ইভ্যালির বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের প্রমাণ পেল মন্ত্রণালয়
আলোচিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রচলিত বিভিন্ন আইন ভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি তদন্ত টিম অনুসন্ধান করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অন্তত ৮ ধরনের প্রতারণা ও অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। দেশে প্রচলিত আইনে এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
ওই তদন্তের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন গত ১২ জানুয়ারি বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দিনের কাছে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে করা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুরোধের প্রেক্ষিতে ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পুলিশ সদর দপ্তরকে দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে ইভ্যালিকে প্রচলিত আইন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নীতিমালা মেলে ব্যবসা করতে নির্দেশনা দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পণ্য অর্ডার করার ক্ষেত্রে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের বদলে ইভ্যালিকে 'ক্যাশ অন ডেলিভারি' পদ্ধতি প্রবর্তনে বাধ্য করতে নির্দেশনা দেওয়ার জন্যও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে। এতে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী- উভয় পক্ষের অসন্তোষ দূর হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ছয়-সাত মাস আগে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পর এখনো পণ্য কিংবা অর্থ ফেরত না পাওয়া ক্রেতাদের সাক্ষাৎকার এবং দেশে প্রচলিত এ সম্পর্কিত আইন পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে পণ্য বা রিফান্ড না পাওয়া, গিফট কার্ড পেয়েও তা ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়ার যেসব অভিযোগ ক্রেতারা করেছেন, সেগুলো পুলিশের সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম শাখার মাধ্যমে তদন্ত করে দেখারও পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
ইভ্যালি কত অর্ডার গ্রহণ করেছে এবং তার বিপরীতে কী পরিমাণ ডেলিভারি দিয়েছে, প্রতি মাসে তার রিপোর্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে জমা পাঠাতে ইভ্যালিকে নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশও রয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. শামীম হাসান স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনটিতে ইভ্যালির বিরুদ্ধে আট ধরনের অনিয়ম পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব অপরাধের দায়ে বিদ্যমান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর বিভিন্ন ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ইভ্যালির এসব অপরাধের দায় কোম্পানির মালিকের ওপর বর্তায়।
তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্ডার করা পণ্য নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি না দেওয়া, গ্রাহকদের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ না রাখা, পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে অগ্রিম নেওয়া টাকা ফেরত না দেওয়া, ক্যাশব্যাক হিসেবে টাকা না দিয়ে ই-ব্যালেন্স দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ক্যাশব্যাক অফারের মাধ্যমে পাওয়া অর্থ নগদ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ফেরত না দিয়ে ই-ওয়ালেটে যোগ করা এবং ই-ব্যালেন্স থেকে পণ্য কেনার সময় ১০০% ব্যবহার করতে না দেওয়ার অভিযোগেরও প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এছাড়াও ইভ্যালিতে অর্ডার করা পণ্যের বিপরীতে অনেক সময় অন্য পণ্য, কমমূল্যের পণ্য ও মানহীন পণ্যও সরবরাহ করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
৬ মাসেও পণ্য বা অর্থের রিফান্ড- কোনোটিই পাচ্ছেন না গ্রাহকরা
ইভ্যালিতে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পরেও নির্ধারিত সময়ে পণ্য কিংবা অর্থ রিফান্ড না পাওয়ায় বিভিন্ন ক্রেতা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেও অভিযোগ করেছেন। সেখান থেকে অভিযোগকারীদের নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর নিয়ে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কর্মকর্তারা।
তাতে ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত সময়ে অর্ডার করা ১৫ জন ক্রেতা ২০২০ সালের অক্টোবরে এসেও পণ্য কিংবা অর্থ রিফান্ড না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। অথচ সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে এসব পণ্য ক্রেতাদের কাছে ডেলিভারি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
রামপুরা মহানগর প্রজেক্টের বাসিন্দা মো. সাইফুল্লাহ ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৪৫ টাকার বিনিময়ে একটি স্কুটি অর্ডার দেওয়ার ১১৬ দিন পরও পণ্যটি পাননি।
সুনামগঞ্জের বিলপাড় এলাকার মো. জিল্লুর রহমান গত জুলাই মাসে রেফ্রিজারেটর অর্ডার দিয়ে ৫৯ হাজার ৩৪০ টাকা জমা দিয়েছিলেন। পণ্যটি সরবরাহ না করে পরে অফারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি টাকা কিংবা রেফ্রিজারেটর- কোনোটিই পাননি।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার সোনাপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ ফেরদৌস ফকির জানিয়েছেন, গত বছর ৬ জুন একটি ল্যাপটপের অর্ডার দেন তিনি। সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তিনি ল্যাপটপ বা টাকা কোনোটিই পাননি।
রাজধানীর পূর্ব বাসাবোর আনিসুর রহমান গত ১৬ জুন একটি জিইসি ফ্যান, তিনটি মোবাইল ফোন, একটি ওয়েট স্কেল, একটি ওভেন, একটি ব্যাগ অর্ডার করে ৮৪ হাজার ২৭৮ টাকা পরিশোধ করেন। তিনি কোনো পণ্য হাতে পাননি।
অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পর দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও পণ্য বা পণ্যমূল্য- কোনোটিই ফেরত না পাওয়ার এ রকম আরও অনেক ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
গিফট কার্ড অফারের নামে অনিয়ম
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইভ্যালির বিভিন্ন অফারের মধ্যে গিফটকার্ড অন্যতম লোভনীয় একটি অফার। যেমন- কোনো ক্রেতা নগদ ৬৫০০ টাকা পরিশোধ করে গিফটকার্ড ক্রয় করলে তার ইভ্যালি অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকার ব্যালেন্স জমা হয়। ওই ব্যালেন্স নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবহার করে কোনো পণ্য ক্রয় না করলে তা বাতিল হয়ে যায়।
রাজশাহীর শাহ মুখদুম থানার আমচত্বর গ্রামের মো. রোকনুজ্জামান পুলিশের তদন্ত টিমকে জানান, তিনি ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে ইভ্যালি থেকে দুটি গিফটকার্ড কেনেন। কার্ডগুলো ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত তিনি কোনো পণ্য কিনতে পারেননি।
এসব কার্ডের ৬০ শতাংশের বেশি আর ব্যবহার করতে পারবেন না তিনি। আবার গিফট কার্ডের মেয়াদও শেষের দিকে। এ নিয়ে ইভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর পাননি রোকনুজ্জামান।
প্রচলিত আইনেও অপরাধ করছে ইভ্যালি
ই-কমার্স পরিচালনা বিষয়ক পৃথক কোনো আইন দেশে প্রচলিত না থাকলেও বিদ্যমান দণ্ডবিধি ১৮৬০ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আইন ২০০৯ অনুযায়ী অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পর সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করা 'অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ' ও 'প্রতারণা'।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দণ্ডবিধি ১৮৬০ অনুযায়ী অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে তিন বছর ও প্রতারণার দায়ে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির দেওয়া মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করলে অনুর্ধ্ব এক বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইভ্যালি তার গ্রাহকদের সঙ্গে হটলাইন নাম্বার, সাপোর্ট ইমেইল, ইভ্যালি অ্যাপ্লিকেশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথাযথভাবে যোগাযোগ করে না। এ ধরনের ঘটনা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আইনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেবা প্রদানকারীর অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতায় সেবাগ্রহীতার অর্থ বা স্বাস্থ্যহানী ঘটানো হলে অনুর্ধ্ব তিন বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এছাড়া, দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪১৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অপরাধকারী যে ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণ করতে বাধ্য, অসঙ্গতভাবে সে ব্যক্তির ক্ষতি বা লোকসান হবে জেনেও প্রতারণা করলে তিন বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদে কারাদণ্ড হতে পারে।
ক্যাশব্যাক অফারের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ ই-ব্যালেন্স থেকে পণ্য ক্রয়ের সময় ১০০% ব্যবহার করতে না দেওয়াকে 'প্রতারণা' হিসেবে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রতারণার মতো অসাধুতার জন্য সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডাদেশ হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক পণ্যের কথা বলে অন্য পণ্য সরবরাহ করলেও দণ্ডবিধি ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কারাদণ্ডাদেশের বিধান রয়েছে।
গ্রাহক ৩৭ লাখ, মাসিক লেনদেন ৩০০ কোটি টাকা
২০১৮ সালের ১৪ মে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নিয়ে একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর ইভ্যালি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। মাত্র ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই কোম্পানির বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি টাকা।
ইভ্যালির নিবন্ধিত গ্রাহক এখন ৩৭ লাখেরও বেশি এবং মাসিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
শুরুর দিকে ইভ্যালি ভাউচার নামক একটি পদ্ধতি চালু করে। এ পদ্ধতির আওতায় বিভিন্ন পণ্যে ২০০-৩০০% পর্যন্ত ক্যাশব্যাক করা হতো। বর্তমানে ১০০-১৫০% পর্যন্ত ক্যাশব্যাক সুবিধা দেওয়া হয়। মোবাইল ফোনসেট, মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিক্রেতাদের প্রায় চার হাজার ধরনের নিজেদের প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করে কমিশন পাচ্ছে ইভ্যালি।
ইভ্যালির পেমেন্ট পদ্ধতি দেশের অন্যসব ওয়েবসাইটভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। এখান থেকে ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতিতে পণ্য কেনার সুযোগ নেই। পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়।
ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মো. রাসেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে বিএসসি (অনার্স) পাশ করেন। পরে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে ঢাকা ব্যাংকে প্রায় দুই বছর চাকরি করার পর ই-ভ্যালি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তিনি।