এইডস রোগীদের একাকী জীবন
রাজধানীতে সিএনজি অটোরিক্সা চালাতেন বিক্রমপুরের মোহাম্মদ জামাল (৪৪)।
চানখাঁরপুলে স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে শিরায় ইঞ্জেকশন দিয়ে মাদক নিতেন তিনি। বছর দেড়েক মাদক নেয়ার পর ২০১৪ সালে অসুস্থ্ হয়ে পড়েন হঠাত। রক্ত পরীক্ষায় এইডস শধরা পড়ে জামালের।
এইডস আক্রান্তের খবর শুনে স্ত্রী-সন্তান তাকে ছেড়ে গেছে। ভাই-বোনেরাও ত্যাগ করেছে। প্রতিবেশিরাও তাকে বাড়িতে থাকতে দেয় না। সেই থেকে রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালেই তার বসবাস। পাঁচ বছর ধরে সেখানেই আছেন তিনি। হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে দিলেও দুই একদিন পর আবার ফিরে আসেন হাসপাতালে। চিকিৎসক, নার্স-আয়ার সেবা ও সাহচর্যে হাসপাতালেই একাকী জীবন যাপন করছেন মোহাম্মদ জামাল।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ফাতেমা বেগম (৩৭), সৌদি প্রবাসী স্বামীর কাছ থেকে এইচআইভি সংক্রমণ ঘটেছে তার। দুই বছর হল স্বামী মারা গেছে তার। স্বামীর মৃত্যুর পর তার এইডস শনাক্ত হয়। এরপর শ্বশুর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ফাতেমাকে। ভাইয়েরাও তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। অসুস্থ্তার জন্য প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। সে সময় মাঝে মাঝে পাশে পান মাকে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার দুই সন্তানের পড়াশুনা।
জামাল আর ফাতেমা বেগমের মতই একাকী জীবন কাটছে দেশের অধিকাংশ এইডস রোগীর। সমাজ এখনো স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি এইডস রোগীদের। এইডস শনাক্ত হওয়ার পরই থেমে যাচ্ছে তাদের স্বাভাবিক জীবন। কিছু এনজিও এইডস রোগীদের স্বাভাবিক জীবনের প্রচেষ্টায় কাজ করে তবে সে সংখ্যা খুবই নগণ্য।
চিকিৎসকরা বলছেন, এইডস আক্রান্ত হলেই মৃত্যু এমন ধারণার পরিবর্তন করতে হবে। যথাযথ চিকিৎসায় এইডস নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সহায়ক পরিবেশ ও সুযোগ পেলে এইডস রোগীরাও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। এমনকি তারা বিয়ে করতে পারে এবং নন ইনফেকটেক সন্তান জন্ম দিতে পারে।"
ডা নজরুল ইসলাম বলেন, "এইডস রোগীদের শুধু ওষুধ আর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেই হবে না। তাদের একাকীত্বের খোঁজ নিতে হবে। তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা, ক্লাব গঠন, খেলাধুলা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের একার পক্ষে তা সম্ভব নয়, এক্ষেত্রে এনজিওরা এগিয়ে আসতে পারে এইডস রোগীদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল এইডস-এসটিডি প্রোগ্রামের (এনএএসপি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালে দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয়। ২০১৮ সালে দেশে নতুন করে এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮৭৯ জন। ১৯৮৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬ হাজার ৪৫৫ জনকে এইডস আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭২ জন।
ধারণা করা হয়, দেশে এইডস রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজারের মতো। প্রায় ৫ হাজার ৫৫ রোগী এখনো শাণাক্তের বাইরে।
দেশে একজন এইডস আক্রান্ত রোগীর পেছনে সরকারের মাসে খরচ ৬ থেকে ১৪ হাজার টাকা।
এইডস বিস্তারে মাদকসেবী ও প্রবাসী
শিরায় মাদক গ্রহণকারী ও প্রবাসীদের কারণে এইডসের বিস্তার কমানো এখনো চ্যালেঞ্জ। এইডস আক্রান্তদের ৩১ শতাংশের বেশি বিদেশ ফেরত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২৩ জেলায় এইডস আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী চট্টগ্রাম ও সিলেটে। ইঞ্জেকশন দিয়ে মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। এদের ২২ শতাংশের শরীরে এইচআইভির জীবাণু আছে।
এছাড়া মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের এইডস নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তারাও ঝুঁকির কারণ হতে পারে বাংলাদেশের জন্য।
সাত মাসের ব্যবধানে নতুন করে এইচআইভি-এইডস আক্রান্ত হয়েছে ৪৬ জন রোহিঙ্গা। স্বাস্থ্য বিষয়ক জার্নাল ল্যানসেটের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৭৩ জন। এ বছরের মার্চে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৯ জনে। এরইমধ্যে মারা গেছেন ১৯ জন।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. সৈয়দ আহসান তৌহিদ বলেন, আমরা যত এইচআইভি পজিটিভ রোগী পাচ্ছি তার বড় অংশই বিদেশ ফেরত। তাদের মাধ্যমে আবার পরিবারের মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে রোগটি। অজ্ঞতা বা গোপন করার কারণে অনেকে পরিবারকেও সংক্রমিত করে ফেলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিবি-লেপ্রোসি ও এইডস-এসটিডির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, এইডস এর বিস্তারে রোধে সরকার কাজ করছে। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এইডসের চিকিৎসা পৌঁছে গেছে। গত এক বছরে ২৩টি জেলার ২৮টি হাসপাতালে ফ্রি এইচআইভি টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-র অধীনে ঢাকাসহ প্রতি জেলায় ৭০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এইচআইভি বিষয়ক কারিকুলাম তৈরি করে দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বিদেশে গিয়ে শ্রমিকেরা নিজেকে কিভাবে নিরাপদ রাখতে পারে সে বিষয়ে ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে এইডসের বিস্তার ভয়াবহ নয়
বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইডস রোগী পাওয়া যায়। এরপর এইডস রোগী প্রতি বছর বাড়লেও তা বৈশ্বিক হারের তুলনায় ভয়াবহ নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। এদেশের মোট জনসংখ্যার এইডস আক্রান্তের সংখ্যা .১ শতাংশেরও কম।
ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, "অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমনের হার অনেক কম। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে আমাদের দেশে এইডস রোগী কম। আর আমাদের প্রবাসীরা কাজের জন্য বিদেশে যায়, অজ্ঞতার কারণে এইডস আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে তারা অনুতপ্ত হয়। তাই তাদের থেকে অন্যের মাঝে ছড়ায় কম। শিরায় মাদক সেবনকারীরাই এখন প্রধান সমস্যা। তাদের নিডল শেয়ার করা থেকে বিরত রাখতে পারলে এইডেসের ঝুঁকি আরো কমবে।"