অসময়েও মেঘনায় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ
দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল এলাকা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর ও মেঘনাসহ কয়েকটি নদীতে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। শীত মৌসুমে হঠাৎ এত ইলিশ ধরা পড়ায় জেলেরাও অবাক। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকায় দামও কম। দক্ষিণাঞ্চলের বৃহৎ তিনটি ইলিশ মোকামে চলছে বেচাকেনার ধুম। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, মন্ত্রণালয়ের গৃহীত একাধিক উদ্যোগের কারণে গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। তবে বাজারে খুচরা ক্রেতার থেকে পাইকারদের সংখ্যাই বেশি।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৭-৮ দিন ধরে উপকূল এলাকা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। অনেক ইলিশের ওজন প্রায় এক কেজি। এই শীত মৌসুমে মেঘনায় এত ইলিশ ধরা পড়ার নজির নেই।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ধরা বন্ধ থাকায় সাগর ও নদীতে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। ফলে শীত মৌসুমেও জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে।
বরিশালে ইলিশের সবচেয়ে বড় মোকাম নগরীর পোর্ট রোড। বুধবার (২২ জানুয়ারি) সকালে ওই এলাকার মোকামে গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর ইলিশ আমদানি হয়েছে। ক্রেতাদের ভিড়ে মুখরিত পুরো এলাকা। কীর্তনখোলা নদী থেকে খাল দিয়ে একের পর এক ইলিশ বোঝাই নৌকা, ট্রলার, স্পিডবোট ঘাটে এসে ভিড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে সেসব নৌকা ঘিরে ধরছেন পোর্ট রোড ইলিশ মোকামের আড়ৎদাররা। আড়তদাররা সেই ইলিশ কিনে স্তুুপ করে রেখেছেন আড়তের সামনেই।
মৎস্য বিভাগের বরিশাল জেলা কার্যালয়ের ইলিশ বিষয়ক কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র দাস জানান, বরিশাল পোর্ট রোড মোকামে আমদানি হওয়া বেশীরভাগ ইলিশ মেঘনা নদীর। বরিশাল ও ভোলা জেলা সংলগ্ন মেঘনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। এছাড়া উপকূল এলাকা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরেও কম-বেশি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় ইলিশের দাম পাইকারি ও খুচরা বাজারে কমেছে।
ভোলার দৌলতখান উপজেলার জেলে মো. জসিম ও মনির মিয়া জানান, গত কয়েক বছর শীতের এসময় নদীতে তেমন একটা ইলিশ পাওয়া যেত না। তবে গত ৭-৮ দিন ধরে জালে প্রচুর ইলিশ উঠছে। সুতার বড় ফাঁকার জাল (ডুবা ও ভাসান ছান্দিজাল) ব্যবহার করেই ইলিশ শিকার করা যাচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পর জাল তুলে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মাছ পাচ্ছেন তারা।
বরিশাল পোর্টরোড আড়ৎদার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অজিত কুমার দাস মনু জানান, মোকামে ইলিশের সরবারহ বেড়েছে। গত ৫-৭ বছরে শীতের এ সময় প্রতিদিন গড়ে ৬০ মনের মত ইলিশ আমদানি হতো। সেখানে গত এক সপ্তাহে ইলিশ আমদানি প্রত্যাশার চেয়ে বেড়েছে। মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) ৩৫০ মণ আমদানি হয়েছে। পরদিন দুপুর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে প্রায় ২৫০ মন ইলিশ।
অজিত কুমার দাস মনু জানান, বর্ষার মতো শীতে ইলিশের বেশি চাহিদা থাকে না। তাই চাহিদার তুলনায় ইলিশ আমদানি বেশি হওয়ায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে দাম কমেছে।
ইলিশের দামের বিষয়ে অজিত কুমার দাস মনু জানান, বুধবার এক কেজি সাইজের ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছে ৩২ হাজার টাকায়। সে হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়েছে ৮০০ টাকা। রপ্তানিযোগ্য এলসি আকারের (৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম) প্রতি মণ ২৬ হাজার টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজি ইলিশের পাইকারী দাম পড়ে ৬৫০ টাকা। হাফ কেজি বা ভেলকা আকারের (৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম) দাম ২০ হাজার টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজি ইলিশের পাইকারি দাম পড়ে ৫০০ টাকা। গোটরা আকারের (২৫০ গ্রাম থেকে ৩৫০ গ্রাম) প্রতি মণ ১২ হাজার টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজি ইলিশের পাইকারি দাম পড়ে ৩০০ টাকা।
বরিশালের মতো বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বাজারগুলো ইলিশের ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে এখন সরগরম।
দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ইলিশের মোকাম বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রেও গত এক সপ্তাহে ইলিশের আমদানি বেড়েছে। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের সহকারী বিপনন কর্মকর্তা আহমদুল্লাহ জানান, শীতের এ সময় বিগত বছরগুলোতে ইলিশ অনেক কম আসতো। এবার ইলিশ আমদানি বেড়েছে। গত ১০-১২ দিন ধরে গড়ে প্রতিদিন ২০০ মণ ইলিশ আমদানি হচ্ছে।
অন্যদিকে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলিপুর-মহিপুর বেসরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রেও ইলিশ সরবরাহ বেড়েছে। কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনোজ কুমার জানান, সাগরের চেয়ে নদীতেই ইলিশ বেশী ধরা পড়ছে। আলিপুর-মহিপুর বেসরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে সাগরের মাছই বেশি আমদানি হয়। এরপর গত কয়েকদিনে ইলিশের আমদানি বেড়েছে। এখানে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ মণ ইলিশ আমদানি হচ্ছে।
মৎস্য অধিদফতর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আজিজুল হক জানান, মন্ত্রণালয়ের গৃহীত একাধিক উদ্যোগের কারণে গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। মা-ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম ও জাটকা রক্ষা কার্যক্রম বিভিন্ন বাহিনীর সহায়তায় কঠোরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। জেলেদের মধ্যেও সচেতনতা বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞার মধ্যে মাছ শিকারি জেলেদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। ফলে শীতের এ মৌসুমেও বড় বা মাঝারি আকারের ইলিশ ধরা পড়ছে। কার্যক্রমগুলো এভাবে চললে সামনে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়বে।
(https://tbsnews.net/bangladesh/abundant-catch-hilsa-season-38955)