'এটা ছিল ভুল বোঝাবুঝি': সিকদার ভাইদের মামলায় পুলিশের প্রতিবেদন
একটি ভুল বোঝাবুঝির প্রেক্ষিতে অত্র মামলার উদ্ভব হয়, কিন্তু পরবর্তীতে বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং নিজেদের অত্র মামলার ঘটনার বিষয়ে একটি 'সমঝোতা চুক্তি' করেন। যাতে তারা উল্লেখ করেন যে, তারা তাদের পূর্বের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে পরস্পরের সাথে সম্মানের সহিত ব্যবসায়িক সর্ম্পক এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।
দায়েরকৃত মামলার ফলাফল মেনে নিয়ে এ বিষয়ে তারা পরবর্তীতে কোন আইনি পদক্ষেপ নিবে না বলে জানান। বর্তমানে উভয়পক্ষ পূর্বের ন্যায় তাদের একে অপরের সহযোগিতায় ইতিবাচক ব্যবসা ও ব্যাংকিং সম্পর্ক চালিয়ে আসছে।
সিকদার গ্রুপের দুই আলোচিত ভাই রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে করা হত্যাচেষ্টা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এমন কথাই উল্লেখ করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনাল টিম। উল্লেখ্য, আলোচিত মামলাটির তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন পরীমণি কাণ্ডে আলোচনায় আসা ও বদলি হওয়া অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন শিথিল।
রিপোর্টে শিথিল উল্লেখ করেন, "এজাহারে উল্লেখ করা আসামি রন হক সিকদার (৪৮) ও দিপু হক সিকদার (৫৩)- দুজনের বিরুদ্ধে পেনাল কোড আইনের হত্যাচেষ্টা অভিযোগসহ, ৩০৭, ৩৬৫ ও ৩৮৪ ধারায় আনা অভিযোগে অভিযুক্ত করার মত কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। এছাড়া ভুল বোঝাবুঝির কারণে অত্র মামলার উদ্ভব হয়েছে। বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে এবং তারা তাদের মধ্যে ইতিপূর্বে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে পরস্পরের সাথে সম্মানের সহিত ব্যবসায়িক সম্পর্কে এগিয়ে যেতে চায়। এবং দায়েকৃত মামলার ফলাফল মেনে নিয়েই এ বিষয়ে পরবর্তীতে কোন আইনি পদক্ষেপ নিবে না মর্মে সমঝোতা চুক্তি করেছেন।
আমি মামলার তদন্তের ফলাফল নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে তাদের মৌখিক মতামত গ্রহণ করে মামলাটি অহেতুক মুলতবি না রেখে দুইজন আসামিকে এই মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিতে আবেদনসহ এই মামলার বিজ্ঞ আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করছি। একই সাথে মামলাটি 'তথ্যগত ভুল' বলে প্রতীয়মান হওয়ায় আসামি রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার- দুইজনকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে অনুরোধ করছি।"
গত ২৭ জুলাই মামলার জব্দ করা আলামত বিলাসবহুল গাড়ি, পিস্তল ও গুলি আসামিদের কাছে ফেরত দিতে আদালতের কাছে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনাল টিমের উপ-পরিদর্শক মো. রিপন উদ্দিন।
মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা আরো জানান, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আসামি রন হক সিকদারের দেয়া তথ্যে বনানী থানা এলাকার ১১ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর সিকদার হাউসের আটতলায় রন হক সিকদারের বেডরুমে ওয়্যারড্রোবের ড্রয়ার থেকে একটি লাইসেন্স করা পিস্তল ও দুটি খালি ম্যাগাজিন ও ৭০ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। এরপর গত ০৭ মে ২০২০ তারিখে পিস্তলটি থেকে কোন ফায়ার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করতে বিশেষ পুলিশ সুপার, ফরেনসিক (সিআইডি) এর কাছে পাঠানো হয়। পিস্তলটির ব্যালাস্টিক পরীক্ষায়, একে একটি স্ট্যান্ডার্ড পিস্তল, ফায়ারআর্মস বলে উল্লেখ করা হয়। পরে চলতি বছরের ১৫ মার্চ এক প্রতিবেদনে সিআইডি জানায় রাসায়নিক পরীক্ষায় পিস্তলটির ব্যারেলে ফায়ার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। গত ৭ মে, ২০২০ তারিখে ফায়ার করা হয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, যা পর্যালোচনা করতে সিআইডির ব্যালাস্টিক ও রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে প্রেরণ করা হয়।
এছাড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পুলিশ জানায়, এজাহারভুক্ত জামিনে থাকা আসামি রন হক সিকদার ও ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের ব্যাবস্থাপনা পরিচালকসহ গত ৭ মে, ২০২০ তারিখে এক্সিম ব্যাংক গুলশান সিম্ফনি ভবনে গিয়ে ব্যাংকটির এএমডি ও এমডি মহোদয়কে উল্লেখিত ঠিকানা থেকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে থাকলে সে বিষয়ে এক্সিম ব্যাংকের সিসিটিভি ফুটেজ ও আসামি রন হক সিকদার এক্সিম ব্যাংক হতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া প্রস্তাব বিষয়ে কাগজপত্রের সত্যায়িত কপি প্রেরণের জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এক্সিম ব্যাংক বরাবর আলাদা আলাদা চিঠি পাঠানো হয়। চলতি বছরের ০৮ জুন দুটি চিঠিতে জবাব দিলেও ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার বিষয়ে এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোন কাগজপত্র প্রদান করতে পারে নাই।
এছাড়া ৭ মে, ২০২০ তারিখের সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ গত ১৪ জুন ২০২০ তারিখে সরবরাহ করা হয়, যাতে অভিযোগে উল্লেখ করা তারিখে আসামি রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদারের এক্সিম ব্যাংকের গুলশান সিম্ফনি ভবনে উপস্থিতি দেখা যায়নি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চলতি বছরের ২০ জুলাই এক্সিম ব্যাংকের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ মনিরুল ইসলামের স্বাক্ষর করা একটি চিঠিতে ৩০০ টাকা নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সমঝোতা চুক্তিতে বলা হয়, অত্র মামলার বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের সাক্ষীদের উপস্থিতিতে একটি সমঝোতা চুক্তি করেন এবং তারা জানান যে, ভুল বোঝাবুঝির কারণে বাদীপক্ষ বিবাদীদের বিরুদ্ধে অত্র মামলাটি দায়ের করেন।
যা আছে মামলার এজাহারে
ঋণের জন্য বন্ধকী সম্পত্তির মূল্য বেশি দেখাতে রাজি না হওয়ায় এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন সিকদার গ্রুপের দুই পরিচালক। শুধু তাই নয়, তারা পদস্থ দুই ব্যাংক কর্মকর্তাকে বনানীর একটি বাসায় জোর করে আটক রেখে নির্যাতন করেন এবং সাদা কাগজে সই নেন। গুলশান থানায় এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলায় এই অভিযোগ করা হয়েছে।
যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তারা হলেন সিকদার গ্রুপের মালিক জয়নুল হক সিকদারের ছেলে এবং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদার। মামলা দায়েরের পর থেকে দুই ভাই পলাতক ছিলেন। মাঝে সিকদার গ্রুপের কর্ণধার জয়নুল হক সিকদার বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি তার জানাযায় অংশ নিতে দেশে আসেন রন হক সিকদার। দুবাই থেকে নেমেই ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার।
পরে এক্সিম ব্যাংকের করা একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও বাবার জানাযায় অংশ নিতে বিশেষ বিবেচনায় প্যারোলে জামিন দেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। পরে কয়েক দফায় জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয় এবং এখন পর্যন্ত তিনি জামিনেই আছেন। এই মামলার অপর আসামি রন হক সিকদারের ভাই দিপু হক সিকদার দেশে ফেরেননি। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলেও জানায় পুলিশ।
এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সিকদার গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
গত বছরের ১৯ মে এ মামলা করা হয়।
মামলার বিবরণীতে বলা হয়, গত ৭ মে রন ও দিপু এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে একটি অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী করে রাখেন। তাদের গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়।
মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, ঘটনাটি ঘটেছে গত ৭ মে। আর এক্সিম ব্যাংক মামলা করেছে গত ১৯ মে। পুরো ঘটনাটি ৫০০ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব নিয়ে। এই ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি পরিদর্শনের নামে এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে ডেকে আনা হয়েছিল। এ সময় জামানত হিসেবে ওই সম্পত্তির বন্ধকি মূল্য কম উল্লেখ করেন ব্যাংকটির এমডি ও অতিরিক্ত এমডি। এরপরেই গুলি ও মারধরের ঘটনা ঘটে। রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার ব্যাংকটির এমডির কাছে একটি সাদা কাগজে জোর করে স্বাক্ষর নেন। সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের সঙ্গে তার ছবিও তোলা হয়।
'তোর কত বড় সাহস যে আমার কথা অমান্য করিস। গুলি করে জন্মের মতো খোঁড়া করে দিব,' বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়াকে অস্ত্রের মুখে ধরে এনে এভাবেই হুমকি দিয়েছেন সিকদার গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার।
শুধু তাই নয়, ব্যাংকটির এমডি ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টাও করেন তারা। চালানো হয় নির্যাতন। জোর করে সাদা কাগজে সইও নেওয়া হয়।
৭ মে রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর ১১ নম্বর সড়কের সিকদার হাউসে ঘটনাটি ঘটে। মূলত এক্সিম ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে সময়মতো না পাওয়াতেই চলে এ নির্যাতন। এ ঘটনার পর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ব্যাংকের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তারা।