করোনায় নগদ টাকার সংকট, ধান কিনতে না পেরে শঙ্কায় চাতাল মালিকরা
দেশের হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত ধানের সবচেয়ে বড় হাট বসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার মেঘনা নদীর পাড়ে। এই হাটে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধান কেনেন চাতালকল মালিকরা। বছর জুড়েই মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটের এই হাটে চলে ধানের কারবার।
তবে সারাবিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের প্রভাবে এ হাটে নতুন এক সংকট তৈরি হয়েছে। চলমান লকডাউনের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে লেনদেন কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে।
এদিকে, অধিকাংশ চাতালকল মালিকদের অ্যাকাউন্ট বেসরকারি ব্যাংকে হওয়ায় নিরবিচ্ছিন্ন লেনদেন করতে না পেরে তারা অর্থ সংকটে ভুগছেন। নগদ টাকা না থাকায় তারা পর্যাপ্ত ধানও কিনতে পারছেন না। ফলে সরকারের খাদ্য গুদামে যথাসময়ে চাহিদা অনুযায়ী চাল সরবরাহ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা।
হাট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত ধান কৃষক ও ব্যবসায়ীরা নৌপথে আশুগঞ্জে নিয়ে আসেন। প্রতিদিন ধানবোঝাই শতাধিক নৌকা ভিড়ে মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটে। মূলত ধানের এই হাটটি পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মোকাম। এখানে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে ধানের বেচাকেনা।
বর্তমানে আশুগঞ্জ মোকামে প্রতি মণ বিআর-২৮, বিআর-২৯ ও হীরা ধান বিক্রি হচ্ছে। তবে ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ উত্তোলনে সমস্যার কারণে চাহিদা মতো ধান কিনতে পারছেনা চাতালকল মালিকরা। বর্তমানে প্রতিদিন একেকটি চাতাল কলের ৫০০ থেকে ৬০০ মণ ধানের চাহিদা রয়েছে।
বাংলা বছরের প্রথম দুই থেকে তিন মাস দৈনিক এক লাখ মণ ধান বেচাকেনা হয় আশুগঞ্জ মোকামে। আর বাকি সময়গুলোতে গড়ে বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মণ ধান। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাটে ২০ থেকে ৩০ হাজার মণ ধান বেচাকেনা হচ্ছে। মূলত চাতালকল মালিকরা অর্থ সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী ধান কিনতে পারছেন না।
হাটে বিআর-২৮ প্রতিমণ ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা, বিআর-২৯ প্রতিমণ ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা এবং হীরা ধান প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত।
চাতালকল মালিকরা জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সাড়ে তিনশ চাতালকল রয়েছে। এর মধ্যে আশুগঞ্জ উপজেলাতেই রয়েছে প্রায় তিনশ। এই চাতালকলগুলো সরকারের খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহ করে থাকে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার বাজাগুলোতে চালের যোগান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চাতালকলগুলো।
আগামী ৭ মে থেকে সরকারি খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহ শুরু হবে। তবে কি পরিমাণ চাল নেওয়া হবে সেটি এখনও নির্ধারণ করেনি সরকার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ১১ এপ্রিল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। ফলে ১২ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলো বন্ধ রাখা হয়। গত ১৯ এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলোতে আবারও লেনদেন শুরু হয়েছে।
করোনাভাইরাসের ঝুঁকির কারণে ব্যাংকগুলোর একেকটি শাখায় পালাক্রমে সপ্তাহে মাত্র দুই থেকে তিনদিন লেনদেনের জন্য খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে নতুন ধানের এই মৌসুমে অন্তত আগামী এক সপ্তাহ ব্যাংকগুলো সব কার্যদিবস খোলা রেখে নিরবিচ্ছিন্ন লেনদের করার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন চাতালকল মালিকরা।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার কৃষক কিতাব আলী জানান, চলতি মৌসুমে তিনি প্রায় ৫০০ শতাংশ জমিতে বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের ধান চাষ করেছেন। প্রতিমণ ধান চাষে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৭০০ টাকা। কিন্তু হাটে ৭০০ টাকা মণ ধান বিক্রি করতেই কষ্ট হচ্ছে। টাকার অভাবে ধান কিনতে না পারায় অবিক্রিত রয়ে যাচ্ছে হাটে আসা ধান।
মো. বিল্লাল নামে আশুগঞ্জের সোহাগপুর গ্রামের আরেক ধান ব্যবসায়ী জানান, হাটে দৈনিক ধানের চাহিদা আছে এক লাখ মণ। কিন্তু ধান আসছে ২০ থেকে ৩০ হাজার মণ। কারণ চাতালকল মালিকরা আমাদের টাকা দিতে পারছে না বলে কৃষকদের কাছ থেকে আমরা ধান আনতে পারছি না।
''অনেক কৃষক আমাদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে ধান কাটেন। কিন্তু এখন চাতালকল মালিকরা পর্যাপ্ত টাকা দিতে পারছে না বলে আমরাও কৃষকদের টাকা দিতে পারছি না।''
আশুগঞ্জের রজনীগন্ধা এগ্রোফুডের মালিক হাসান ইমরান বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা নগদ টাকা ছাড়া ব্যবসায়ীদের ধান দিচ্ছে না। কারণ তারা ধান বিক্রি করেই সব ব্যায় মিটায়। আর প্রতিদিন চাতালকলগুলোতে ধান কিনতে যে টাকার প্রয়োজন সেই টাকা ঘরেও রাখা যায় না। আবার টাকা নিয়ে ঘরের বাইরেও ঘোরা সম্ভব না।
''আমরা যদি ধানের এ মৌসুমে চাহিদা মতো ধান কিনতে না পারি তাহলে সরকারের গুদামে চাল সরবরাহেও সমস্যা তৈরি হবে। সেজন্য ব্যাংকগুলোতে আমাদের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন লেনদেনের সুবিধা দিতে হবে।'' যোগ করেন তিনি।
আশুগঞ্জের সোনারাপুর এলাকার রূপসা রাইসমিলের সত্ত্বাধিকারী কামরুল শিকদার বলেন, এখন ধানের পুরো মৌসুম। কষকরা জমির পাকা ধান কাটা শুরু করেছেন। কিন্তু আমরা চাহিদা মতো ধান কিনতে পারছি না। এতে কৃষকরাও হাটে ধান আনছে কম। লকডাউনের কারণে ব্যাংকগুলো সবদিন খোলা না রাখায় টাকা উত্তোলনে সমস্যা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের টাকা দিতে না পারায় তারা কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করতে পারছে না।
আশুগঞ্জ উপজেলা চাতালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হেলাল শিকদার বলেন, এখন আমাদের মৌসুম চলছে। এখন যে ধানগুলো আমরা সংগ্রহ করব সেই ধানের চালই সরকারি গুদামে সরবরাহ করব। কিন্তু টাকার জন্য আমরা চাহিদা অনুযায়ী ধান কিনতে পারছি না। এখন থেকে যদি ধান আমরা আমদানি করতে না পারি তাহলে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে আমরা চাল দিতে পারব না। তাই ধানগুলো আমাদের এখনই কিনতে হবে। আর সেজন্য আমাদের দাবি অন্তত আগামী এক সপ্তাহ যেন ব্যাংকগুলো সব কার্যদিবস খোলা রাখা হয়।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংকার্স ফোরামের সভাপতি ইকবাল হোসেন ভূইয়া বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় সরকারি ব্যাংকগুলো খোলা রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্ট বেসরকারি ব্যাংকে হওয়ায় লকডাউন সত্ত্বেও ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে জেলা প্রশাসন বেসরকারি ব্যাংকগুলো দুই থেকে তিন কার্যদিবস খোলা রাখতে বলেছে। কিন্তু পাঁচ কর্মদিবস খোলা রাখা কোনোভাবেই সম্ভব না। লেদেনের কার্যদিবস বাড়ানোর এখতিয়ার একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
এ বিষয়ে আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিমুল হায়দার বলেন, ব্যাংকগুলো সপ্তাহে কোনোটি দুই দিন আবার কোনোটি তিনদিন খোলা থাকছে। কিন্তু কার্যদিবস আরও বাড়ানোর দাবি এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ করেনি। যদি করেন, তাহলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এটি বাড়ানোর চেষ্টা করব।