'করোনায় মরবো না, খাবারের অভাবে মরতে পারি'
ঢাকার ছিন্নমূল হকার মোহাম্মদ রাজা লেবু বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কারওয়ান বাজার পেট্রোল পাম্পের পাশের রাস্তায় বসবাস করা এই হকারের দিন কাটছে অর্ধাহারে। তিন বেলার পরিবর্তে গত বৃহস্পতিবার একবেলা খাবার জুটে তার।
লকডাউনের বাকী দিনগুলো কিভাবে কাটবে সে চিন্তায় মলিন রাজার চেহারা। কারণ যানবাহন বন্ধ থাকায় রাস্তায় লেবু বিক্রি সম্ভব নয়। নতুন করে অন্যকিছু নিয়েও হকারি করতে দেবে না পুলিশ।
মোহাম্মদ রাজা দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, 'রাস্তায় জ্যামে পড়া মানুষের কাছে লেবু বিক্রি করে দৈনিক ২-৩শ টাকা আয় হতো। লকডাউনে গাড়ি বন্ধ থাকায় তা নেই। আমার হাতেও কোনো টাকা নেই। কেউ সাহায্যও করছে না। এমন বিপদ আগের লকডাউনগুলোতেও দেখিনি'।
রাজার মতোই বিপদে আছেন রাজধানীতে রিক্সাচালক,ভ্যানচালক, হকার, দিনমজুর ও বাসাবাড়িতে কাজ করেন এমন নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
দেশের ৬৪ জেলায় ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চালানো এক জরিপে দেখা যায়, চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে ৬০ শতাংশ। ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই।
৩১শে মার্চ থেকে ৫ই এপ্রিলের মধ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়।
দেখা যায়, খাবারের সন্ধানে স্বল্প আয়ের অনেকে ভিড় করছেন শহরের সড়ক ও মসজিদের সামনে। তাদের অভিযোগ সরকারের কাছ থেকে এবার কোন খাদ্য সহায়তাই পাচ্ছেন না তারা।
তিন সন্তানের মা, বিধবা জোলেখা বেগম, ১৫ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন। রাস্তায় তোয়ালে ও ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আবাসস্থল ঢাকার কারওয়ান বাজার টিসিবি ভবনের সামনে ছোট একটি পলিথিন দিয়ে টাঙ্গানো তাঁবু। বৃষ্টি আসলে আশ্রয় নেন টিসিবি ভবনের বারান্দায়।
লকডাউনে এখন তার বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ। হাঁড়িতে আগুন জ্বলাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। জোলেখা বেগম বলেন, 'আগে দুই বেলা খাইতাম, এখন শুধু দুপুরে এক বেলা খাই। এখন আমার কাছে আর চাল নেই, টাকা পয়সাও নেই। সামনে দিনগুলোতে কেমনে খাব সেটাই ভাবছি। প্রথম লকডাউনে বিভিন্ন মানুষ এসে কিছু খাবার দিয়ে যেত। এবার সেটাও পাচ্ছি না'।
সরকারের পক্ষ থেকে কোন ত্রাণ পেয়েছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে জোলেখা বেগম বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে এবার এক কেজি চালও পাইনি, সরকার তো চায় আমরা গরীবরা মরে যাই, তাহলে দেশে আর কোন গরীব থাকবে না, আমগো মতো গরীবরা না থাকলে সরকারের কাছে আর কেউ খাওন চাইবো না'।
হাতিরপুলে রাস্তার পাশে মলিন মুখে বসে থাকতে দেখা যায় ভ্যানচালক শফিকুর রহমানকে। কাঁঠালবাগান ঢালে বস্তিতে থাকেন পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে, চলতি লকডাউনে এক পয়সাও আয় নেই শফিকুরের।
টিবিএসকে শফিকুর রহমান বলেন, 'লকডাউনে কোন ভ্যান চালক-ই ভাড়া পাচ্ছে না, মানুষের বাসা পরিবর্তন ও বিভিন্ন আসবাবপত্র কেনা-বেঁচা না থাকায় শহরের ভ্যান চালকরা এখন সম্পূর্ণ বেকার। এভাবে লকডাউন চললে আমরা খাব কী ! সরকারের কাছে দাবি জানাই, লকডাউনে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিক। আর না হয় লকডাউন খুলে দিক, আমরা চুরি বা ভিক্ষা করা শিখি নাই, শরীরের ঘাম ঝরিয়ে কাজ করে খেতে চাই'।
কল্যাণপুর বস্তিতে পরিবার নিয়ে থাকেন নজরুল ইসলাম, কাজ নেই তার ছয় দিন ধরে। ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে কী করবেন সেই দু:শ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ নজরুলের।
নজরুল বলেন, 'দিনমজুরের কাজ করতাম। ছয় দিন ধরে কোন কাজ নেই। পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। স্ত্রী আগে একটি বাসা বাড়িতে কাজ করত, করোনার কারণে সেই কাজটাও নেই'।
নজরুল ইসলামের স্ত্রী রানি বেগম বলেন, 'যে বাসায় কাজ করতাম সে বাসার মালিক করোনা বেড়ে যাওয়ায় বেশ কিছুদিন আগে ঐ বাসায় যেতে না করে দেয়। এখন স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই সম্পূর্ণ বেকার । তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে আমরা খুবই কষ্টে আছি। সরকার যদি সাহায্য না করে তাহলে বাঁচার আশা দেখছি না'!
কল্যাণপুর বস্তিতে দেখা গেছে, গাদাগাদি করে এক রুমে ছয় থেকে সাত জন থাকছেন। নেই কোন ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মানার উপায়। বস্তিবাসীরা জানায়, 'আমরা করোনা নিয়ে চিন্তা করি না। করোনায় মরবো না, খাবারের অভাবে মরতে পারি'।
শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য সংকটের সঙ্গে এখন বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো বাসাভাড়া। বেশির ভাগ মানুষের লকডাউনে কাজ না থাকায় বাসাভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
তেমনি একজন সেতারা বেগম, স্বামী মারা গেছেন ১৭ বছর আগে। রেস্টুরেন্টে থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করতেন। গত বছর করোনার শুরুতেই কাজ হারিয়েছেন সেতারা বেগম, বর্তমানে নিরুপায় হয়ে ভিক্ষা করে খাবার জোগাড় করছেন।
সেতারা বেগম টিবিএসকে বলেন, 'বৃদ্ধ হয়ে গেছি, তার উপর করোনায় এখন আর কেউ কাজে নেয় না। মানুষের কাছে চেয়ে চেয়ে খাই। আজকে এই বৃষ্টির মধ্যেও সকালে বের হয়েছি ভিক্ষা করতে। এখনও কোন টাকা পাই নি। জুম্মার নামাজের সময় মসজিদের সামনে দাঁড়াবো, দেখি কেউ টাকা দেয় কিনা। ভিক্ষা করে খাবারই জোগাড় করতে পারছিনা এই করোনায়, এর মধ্যে রয়ে গেছে বস্তির তিন মাসের ঘরভাড়া'।
ঢাকা শহরে কিছুক্ষণ ঘুরেই মোড়ে মোড়ে কিংবা রাস্তার ধারে অসংখ্য মানুষকে দেখা গেছে ভিক্ষা করতে। এদের অনেকেই আগে ভিক্ষা করতেন না, চলতি করোনার প্রভাবে কাজ হারিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছেন বলে জানান।
সেতারা বেগমের মতো রিজিয়া বেগম ও রোমেনা বেগমও ভিক্ষার পথ বেছে নিয়েছেন। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এবারের লকডাউনে সরকারের কোন সহায়তাই পাইনি, আগের বার তাও আলু, চাল, ডাল কয়েক কেজি পাইছিলাম'।
মৌচাক এলাকায় ভ্রাম্যমান চা, সিগারেট বিক্রি করছিল আবুল কালাম । বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছেন। আবুল কালাম বলেন, 'বিদেশে যাওয়ার জন্য ৪ লাখ টাকা জমা দিয়েছিলাম। সেই টাকা নিয়ে আদম ব্যাপারী পালিয়ে যায়। এরপর ফতুর হয়ে রাস্তায় চা বিক্রি করতাম। কিন্তু করোনা আসায় চা বিক্রি করেও আগের মতো আয় হচ্ছে না, লকডাউনের আগে এক হাজার টাকা বিক্রি হতো, এখন সারাদিনে ২০০-৩০০ টাকার মতো পারি'।
'এই লকডাউনে রাস্তায় মানুষই নাই, এখন চা বেঁচুম কার কাছে ! এভাবে চললে তো আমগো আর মরন ছাড়া উপায় দেখতেছি না'!
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের 'অর্গানাইজিং দ্য ইনফরমাল ইকোনমি ওয়ার্কার্স: আ স্টাডি ইন রিকশা পুলারস ইন ঢাকা সিটি' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরে এখন আনুমানিক ১১ লাখ রিকশা আছে । করোনায় আয় কমে যাওয়ায় এসব রিক্সাচালকেরা কষ্টে আছে। অনেকেই অলস বসে আছে রিক্সা নিয়ে।
চলমান লকডাউনে রিক্সা চালানোর অনুমতি দিলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় আগের মতো যাত্রী পাচ্ছেন না বলে জানান রিক্সাচালকেরা।
বাংলা মটরের সামনে কথা হয় রিক্সাচালক হাসান শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ঘর থেকে মানুষ বের না হওয়ায় আগের তুলনায় তিনভাগের এক ভাগও যাত্রি পাচ্ছি না। মানুষের হাতে টাকা না থাকায় ৩০-৪০ মিনিটের রাস্তাও অনেক মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন। তাই এই লকডাউনে বেশিরভাগ সময় বসেই আছি যাত্রী না থাকায়'।