আম্পানে ভেসে গেছে উপকূলের ঈদ, এখন বেঁচে থাকার লড়াই
একদিকে করোনার মহামারি, অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে গোটা সাতক্ষীরা। আম্পানে উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। উপকূলে তাই এবার ভেসে গেছে ঈদের আনন্দ। এখন চলছে শুধু কোনো রকমে বেঁচে থাকার লড়াই।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কপোতাক্ষ তীরবর্তী উপকূলীয় প্রতাপনগর ইউনিয়ন। নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত গোটা ইউনিয়নবাসী। ইউনিয়নের সুভদ্রাকাটি বেড়িবাঁধের উপর কোনো রকমে তাঁবু বানিয়ে, বেঁচে থাকার চেষ্টা দুই শতাধিক মানুষের।
সুভদ্রাকাটি গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী মনজুয়ারা বেগম। স্বামী জুলফিকার আলী দীর্ঘদিন নিখোঁজ। ছোটকুড়ে ঘরটি ঝড়ে উড়ে গেছে। বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়ে গেছে গোটা গ্রাম। এখন রয়েছেন বেড়িবাঁধের উপর।
মনজুয়ারা বেগম জানান, স্বামী নিখোঁজ অনেকগুলো বছর। ঝড়ে কুড়ে ঘরটিও ভেঙে গেছে। থাকার জায়গা নেই। বাঁধের উপর তাবু দিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। এখনও কোন চেয়ারম্যান, মেম্বার আমাদের খোঁজ নেয়নি। কোন সহায়তাও পাইনি। কিভাবে বেঁচে আছি তা কেউ এসে চোখের দেখাও দেখলো না।
সুভদ্রাকাটি গ্রামের খোকন সরদার। তিনিও একই বাঁধের উপর তাঁবু বানিয়ে দিয়ে থাকছেন। চোঁখেমুখে অসহায়ত্ব।
খোকন সরদার বলেন, পাশে কপোতাক্ষ তীরের চাকলা এলাকায় বাঁধ ভেঙে গোটা এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আমার ঘরটি ভেঙেছে ঝড়ে। নতুনভাবে মেরামত করবো সে উপায়ও নেই। বাড়ির মধ্যে কোমরের উপরে পানি। বাঁধের উপর খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। কারো সহযোগিতাও এখনো পেলাম না।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইতিহাস প্রভাষক মো.ইদ্রিস আলী। তিনি প্রতাপনগর ইউনিয়নের সুভদ্রাকাটি গ্রামের বাসিন্দা।
এলাকার মানুষের দুঃখ দূর্দশা নিয়ে তিনি জানান, প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে এই অঞ্চলের মানুষের বেড়ে উঠা। অনেকবার এমন অবস্থার সম্মূখীন হয়েছে তারা। ২০০৯ সালে আইলার সেই ক্ষতি কাটিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে শুরু করেছিল উপকূলীয় এসব এলাকার মানুষ। কেবল আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। এরই মধ্যে আম্পান আঘাত হেনে সবকিছু তছনছ করে দিল। নতুনভাবে ১০ বছর পিছিয়ে দিল এলাকার মানুষকে ।
প্রভাষক মো.ইদ্রিস আলী আরও বলেন, নদী ভাঙন উপকূলীয় মানুষের কাছ নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও আইলা, সিডরসহ বিভিন্ন সময় একাধিকবার ভেঙেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যখন চরম বিপর্যয় দেখা দেয় তখন হেলিকপ্টার বা ট্রলারযোগে এসে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষরা একটু চোখের দেখা দেখে যায়। এরপর আর কেউ খোঁজ নেয় না। টেকসই বাঁধগুলো নির্মাণেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
বর্তমানে সুভদ্রাকাটি বাঁধের উপরে দুই শতাধিক মানুষ আশ্রিত রয়েছে। এখনো কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি। কোন সরকারি খাদ্য সামগ্রীও সেখানে পৌঁছেনি। তবে আমি বিভিন্নভাবে টাকা জোগাড় করে ৬৫০ পরিবারকে খাদ্য সমাগ্রী দিয়েছি।
প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, ইউনিয়নের ১৮টি গ্রামই প্লাবিত। পানিবন্দি হয়ে আছ ৩৬ হাজার মানুষ। ইউনিয়নের উপকূলীয় বাঁধের আটটি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে গেছে। এখনও মেরামত করা সম্ভব হয়নি। তবে গ্রামবাসী স্বউদ্যোগে মেরামত করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
তিনি বলেন, ইউনিয়নের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ কাচা ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। ঝড়ের পর এখন পর্যন্ত ৭ টন (সাত হাজার কেজি) চাল বরাদ্দ পেয়েছি। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব নগণ্য। যেটুকু সরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেছে, সেটুকুই গ্রামবাসীর মাঝে বন্টন করা হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো এখনো পায়নি। প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ খুব সামান্য। আগামীকাল (সোমবার) ঈদ অথচ কারো মনে কোনো আনন্দ নেই। আম্ফানে ভেসে গেছে ঈদের আনন্দ। এখন শুধু বেঁচে থাকার লড়াই।
আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা বলেন, উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা ও আশাশুনি সদর ইউনিয়নের ৪২টি গ্রামের ১১ হাজার পরিবারের ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। উপকূলের ২৬টি পয়েন্টে উপকূলীয় বাঁধে ভেঙে গেছে। এখনো এসবের সংস্কার কাজ শুরু হয়নি। নদীতে জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে এলাকায়ও পানি বাড়ছে।
তিনি জানান, আম্ফান পরবর্তী সময়ে দূর্গত মানুষদের সহযোগিতার জন্য ৩০ মেট্রিকটন চাল, শুকনা খাবার ৩৫০ প্যাকেট, নগদ তিন লাখ ২০ হাজার, শিশু খাদ্য ৩০ হাজার টাকার ও গুড়া দুধ ৫০০ প্যাকেট বরাদ্দ এসেছে। সেগুলো আমরা বিতরণ করে দিয়েছি ইতোমধ্যে। এছাড়া ঈদ উপলক্ষ্যে জেলা প্রশাসক মহোদয় আশাশুনি সদর ও শ্রীউলা এলাকার পানিবন্দি মানুষের জন্য মাথাপিছু এক কেজি গরু বা মুরগির মাংস, পোলাও চাল, সেমাইসহ আনুসঙ্গিক মালপত্র দিয়েছেন। সেগুলো আজ রাতেই আমরা পৌঁছে দিব। এছাড়া বাকিদের জন্য ইতোমধ্যে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে।