চালচিত্র: কফি, ডেজার্ট, সিনেমা, গল্প আর আড্ডার কফিশপ
ঢাকা শহরে একটু আয়েশ করে হাঁটার বিশেষ উপায় নেই। যানজট, ভাঙাচোরা, পূতিগন্ধময় ফুটপাতে বাইকারদের অবিরাম বিড়ম্বনা; খানাখন্দ; কান আর বুক দুটোকেই ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল করে দেওয়া অযাচিত হর্ন- রাজধানীর বেশিরভাগ জায়গাতেই একজন পথচারীর অভিজ্ঞতাটা এরকম।
ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কেউ যদি চান কোথাও বসে একটু জিরিয়ে নেবেন, তাতেও অনেক হ্যাপা। নির্ভার হয়ে কোনো স্থানে একটু জিরোনোর অবকাশ নেই। রেস্তোরাঁ-ক্যাফেগুলোতেও খাওয়ার পর আর বসে থাকা 'শোভন' দেখায় না। তার ওপর ভিড়ভাট্টা আর হই-হট্টগোলের কথা বলা বাহুল্য।
কিন্তু কেমন হয় যদি আপনি কোনো একটা কফিশপে যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকতে পারবেন, নিজের কাজ করতে পারবেন, পড়ালেখা করতে পারবেন? কেউ আপনাকে উঠে যাওয়ার কটাক্ষ করবে না, চাইলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা স্বাদের কফিতে চুমুক দিতে পারবেন। থাকবে গান শোনা, দাবা-লুডু খেলার ব্যবস্থা। ঘাড় ঘুরালেই দেখা মিলবে সিনেমার পোস্টার, থিম। ঢাকার কফিপ্রেমীদের এমন সুযোগই করে দিয়েছে চালচিত্র কফিশপ।
লালবাগ কেল্লার ঠিক একটু আগেই তিন নাম্বার ঢাকেশ্বরী রোডে একটি ভবনের দোতলায় অবস্থিত ছোট্ট, ছিমছাম, ভিন্ন আমেজের এ কফিশপটি। রাস্তা থেকেই দেখা যায় নাম লেখা সবুজ গোলাকার সাইন। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে হাতের ডান দিকের দরজা খুললেই কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যেতে পারবেন বাইরের জগতের যাবতীয় ঝঞ্ঝাট থেকে।
গত ১৮ জুন থেকে যাত্রা শুরু করেছে চালচিত্র কফিশপ। এ উদ্যোগের পেছনে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দুইজন শিক্ষার্থী নোশিন আঞ্জুম প্রবাহ ও মোঃ রিয়াদ হোসেন। নোশিন ঢাবি থেকে অর্থনীতিতে আর রিয়াদ কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে স্নাতক শেষ করেছেন। তাদের সাথে আলাপ হলো চালচিত্রে বসে; জানা গেল তাদের উদ্যোগের গল্প, চালচিত্রের হাল-হকিকত, আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা।
চালচিত্রের সামনে যখন পৌঁছাই, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কফিশপের জন্য ব্যস্ত একটা বেলা এটা, ভেতরে ঢুকেই তা টের পাওয়া গেল। সামনেই কাউন্টারের ওপরে পাঁচটা ফ্লুরোসেন্টে লাইটের আলোয় পুরো কক্ষের ভেতরে আবছায়া একটা আবহ ফুটে উঠেছে। তবে পরিবেশটা আলোর মতো নরম নয়, কারণ ডানপাশের লম্বা টেবিল জুড়ে ইতোমধ্যে একদল তরুণ-তরুণী জমিয়ে আড্ডা জুড়ে দিয়েছেন। তাদের হাসির লহরি, কাপ-প্লেট-চামচের ঠুংঠাং আওয়াজের মধ্যে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করে যখন একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা, তখন সহাস্যবদনে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন চালচিত্রের কারিগরদের একজন।
শুরুর গল্প
একটু ফুরসত পেয়ে আমরা একটা টেবিল জুড়ে বসলাম, আড্ডা শুরু হলো। নোশিন আর রিয়াদ একটা কফিশপের উদ্যোগের পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তবে শুরু থেকেই তাদের মাথায় 'চালচিত্র' ঘুরছিল না। অনেক পরিকল্পনা, আয়োজন শেষ করে আজকের চালচিত্রে পৌঁছাতে মাস নয়েকের মতো সময় লেগে গিয়েছে সবমিলিয়ে।
চালচিত্র নামটা নান্দনিক, বেশ বাঙালি-বাঙালি ভাব আছে। এটা কি মৃণালের সিনেমা থেকে নেওয়া নাম কিনা জিজ্ঞেস করলাম। রিয়াদ জানালেন, সরাসরি চালচিত্র থেকে তারা নামটা নেননি। 'তবে এখন অব্দি অনেকের কাছেই এ প্রশ্নটা শুনতে হয়েছে আমাদেরকে,' হেসে বললেন নোশিন।
'গৎবাঁধা একটা প্রশ্ন করতেই হচ্ছে আপনাদেরকে। আপনারা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে কফিশপের উদ্যোগ নিলেন। নিশ্চয়ই অনেকের কাছেই এর ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে?' প্রশ্নটা করলাম দুজনকেই। 'হ্যাঁ, খুবই সাধারণ একটা প্রশ্ন। প্রথমত হচ্ছে আমাদের পড়ার বিষয়ের সঙ্গে কফিশপের ধারণাটা একদমই মানানসই হয় না। দ্বিতীয়ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমরা, এত কষ্ট করে এখানে পড়ার সুযোগ পেয়ে এখন ব্যবসায় কেন নেমেছি; এ ধরনের প্রশ্ন তো আছেই,' উত্তর দিলেন নোশিন।
দুজনের পরিচয় কীভাবে হলো? কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল আর অর্থনীতি বিভাগের মধ্যে দূরত্বটা কুড়ি টাকার রিকশা ভাড়ার। প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারলাম বড্ড বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলেছি। নোশিন একমুখ হাসি নিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন, 'টিএসসি'। সত্যিই তো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু তৈরি করার জন্য টিএসসির চেয়ে ভালো জায়গা আর কোনোটা আছে?
প্রমোশনেই বাজিমাত
নোশিন ও রিয়াদ চালচিত্রের প্রমোশন শুরু করেন ফেইসবুকের মাধ্যমে। তখন থেকেই বন্ধু ও পরিচিত মহলে এ কফিশপটি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। তাদের বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সৃজনশীলতার ছোঁয়া থাকায় তা মানুষের কাছে প্রশংসা পায়। ফেইসবুকে চালচিত্রের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পোস্টের মন্তব্যের ঘরে মূর্ছনা দেবনাথ নামক একজন লিখেন, 'আপনাদের প্রতিটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এত সুন্দর! আশা করি এ সুন্দরটা বজায় থাকবে সবসময়। আর কফি খাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।'
তবে চালচিত্র আর সবার থেকে নিজেদের ভিন্নতার ইঙ্গিত দেয় নারী কর্মীদের জন্য পিরিয়ডকালীন ছুটির ব্যবস্থার মাধ্যমে। এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নারী কর্মীদের মাসে দুই দিন সবেতন পিরিয়ডকালীন ছুটি দেওয়ার ঘোষণা দেয় কফিশপটি। এরপর মন্তব্যের ঘরে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দেন ব্যবহারকারীরা।
গ্রাফিক ডিজাইনার পদে নিয়োগের জন্য চালচিত্র ছড়ার মাধ্যমে সিভি আহ্বান করে। তবে নিজেদের প্রমোশনে চালচিত্র সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছে প্রমোশনাল ভিডিও বানিয়ে। এক মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের ওই ছোট্ট সিনেম্যাটিক ট্রেইলারটি পরিচালনা করেছেন সাইদি হাসান রাব্বি।
ওই প্রমোশনাল ফিল্মে যারা কাজ করেছেন, তারা সবাই নোশিন-রিয়াদের বন্ধুবান্ধব। সবাই স্বতস্ফূর্তভাবে কাজ করেছেন এটি তৈরির জন্য। এ ফিল্মের ডিরেক্টর, ক্রু, শিল্পীদের পুরো কৃতিত্ব দিলেন তারা দুজন।
চালচিত্রকথা
কফিশপটির পরিসর কিছুটা ছোট, তবে ভবিষ্যতে বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন এ তরুণ উদ্যোক্তারা। শাখা খোলারও ইচ্ছে আছে তাদের। 'আমরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পাশে আমাদের কফিশপ চালু করতে চাই,' বলেন রিয়াদ। 'গুলশান-বনানী এলাকায় এখন অনেক কফিশপ রয়েছে। সেখানে কফির একটা ভালো বাজার রয়েছে। কিন্তু আমরা চাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক জায়গাগুলোতে বা যেখানে কফির বিশেষ চাহিদা নেই, সেসব জায়গায় কফির একটি বাজার গড়ে তুলতে,' ব্যাখ্যা করেন নোশিন।
কেবল ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, কফিকে এ দুজন উপস্থাপন করতে চান নান্দনিকভাবে, সংস্কৃতির একটি উপাদান হিসেবে। বাংলাদেশে নিজস্ব কোনো 'কফি কালচার' নেই। কফিকে এখনো এখানে বনেদি পানীয় হিসেবে দেখা হয়। নোশিন ও রিয়াদের উদ্দেশ্য সিনেমা-গানের সহযোগে চালাচিত্রের নিজস্ব একটি কফি-কালচার তৈরি করা।
বাংলায় চা এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে নিজের আসন ধরে রেখেছে। হাঁটাপথে চাইলেই যেমন হকারের কাছ থেকে কাগজের কাপে এক চা খাওয়া যায়, তেমনি বনেদিপাড়ায় বা ব্যবসায়িক জগতেও চায়ের প্রতি কারও কোনো 'বিতৃষ্ণা' নেই। সেদিক থেকে বলতে গেলে কফিটা বোধহয় আমাদের এখানে এখনো অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
নোশিন জানান, 'ইউরোপে অনেক ছোট-ছোট কফিশপ আছে যেগুলো নিজেদের জায়গা থেকে স্বতন্ত্র। ওগুলোর সঙ্গে স্টারবাকস বা ক্রিমসন কাপের অনেক তফাত। আমরাও এরকম একটা কফিশপ হয়ে উঠতে চাই যাদের নিজস্বতা আছে।'
নোশিন আর রিয়াদই চালচিত্রের স্বত্বাধিকারী। এর বাইরে তাসনিম জুবায়ের নামে আরেকজন নীরব অংশীদার, এবং কয়েকজন অস্থায়ী বিনিয়োগকারী আছেন তাদের সঙ্গে। আপাতত সাত জন কর্মী কাজ করছেন চালচিত্রে।
যেহেতু শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে চালচিত্রের জন্ম, তাই এখানকার কফি ও খাবারের দামটা ঠিক করার সময় তাদের পকেটের কথাও বিবেচনায় রাখা হয়েছে কিনা এমন ইঙ্গিত করতে নোশিন জানান, 'এ মুহূর্তে আমরা সবার জন্য একটা যৌক্তিক দাম রাখছি। এরপর ধীরে ধীরে দাম আরও কমিয়ে সবার নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করব। প্রথম থেকেই যদি আমরা সবার কথা ভেবে খাবারের মূল্য নির্ধারণ করি, তাহলে আমাদের ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে কষ্ট হবে। তবে অন্য কফিশপগুলোর তুলনায় আমাদের এখানে কফি ও খাবারের দাম বেশ যৌক্তিক।'
চালচিত্রের একজন কর্মী শাহরিয়ার সিফাতের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি এখানে শপ হাউজকিপারের দায়িত্ব পালন করেন, বারিস্তার কাজে সাহায্য করেন, কিচেন সামলান। তার কাছে জানতে চাইলাম ভিন্নধর্মী এ কফিশপে কাজ করে কেমন লাগছে। 'এটা আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল যেখানে কাজ করে আমি বেশ আনন্দ পাচ্ছি। আমার সিনেমা দেখার শখ আছে, সেদিক থেকেও এ কফিশপ পছন্দের সাথে মিলে গেছে। আর আপু-ভাইয়া দুজনই ভীষণ আন্তরিক।'
কফি আর সিনেমা
চালচিত্রে ঢোকার পরে পেছনে দেয়ালে একটি চমক অপেক্ষা করবে অতিথির জন্য। সাদা ওই দেয়ালজুড়ে আঁকা হয়েছে বিভিন্ন সিনেমার কিছু পরিচিত দৃশ্য, সংলাপ সম্বলিত একটি ফ্রেস্কো। কফি খেয়ে ওই দেয়ালকে পেছনে রেখে ছবি তোলেন না এমন অভ্যাগতের সংখ্যা খুবই কম। চালচিত্র কফিশপের একটি প্রধান থিম হলো সিনেমা।
'আমি যখন সিনেমা দেখি, তখন কিছু দৃশ্য নাড়িয়ে দেওয়ার মতো হয়। এরকম কিছু শক্তিশালী দৃশ্য নিয়ে আমার একটা কম্পাইলেশন করার ইচ্ছা ছিল। বৈশ্বিক সিনেমাকে আনার চেষ্টা করেছি এখানে', বলেন রিয়াদ। সাদা-কালোর আঁচড়ে দেয়ালটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশি, ভারতীয়, হলিউডি, থাই, ইরানিয়ান, কোরিয়ান, ফ্রেঞ্চ, ব্রাজিলিয়ান ইত্যাদি সিনেমার বিভিন্ন সংলাপ ও দৃশ্য। এ দেয়ালচিত্রের সবগুলো সিনেমার নাম এখনো কেউ বলতে পারেনি।
চলচ্চিত্র নিয়ে চালচিত্রের বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। দেয়ালের সিনেম্যাটিক-চালচিত্রের বাইরেও সপ্তাহে একদিন রূপালি পর্দায় সিনেমার আবহ পাবেন ভোক্তারা। 'আমাদের প্রথম পরিকল্পনা হচ্ছে পাবলিক ডোমেইনে যেসব সিনেমা আছে সেগুলো আড্ডার ছলে উপভোগ করা। আর দ্বিতীয় ধাপের পরিকল্পনা হলো, চালচিত্র হবে উদীয়মান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সিনেমা মুক্তি দেওয়ার প্রথম প্রেক্ষাগৃহ। যেসব ফিল্মমেকার কোথাও সিনেমা মুক্তি দেওয়ার সুযোগ পান না, আমরা তাদের সিনেমাগুলো আমাদের এখানে মুক্তি দিতে চাই,' নোশিন জানান।
এর জন্য দর্শকদের যৎসামান্য ফি দিতে হবে বলে জানান রিয়াদ। এটা কেবল নির্মাতাদের সিনেমা মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ ফি'র পুরোটাই ওই ফিল্মমেকারকে দেওয়া হবে বলে নিশ্চিত করেন তারা। প্রাথমিকভাবে ঈদের পরে সিনেমা দেখানোর শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে চালচিত্রের। আমরা যেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, ঠিক মাথার ওপরেই একটা প্রজেক্টর সিলিং মাউন্ট ঝুলতে দেখা গেল।
গল্প হবে নির্দ্বিধায়
চালচিত্রের স্লোগান 'নির্দ্বিধায় গল্প হোক'। এখানে যে কেউ এসে দীর্ঘসময় ধরে আড্ডা দিতে পারবেন, পড়তে পারবেন অনায়াসে। অথবা চাইলে নিজের যেকোনো ছোটখাটো কাজও এ কফিশপে বসে সারা যাবে। তার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নেই। আমাদের আড্ডার মাঝেই একজনকে দেখা গেল কফি আর ল্যাপটপ নিয়ে একটা টেবিলে কাজে বসে যেতে। 'যদি কেউ বসে কাজ করার কারণে নতুন আসা কোনো কাস্টমার জায়গা না পান, তাহলে কী হবে?'
'এ ব্যাপারটা আমরা কাস্টমারদের ওপরেই ছেড়ে দিতে চাই৷ আমরা কখনোই কাউকে উঠে যেতে বলব না। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা, কাস্টমারদের নিজেদের মধ্যেই একধরনের বোঝাপড়া করে নেবেন এরকম পরিস্থিতিতে,' জানান রিয়াদ।
নোশিন বলেন, 'আমার কাছে মনে হয় প্রথম দিকে মানুষের এটা বুঝতে কিছুটা সমস্যা হবে। কিন্তু প্রচার বাড়লে এ সমস্যা আর থাকবে না। আর আমাদের কিছু বাড়তি টুলের ব্যবস্থা রয়েছে।' তবে এ সেবাটি থেকে চালচিত্র যে ভ্যালুটা পাবে, সেটাকে টাকার মূল্য দিয়ে বিচার করা যাবে না বলেই অভিমত নোশিনের।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চললো। কফিশপে অতিথিদের আনাগোনায় কোনো কমতি দেখা যাচ্ছে না। এদের বেশিরভাগই নোশিন ও রিয়াদের পরিচিতমুখ, বন্ধুবান্ধব। প্রতিটি টেবিলে আড্ডা জমে উঠেছে। কেউ কফি, কেউ হালকা খাবার নিয়ে বসে পড়েছেন। দুজনকে দেখা গেল দাবার বোর্ড নিয়ে খেলায় ডুবে যেতে। চালচিত্রে দাবা আর লুডোর মতো ইনডোর গেইমেরও ব্যবস্থা আছে। সামনে আরও নতুন কিছু ইনডোর গেইমের আয়োজন করা হবে বলেও জানান রিয়াদ।
চারদিকে এত হট্টগোল আর আড্ডার আমেজে বই পড়া কতটা সম্ভব, জানতে চাই তাদের কাছে। 'এখন তো রাশ আওয়ার। সকালের দিকে আবার ফাঁকা ছিল। সামনে বড় জায়গা হলে পড়াশোনার জন্য আলাদা কর্নার রাখার পরিকল্পনা রয়েছে,' বলেন রিয়াদ। 'একটা কফিশপে তো সবসময় লাইব্রেরির আমেজ পাওয়া যাবে না, এটাও স্মরণে রাখতে হবে,' যোগ করেন নোশিন।
আড্ডার মধ্যেই ফাঁক পেয়ে অন্য টেবিলে গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করে আসছেন নোশিন আর রিয়াদ। কয়েকবার কাউন্টার থেকেও ঢু মেরে আসতে হলো তাদেরকে। কর্মীসংখ্যা সামনে আরও বাড়ানো হবে, তবে আপাতত অনেক কিছুই নিজেদের হাতে ধরে সামলাতে হচ্ছে দুজনকে। এরকম একটু ফাঁক পেয়ে আমিও উঠে গিয়ে কথা বলে এলাম এক অতিথির সঙ্গে। ঢাবির এ শিক্ষার্থীর নাম আরিয়ান। তিনিও কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র। তার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলাম। 'আমি কফিপ্রেমী। সাধারণত প্রচুর কফি খাওয়া হয়। আজকেই এখানে প্রথম এসেছি। বেশ লাগছে। কফি অর্ডার করেছি। নিজের বিভাগের বড় ভাইয়ের ক্যাফে বলে বলছিনা, এটা আমার খাওয়া অন্যতম সেরা কফি,' বলেন আরিয়ান।
পিরিয়ডকালীন ছুটি
চালচিত্রে পিরিয়ডকালীন ছুটির ব্যবস্থা থাকলেও এখনো এটি এখনো কার্যকর করা যায়নি। কারণ এখনো কোনো নারীকর্মী নেওয়া হয়নি ক্যাফেটিতে। তবে অনেক নারীকর্মীর সিভি পেয়েছেন দুই উদ্যোক্তা। নারীকর্মী না থাকার কারণটাও ব্যাখ্যা করলেন দুজনে, 'আমাদের এখন খুব বেশি কর্মী নেই। তাই কাজের সময়টা অনেক নারী কর্মীর জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে সিভি পাঠানোর বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। আমাদের কাজের সময়ে দেখা গেল তাদের ক্লাস থাকছে বা রাত ১১টা বাজলে তাদের হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।'
নোশিন বলেন, 'আমাদের এখানে অর্ডার নেওয়া বন্ধ হয় দশটায়। সব শেষ করে বের হতে হতে এগারটা বেজে যায়। যারা এখানে কাজ করার জন্য আবেদন করেছেন, তাদের বেশিরভাগ হলে থাকেন, বা অনেক দূরে বাসা। আর যারা কাছাকাছি থাকেন, তারা আবার মেসে থাকেন। তাদের পক্ষে এগারটা পর্যন্ত থাকা সম্ভব হবে না।'
পরিবেশবান্ধব কফিশপের পরিকল্পনা
রিয়াদের কাছ থেকে জানা গেল, তারা চাইছেন চালচিত্রকে যতটা সম্ভব পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে। এর জন্য কিছু ছোটখাটো পদক্ষেপও নিয়েছেন তারা। এই যেমন কফিশপটিতে প্লাস্টিকের স্ট্র রাখা হয়নি। তার বদলে কাগজের আর গ্লাসের স্ট্র'র ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে নোশিন জানালেন অনেকগুলো সীমাবদ্ধতার কথা। পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলায় প্রচুর খরচের কথা উল্লেখ করেন তিনি। আর এর জন্য যেসব পরিবর্তন আনতে হয়, তা-তে মানুষ এখনো অভ্যস্ত না বলেও জানান তিনি, 'পেপার স্ট্র পরিবেশবান্ধব হলেও এটি প্লাস্টিকে মোড়ানো থাকে। মানুষকে পেপার স্ট্র দেওয়া হলে তারা অনেক সময় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান।'
ওয়ার্ক এথিক্সে অগ্রাধিকার
'অনেক জায়গায় দেখা যায় যে ওভারটাইম করায়, কিন্তু কর্মীদের তার জন্য টাকা দেওয়া হয় না। সপ্তাহে কত ঘণ্টা কাজ করা হবে তার কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই। আমরা এগুলো মেনে চলছি আমাদের কফিশপে, যার কারণে আমাদের এখন কিছুটা বাড়তি খরচ হচ্ছে। চালচিত্রে আমরা ওয়ার্ক-এথিক্স সমুন্নত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমরা এরকম একটা সংস্কৃতি তৈরি করতে চাই যেটা অন্যরাও অনুসরণ করবে,' বলেন রিয়াদ।
কর্মীদের কর্মঘণ্টা, বেতন, ছুটি, ও অন্যান্য সবধরনের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে চালচিত্র বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃতি নীতিমালা মেনে চলছে বলে জানিয়েছেন দুই উদ্যোক্তা।
সামনে আরও অনেক পরিকল্পনা আছে এ দুজনের। সিনেমা, গান, দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে তাদের। 'আমরা এখন যা যা ভাবছি তার বেশিরভাগই এলোমেলো আইডিয়া মাত্র। এগুলো নিয়ে পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে আমাদেরকে। তাই এখন যদি সবকিছু বলতে যাই, তাহলে মনে হবে একটু বাড়িয়ে বলছি,' সলাজ হেসে বললেন নোশিন।