহুল পরিচিত রাসায়নিক হলো ফ্যাথালেটস (প্লাস্টিক নরম করতে ব্যবহৃত হয় এবং বিভিন্ন প্রসাধনীতেও পাওয়া যায়) এবং বিসফেনল বা বিপিএ (প্লাস্টিক শক্ত করতে এবং টিনের লাইনিংয়ে ব্যবহৃত হয়)। এসব রাসায়নিক উপাদান যখন খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত হয়, তা খাদ্যের সংস্পর্শে আসতে এবং অবশেষে আমাদের দেহে প্রবেশ করে।
এমনকি কিছু ফ্যাথালেটস টেস্টোস্টেরন উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে এবং এর ফলে পুরুষদের স্পার্ম কাউন্ট কমে গিয়ে অনুর্বরতা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, বিসফেনল দেহে প্রবেশ করলে নারীদের প্রজনন ক্ষমতা ব্যহত হতে পারে। কিন্তু প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব শুধু মানুষের প্রজননের সাথেই জড়িত নয়। ইমিউনোলজিক্যাল, স্নায়বিক, বিপাকীয় ও হৃদযন্ত্র থেকে শুরু করে মানুষের জৈবিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব থাকতে পারে।
ভ্রুণের বিকাশের মতো জটিল সময়ে এনড্রোসিন সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটায় এমন রাসায়নিকের (ইডিসি) সংস্পর্শে এলে তার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব শরীরে থেকে যায়। কোনো মা যদি গর্ভবতী অবস্থায় প্লাস্টিক বা অন্যান্য রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসেন যা ভ্রুণের বিকাশের ধারা বদলে দিতে পারে, সেটি পরে আর পরিবর্তন সম্ভব হবে না বলে জানান নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাইয়ের আইকান স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক শানা সোয়ান। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিকের ফলে শরীরে সংঘটিতে সেই ক্ষতির প্রভাব পরবর্তী দুই প্রজন্মের মধ্যেও রয়ে যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তবে সমুদ্রে ইতোমধ্যেই যেসব প্লাস্টিক জমা হয়েছে তা নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। আমরা কি কোনোদিন এগুলো সব পরিষ্কার করতে পারব? টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজি অ্যান্ড এভল্যুশনারি বায়োলজির অধ্যাপক চেলসি রচম্যান বলেন, "সমুদ্রে প্রচুর প্লাস্টিক জমা হয়েছে এবং এগুলো যেকোনো জায়গায় ভেসে যেতে পারে। এগুলো এখন আমাদের বাস্তুতন্ত্রের অংশ হয়ে গেছে।" কিন্তু ভাসমান প্লাস্টিক থেকেই আমাদের সামনে নতুন সুযোগ আসতে পারে।
গবেষকদের মতে, প্লাস্টিকগুলো ভাসতে ভাসতে একসময় তীরে এসে মাটির নিচে জমা হবে। পুরনো নিয়মে সমুদ্রসৈকত পরিষ্কার করতে গিয়ে এগুলো তুলে ফেলা যাবে। আর বড় বড় প্লাস্টিক সরিয়ে ফেললে সেগুলো থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক আসার সম্ভাবনাও থাকবে না। সমুদ্রসৈকত থেকে পাওয়া বেশিরভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিকই নব্বই দশক বা তার আগের। এ থেকে বোঝা যায়, বড় প্লাস্টিকগুলো ভাঙতে কয়েক দশক লেগে যায়।
উদ্ভিদ থেকে প্লাস্টিক?
কিন্তু কৃত্রিম প্লাস্টিকবিহীন পৃথিবীতে আমাদের হয়তো উদ্ভিদ থেকে প্লাস্টিক তৈরির প্রয়োজন পড়বে। জৈব-ভিত্তিক প্লাস্টিকের মধ্যে পেট্রোকেমিক্যাল প্লাস্টিকের বেশকিছু গুণাগুণ আছে। উদাহরণস্বরূপ, কর্ন স্টার্চ-ভিত্তিক পলিল্যাক্টিক এসিড যা স্ট্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো দেখতে কৃত্রিম প্লাস্টিকের মতোই। উদ্ভিদের ভক্ষণযোগ্য অংশ, যেমন- চিনি বা ভুট্টা থেকে বায়ো-বেজড বা জৈব-ভিত্তিক প্লাস্টিক তৈরি করা যেতে পারে। অথবা, গাছের যেসব অংশ খাওয়ার উপযুক্ত নয়, যেমন- আখের রস নিংড়ানোর পর সেই ফেলনা পাল্প দিয়ে প্লাস্টিক বানানো যেতে পারে।
কিন্তু সকল জৈবভিত্তিক প্লাস্টিকও বায়ো ডিগ্রেডেবল বা কমপোস্টেবল, অর্থাৎ মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো না। এগুলোকেও শিল্পকারখানায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপযুক্ত করে তুলতে হবে যেন তা পরিবেশে থেকে না যায়। জৈব প্লাস্টিক বলেই যে সমুদ্রে ফেলে দিলাম আর পরিবেশের উন্নতির চিন্তা করলাম, তা হবে না।
তবে জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক প্লাস্টিকের বদলে জৈব-ভিত্তিক প্লাস্টিক ব্যবহার করলে প্রতি বছর ৩০০ থেকে ১৬৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রয়োজন হতে পারে, যা বৈশ্বিক ওয়াটার ফুটপ্রিন্টের ৩ থেকে ১৮ শতাংশ। খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত জমি তখন প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে পারে, ফলে খাদ্য ঘাটতিও দেখা দিবে।
তাই গতানুগতিক প্লাস্টিক ও জৈব-ভিত্তিক প্লাস্টিকের মধ্যে পার্থক্য বের করে যেকোনো একটাকে বেছে নেওয়া বেশ কঠিন। তবে গবেষকরা বলছেন, সাধারণ প্লাস্টিকের ক্ষতির তুলনায় জৈব-ভিত্তিক প্লাস্টিক ব্যবহার একটি ভালো বিষয়। এছাড়া, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহকে ডিকার্বোনাইজ করতে শুরু করায় জৈব-ভিত্তিক প্লাস্টিক উৎপাদনের ফলে নির্গত কার্বনের পরিমাণ দিন দিন কমে আসবে।"
তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকলেও, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সাধারণ প্লাস্টিকে ব্যবহৃত সংযোজনগুলো জৈব-ভিত্তিক প্লাস্টিকেও ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে সেগুলো খাবারে মিশে গেলে সেই একই ক্ষতি হতে পারে। তাই এটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, একটি সরিয়ে অন্য প্লাস্টিক নিয়ে এলেই আমাদের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে না।
তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোন কোন প্লাস্টিক সত্যিই প্রয়োজনীয়, কোনগুলো ক্ষতিকর, তা বের করতে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বেশকিছু দেশ। এ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে কোন প্লাস্টিকগুলো ব্যবহার করব আর কোনগুলো নিষিদ্ধ হবে।
প্লাস্টিক ছাড়া, আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ভাবার ধরনও পরিবর্তন করতে হতে পারে। এমন একটি বিশ্ব সম্পর্কে ভাবতেই হবে- যেখানে প্যাকেজিংকে পুনরায় ব্যবহার করা হয় বা একেবারে ফেলে দেওয়া হয় না। এভাবে আমরা 'ভোক্তা'র পরিবর্তে দায়িত্বশীল বিশ্ব-নাগরিক হয়ে উঠতে পারি।
সম্ভবত আমরা এও আবিষ্কার করব যে, প্লাস্টিক আমাদের যেসব উপকার করেছে জন্য, তার সবগুলোই ইতিবাচক ছিল না। প্লাস্টিকের প্যাকেজিং এর ফলে যদি হুটহাট খাবার কিনে নিয়ে চলার পথেই খেতে পারি, তাহলে প্লাস্টিক ব্যতীত অন্য পদার্থ ব্যবহার করলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন হয়তো একটু ধীরগতিতেই যাবে। আর সেটা হয়তো তেমন একটা খারাপ ব্যাপারও হবে না।
- সূত্র: বিবিসি