করোনায় চাঙা মাল্টার ব্যবসা
অদৃশ্য করোনাভাইরাসে গোটা পৃথিবীর মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্বঅর্থনীতি। বাংলাদেশেও করোনাঘাতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্য। এরই মধ্যে শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ। তবে মহামারির এই দুঃসময়েও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চাঙা মাল্টা ফলের ব্যবসা।
ফল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের উদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেও মাল্টা ফলের বেচাকেনা বেড়েছে। মহামারির প্রকোপ শুরুর আগে জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কেজি মাল্টা বিক্রি হতো। আর লকডাউনের পর থেকে বেচাকেনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
এখন প্রতিদিন গড়ে এক লাখ কেজির বেশি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফলের আড়তগুলোতে। বাজারে দেশীয় সবুজ রঙা মাল্টা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায়। আর বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৭০ টাকা দরে।
চিকিৎসকরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি শরীরে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বর্ধক হিসেবে ফল খেতে বলছেন। আর মাল্টা ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ হওয়ায় বাজারে এখন এর চাহিদাও বেড়েছে অনেক। তাই এবারের মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার মাল্টা চাষীরা প্রায় ১০ কোটি টাকার মাল্টা বিক্রির আশা করছেন।
উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, গেল কয়েক বছর ধরেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়ি এলাকাগুলোতে মাল্টা চাষ হচ্ছে। এ বছর বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর, হরষপুর, সিঙ্গারবিল ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার ৫০ হেক্টর জমিতে হচ্ছে মাল্টার চাষ।
বর্তমানে উপজেলাটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দেড়শ মাল্টা বাগান রয়েছে। প্রতিটি বাগানে চাষ হচ্ছে সবুজ রঙা বারি-১ ও বারি-২ জাতের টাকার মাল্টা। এ বারের মৌসুমে বিজয়নগরের মাল্টা বাগানগুলোতে আটশ টনের বেশি মাল্টা উৎপাদন হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। মুনাফা বেশি হওয়ায় বিজয়নগর উপজেলার অনেক চাষী-ই এখন মাল্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
উপজেলা কৃষি অফিস থেকেই বিনামূল্যে চাষীদের মাল্টার চারা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। মৌসুমি এ ফল চাষে খরচও তুলনামূলক কম। ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাজারগুলোতে বিজয়নগরের উৎপাদিত মাল্টার চাহিদা বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে বেশি। তবে কৃষকরা দেশীয় মাল্টার বাজার ধরে রাখতে বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ রাখতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিঙ্গা গ্রামের মাল্টা চাষী আলমগীর মিয়া বলেন, আমি তিন বিঘা জমিতে মাল্টার চাষ করছি। এবারের মৌসুমে আমার বাগানে প্রায় সাত টন মাল্টা উৎপাদন হবে বলে আশা করছি।
''করোনাভাইরাসে আমাদের ব্যবসায় কোনো প্রভাব পড়েনি, উল্টো মাল্টার চাহিদা আরও বেড়েছে। আমাকে কোনো মৌসুমেই বাজারে গিয়ে বিক্রি করতে হয়নি, ক্রেতারা বাগানে এসেই কিনে নিয়ে যান সবসময়'', যোগ করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের বাসিন্দা মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী মশিউর রহমান জানান, বাজারে মাল্টার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবারের মৌসুমের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকায় খাটিঙ্গা গ্রামে এক একর আয়তনের একটি মাল্টার বাগান কিনেছেন। এ বাগান থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার ফল বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তিনি।
বিজয়নগর উপজেলার আউলিয়া বাজারের ফল ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক জানান, এখন দোকানে মাল্টা না থাকলে ক্রেতা কম আসে। অন্যসব ফলের চেয়ে মাল্টা বিক্রি হচ্ছে বেশি। বিশেষ করে ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় বিজয়নগরের ফলের দোকানগুলোতে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে স্থানীয় উৎপাদিত মাল্টার চাহিদা বেশি।
বিজয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খিজির হোসেন প্রামাণিক বলেন, বিজয়নগর উপজেলাটি ফল চাষের জন্য খুবই সম্ভাবনাময় জায়গা। বিশেষ করে মাল্টা এখানকার জন্য সম্ভাবনাময়ী একটি ফল। গত মৌসুমে বিজয়নগরে প্রায় পাঁচশ টন মাল্টা উৎপাদিত হয়েছে। এবারের মৌসুমে উৎপাদন বেড়ে আটশ টন ছাড়িয়ে যাবে এবং সামনের মৌসুমেও উৎপাদন আরও বাড়বে।
''করোনাভাইরাসের কারণে মাল্টা বাজারজাতকরণে চাষীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। চাষীরা এখন মাল্টা চাষে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে আগামী মৌসুম থেকে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাতকরণের পাশাপাশি বিদেশেও মাল্টা রফতানি করা সম্ভব হবে'', যোগ করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও সরাইল-বিশ্বরোড ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি লিটন ফরাজী বলেন, করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগে প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কেজি মাল্টা বিক্রি হতো আমাদের আড়তগুলোতে। তখন অন্যসব ফলের তুলনায় মাল্টার চাহিদা কিছুটা কম ছিল। কিন্তু গত জুন মাসের পর থেকে মাল্টার বেচাকেনা বেড়েছে। এখন গড়ে এক লাখ কেজির বেশি পরিমাণ মাল্টা বিক্রি হচ্ছে জেলায়।
জেলায় প্রতিদিন গড়ে দেড় কোটি টাকার বেশী মাল্টা বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
চিকিৎসকরা বলছেন, সুস্থ মানুষদের পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিভিন্ন পুষ্টিকর ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে লেবু, আমলকি, মাল্টা, কমলা ও আমড়ার মতো ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফলগুলো আক্রান্তদের জন্য দারুণ উপকারী।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ্ বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আমরা সর্বপ্রথম স্বভাবিক খাবার খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলি। এরপর শারীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর ও ভিটামিন সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবার পরিমিত মাত্রায় খাওয়ার জন্য বলা হয়।