মুসলিমরা কেন স্কটল্যান্ডের এই কবর দেখতে যান?
স্কটল্যান্ডের ডানমুরের একজন ভূস্বামী বা আর্ল ছিলেন চার্লস অ্যাডলফাঁস মুররে। তারই কন্যা- লেডি ইভলিন কোববল্ড। একে অভিজাত বংশীয় তার ওপর ভিক্টোরিয় যুগের মানুষ। তবু ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন ইসলামে। ধারণা করা হয়- তিনিই হলেন ব্রিটিশ বংশদ্ভূত প্রথম ইসলামে ধর্মান্তরিত নারী- যিনি মক্কায় গিয়ে হজ পালন করেন। আর ঠিক একারণেই মৃত্যুর বহু বছর পরও তিনি এক কিংবদন্তী এবং ইউরোপের অন্য ধর্মান্তরিত মুসলমানদের কাছে প্রেরণার উৎস হিসেবে রয়ে গেছেন।
সুদূর স্কটল্যান্ডে গিয়ে তার সমাধি বা কবর জিয়ারত ইউরোপের নও-মুসলিমদের কাছে আজ গুরুত্বপূর্ণ তীর্থে পরিণত হয়েছে।
এমনই একটি দল যাত্রা করছিল হাইল্যান্ড-খ্যাত স্কটল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। মধ্য সকালের সেই সময়ে মহাসড়কের পাশের একটি বন-বিভাগের কারপার্কে দেখা যাচ্ছিল গাড়ির সাড়ি। গাড়িতে যাত্রা এপর্যন্তই, তারপর বাকি রাস্তা চলবে সবাই পায়ে হেঁটে।
স্কটল্যান্ডের আবহাওয়া বৈরী, বৃষ্টি বা কুয়াশার উৎপাত যখন-তখন ভিজিয়ে দেয়, উচ্চভূমির বাতাস তখন হিমঠাণ্ডার কাঁপন ধরায় শরীরে। ২০ জনের তীর্থযাত্রীদের দলটি তবু উজ্জীবিত, পাহাড়ি পথে আরও ১০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ওয়েস্টার রস এলাকার গ্লেন ফিহঢেইগে পৌঁছানোর জন্য হাঁটতে শুরু করেন সবাই।
এই দলটির সদস্যরা এসেছেন যুক্তরাজ্যের নানান স্থান যেমন- এডিনবরো, লিভারপুল ও লিচেস্টার থেকে। কেউ কেউ আরও দূর থেকে। গন্তব্য লেডি ইভলিন কোববল্ড- এর সমাধি।
আধ্যাত্মিক এ যাত্রার আয়োজক যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা- দ্য কনভার্ট মুসলিম ফাউন্ডেশন। সংস্থাটি নও-মুসলিমদের ইসলাম সম্পর্কে জানার-শেখার নেটওয়ার্ক সহায়তা দেয়।
এর প্রতিষ্ঠাতা বাতুল আল- তমা আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনিও ধর্মান্তরিত। এই নারী-ই পাহাড়ি পথে দলটির পথ-প্রদর্শক।
আল-তমা বলেন, "লেডি ইভলিনের কথা জানার পর থেকেই আমি তার কাহিনিতে আকৃষ্ট হতে থাকি। তিনি ছিলেন অদম্য- নারী হয়েছেন বলে কেউ তার ইচ্ছেকে অবজ্ঞা করবে- তা তিনি মেনে নেননি।"
বিবিসি প্রতিবেদক অরিন কক্সকে যখন তিনি এসব কথা বলছিলেন, তখনই শুরু হলো বৃষ্টি। তখন বাধ্য হয়েই দলের বাকি সবাই মাথার টুপি ও হিজাবের ওপর চড়ালো ওয়াটারপ্রুফ হুড।
বৃষ্টির তীব্রতার সাথে হানা দিল প্রবল বাতাসের উৎপাত। তবে দলের কেউ উৎসাহ হারাননি। তারা আরও উচ্চ স্থানে লেডি ইভলিনের সমাধিতে যাওয়ার কথাই ভাবছিলেন। নিজের এ সমাধিস্থান ইভলিন নিজেই নির্ধারণ করে যান জীবদ্দশায়।
১৯৬৩ সালের এক শীতের সকালেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ইভলিন। এরপর তাকে গ্লেনক্যারন এস্টেটের এক নির্জন পাহাড়ের ঢালে কবর দেওয়া হয়।
ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান, তাই ব্যাগপাইপ বাজিয়েছিলেন একজন বাদক। এরপর ইসলামি রীতিতে তাকে কবর দেন সারের ওকিং অঞ্চলের এক ইমাম। ইভারনেস মসজিদের ওয়েবসাইট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
ওকিং অঞ্চলের সাথে মৃত্যুর প্রায় ৬০ বছর পরও মুছে যায়নি ইভলিনের যোগসুত্র। তীর্থযাত্রীদের এই দলেও ছিলেন ওকিং শহরের মসজিদের এক প্রতিনিধি।
লেডি ইভলিন ধর্মান্তরিত হওয়ার পর জয়নব নাম নেন। তাকে জয়নব কোববল্ডই বলেন মুসলমানরা।
১৮০০ শতকের শেষদিকে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন স্কটল্যান্ডে, আর উত্তর আফ্রিকায়।
উত্তর আফ্রিকায় থাকার সময়েই তিনি প্রথম ইসলামের সংস্পর্শে আসেন। আলজেরিয় বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন মসজিদে যেতেন।
এ সময় সম্পর্কে তিনি লিখে গেছেন, "অবচেতনভাবেই আমি কিছুটা মুসলমান হয়ে উঠেছিলাম।"
তিনি ঠিক কবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন- সে সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে একটি ঘটনার কথা জানা যায়, যখন তিনি রোমে পোপের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
সেই স্মৃতিচারণ করে ইভলিন ওরফে জয়নাব লিখেছেন, "মহামান্য পোপ যখন আমি ক্যাথলিক কিনা জানতে চাইলেন, আমি কিছুটা সময় নিলাম। তারপর উত্তর দিলাম- আমি মুসলিম।"
"জানি না তখন আমায় কী ভর করেছিল- কারণ তার আগে বহু বছর আমি ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে ভাবিনি।"
এ ঘটনার পরই আরবি জয়নাব নামগ্রহণ করেন ইভলিন। এবং ৬৫ বছর বয়সে মক্কা গিয়ে হজ পালন করেন।
তার কবর জিয়ারতে যারা এসেছিলেন- তাদের একজন হলেন ইয়োভন রিডলি। তিনি থাকেন স্কটল্যান্ডের সীমান্ত এলাকায়।
রিডলি একজন নারী সাংবাদিক ছিলেন আফগানিস্তান যুদ্ধের সময়। ২০০১ সালে তিনি তালেবানের হাতে বন্দী হন। সেখানেই তিনি ধর্মান্তরিত হন।
তিনি বলেন, "তালেবানের হাতে আটক হওয়ার সাথেই আমার ধর্মান্তরের সম্পর্ক বেশি। এ অভিজ্ঞতাই আমাকে ইসলাম সম্পর্কে পড়ার যাত্রা থেকে আধ্যাত্নিক পথে নিয়ে যায়।"
'ইন দ্য হ্যান্ডস অব দ্য তালেবান' বই লিখেছেন রিডলি। সেখানে তিনি জানান, নারী হিসেবে তার প্রতি তালেবান যে সম্মান ও সৌজন্য দেখিয়েছে- তাতে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। বন্দী থাকার কালে তিনি অঙ্গীকার করেন, মুক্তি পেলে তিনি কোরআন পড়বেন। এরপর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তুরস্কে থাকার সময় আল-তমার কাছ থেকে লেডি ইভলিন ওরফে জয়নাবের সম্পর্কে প্রথম শোনেন রিডলি।
তিনি বলেন, "এরপর আমি অসাধারণ এ স্কটিশ নারী সম্পর্কে আরও পড়তে শুরু করি। তাই তার কবর জিয়ারতের সিদ্ধান্ত নেই।"
এসব কথা বলতে বলতে কেটে যায় তিন ঘণ্টা। পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে উঠতে পরিশ্রান্ত তীর্থযাত্রীরা কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে থাকেন। তাদের একজন স্কটিশ গাইড আরও কিছুটা এগিয়ে যান তখন লেডি ইভলিনের কবরের খোঁজে।
খুঁজে পেয়ে দূর থেকে পিছু ফিরে দলের বাকিদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ান। সঙ্গে সঙ্গেই সবার মধ্যে নতুন উৎসাহ দেখা দেয়। বাস খানিকটা পাহাড় বেয়ে উঠলেই- ওই যে দেখা যায়- ইভলিনের অতি-সাধারণ অন্তিম শয্যা।
দলের সবাই সেদিকে এগোলেন এবার। কাছে গিয়ে কবর ফলকের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন সবাই।
শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পর সবাই মিলে দোয়া শুরু করলেন। আবেগঘন এই মুহূর্তে দলের অনেকের চোখেই পানি চলে আসছিল।
লেডি ইভলিন মক্কা যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে তার বইয়ে যা লিখেছিলেন, সেই লাইন পড়ে প্রার্থণার ইতি টানেন আল-তমা। ইভলিন লিখেছেন, "অতীত কী আমার থেকে অন্তঃহীন আগ্রহ, বিস্ময় আর সৌন্দর্য আড়াল করে রেখেছিল? আজ মনে হচ্ছে, সত্যই আমার সামনে নতুন এক জগত হাজির হয়েছে।"
পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে আসার সময় ইভারনেসের মসজিদে আমন্ত্রিত হন দলের সবাই। সেখানে তাদের খাদ্য পরিবেশন করা হয়। আর এই যাত্রার উপলদ্ধি সম্পর্কেও তারা আলোচনার সুযোগ পেয়ে যান।
রিডলি বলেন, হাঁটতে হাঁটতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু, ইভলিনের কবরের পাশে প্রার্থণা তাকে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি এনে দিয়েছে।
"তার কবর থেকে খানিকটা উঁচুতে পাহাড়ের গায়ে একটি বড় শিঙ্গেল হরিণ দেখি। এই প্রতীকী দৃশ্য আমাকে খুবই আলোড়িত করে। ইভলিন ছিলেন এমন নারী- যার হ্রদয় ছিল এই স্কটিশ হাইল্যান্ডের, কিন্তু একইসাথে ইসলামের প্রতি নিবেদিত।"
আল-তমা তার সাথে একমত পোষণ করে বলেন, নও-মুসলিমদের জন্য ইভলিন একজন অনুকরণীয় আদর্শ। কারণ তিনি নিজের ধর্মীয় পরিচয় ও সংস্কৃতি- দুইই ধরে রাখার শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
"ইভলিন এখানে উপস্থিত সব ধর্মান্তরিতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তার লেখা বইটি পড়া ও এখানে আসার সুযোগ পেয়েছি- এতে আমি খুবই আনন্দিত। আমি তার সাহস ও অভিযাত্রী হৃদয়ের গুণমুগ্ধ। তিনি একজন দীপশিখা আর পথপ্রদর্শক।"
- সূত্র: বিবিসি