করোনা মহামারিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের অবস্থান প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর হয়ে পড়ছে
করোনাকালে আয় কমে যাওয়া, পর্যটন ব্যবসা বন্ধ হওয়া, উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করতে না পারা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে না পারাসহ পার্লার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের পাহাড় ও সমতল অঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের সার্বিক জীবন-জীবিকা ও আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনা মহামারির প্রভাবে তারা কর্মহীন হয়ে প্রান্তিক থেকে আরও প্রান্তিকতর হয়ে পড়ছেন।
নারীর আয় কমে যাওয়ায় এবং নারী কর্মচ্যুত হওয়ায় বেড়েছে নারীর প্রতি পারিবারিক নির্যাতন। সেইসঙ্গে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় বেড়েছে বাল্যবিবাহ। অন্যদিকে এই কর্মচ্যুত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের জন্য বাজেটে কোনও বিশেষ প্রণোদনা রাখা হয়নি বলে তারা সরকারি সাহায্য থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন।
গতকাল মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত 'কোভিড পরিস্থিতিতে আদিবাসী নারীর জীবিকা সংকট ও নিরাপত্তা' শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠানে এ তথ্যগুলো উঠে আসে। 'বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক'-এর সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
এমজেএফ দীর্ঘদিন ধরে 'আদিবাসী আন্দোলন' ও 'আদিবাসী নারী আন্দোলনে'র সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে আসছে। গতকালের আলোচনা এরই ধারাবাহিকতার একটি অংশ। আন্তজার্তিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
'বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম' এবছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছে "কাউকে পিছনে ফেলে নয়: আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান।"
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অ্যারোমা দত্ত এমপি, বিশেষ অতিথি ছিলেন কেয়ারটেকার সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. সাদেকা হালিম এবং এফসিডিওর সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অ্যাডভাইজার গভর্ন্যান্স তাহেরা জেবীন।
আলোচনা করেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সেক্রেটারি সঞ্জীব দ্রং, চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা রাণী ইয়ান ইয়ান এবং এএলআরডি'র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। সভাপ্রধান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন এমজেএফ এর প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর এভেলিনা চাকমা।
সভাপ্রধান হিসেবে এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, "আদিবাসী নারীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তাদের নিরাপত্তার সমস্যা। জীবন জীবিকার উন্নয়নের কোন মাপকাঠিতেই আদিবাসী নারীর উন্নয়ন হয়নি। আমাদের সবার উচিত দুর্যোগে নারীর পাশে দাঁড়ানো।"
প্রধান অতিথি হিসেবে অ্যারোমা দত্ত এমপি বলেন, "আদিবাসী নারীদের যন্ত্রণা আমরা বলতে পারি ঠিকই কিন্তু কতটা অনুভব করতে পারি? এর উত্তরণ হবে কীভাবে? করোনাকালে সরকারি প্রণোদনা গেলেও ঠিকমতো কেন বণ্টন করা হয়নি, সেই পদ্ধতিগত সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে, অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে। জোন ধরে ধরে আমাদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যেতে হবে।"
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কেয়ারটেকার সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, "বর্তমান সরকার আদিবাসীদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। তবে এটাও ঠিক যে আদিবাসীদের নিজ পরিচয় আমরা দিতে পারিনি। রাষ্ট্র কি সব নাগরিককে সমান দৃষ্টিতে দেখতে পারছে? আমরা কেন এখনও বৈষম্য বিলোপ আইন এখনো পাস করতে পারিনি, এই প্রশ্ন তুলতে হবে।"
বিশেষ অতিথি হিসেবে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. সাদেকা হালিম বলেন, "নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে পাহাড়ে ও সমতলে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গবেষণা করা দরকার। কোনও মন্ত্রণালয় না থাকার কারণে সমতলের কোন তথ্য সমন্বিতভাবে আমাদের সামনে আসছে না। একটি ইন্ডিজেনাস কমিটি গঠন করা উচিত।"
এফসিডিওর সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অ্যাডভাইজার গভর্ন্যান্স তাহেরা জেবীন বলেন, "বৃটিশ সরকার সবসময়ই আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন এবং এই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। সব ধরনের গবেষণা ও সমীক্ষায় বলা হয়েছে করোনাকালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর উন্নয়ন, খাদ্য, জীবন জীবিকা সকল ক্ষেত্রেই আদিবাসীদের অবস্থা দুর্বল।"
তিনি বর্ণনা করেন, "বৃটিশ সরকার এমজেএফের মাধ্যমে করোনাকালে আদিবাসীদের জন্য আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং বাজারের সাথে সম্পৃক্ততা তৈরি করার চেষ্টা করেছে।"
এএলআরডি'র নির্বাহী পরিচালক, শামসুল হুদা বলেন, "প্রায় দুই থেকে তিন মাস আগে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, করোনাকালে সমতল আদিবাসীদের শতকরা ৭০ ভাগ এবং পাহাড়ের আদিবাসীদের শতকরা ৮০ ভাগ করোনার পরে দরিদ্র হয়ে পড়েছেন।"
তিনি আরও বলেন, "প্রণোদনা সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা ও উদ্যোগ থাকলেও প্রক্রিয়ার মধ্যে সমস্যা আছে।"
'বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামে'র সেক্রেটারি, সঞ্জীব দ্রং বলেন, "আদিবাসী নারীদের জন্য কোনও কার্যক্রম নিলে, সেই কার্যক্রমে নারীর নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। সেখানে নারী শুধু সুবিধাভোগী হবেন না। আশা করি, রাষ্ট্র আদিবাসীদের সমস্যাগুলোকে হৃদয় দিয়ে দেখবেন।"
চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা রাণী ইয়ান ইয়ান বলেন, "সমস্যা আগেও ছিল, নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে। সীমাবদ্ধ যোগাযোগ, যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বাজারের উপর নির্ভরশীল কৃষকদের খুবই দিশেহারা অবস্থা হয়েছে। এরা উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারেননি। আদিবাসী নারীদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। পুরো অবস্থা সার্বিকভাবে জানার জন্য চাই গবেষণা। আর আদিবাসী নারীদের বাস্তবতার আলোকে যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।"
মূলপ্রবন্ধে বলা হয়েছে, "স্বাভাবিক অবস্থাতে আদিবাসী নারী বহুমুখী বৈষম্যের শিকার হয় প্রথমত নারী হিসেবে, দ্বিতীয়ত আদিবাসী হিসেবে এবং তৃতীয়ত আদিবাসী নারী হিসেবে। এছাড়া বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতি এবং সমাজের বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে আদিবাসী নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রাখা হয় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও আদিবাসী নারীরা খুব কমই সুযোগ পেয়ে থাকে।"
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের আরেকটি জরিপে বলা হয়েছে, "তিন পার্বত্য জেলাসহ সমতলের আদিবাসীদের মাত্র ২৫ শতাংশ পরিবার এই প্রণোদনা সহায়তা পেয়েছে। শুধু পাহাড়েরই নয়, দেশের অন্যান্য আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকতেও এই মহামারির প্রভাবে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দিনাজপুর, কক্সবাজার থেকে সিলেটের সীমান্তবর্তী আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করে। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অচল হয়ে পড়ার ফলে অনেক আদিবাসী চড়াসুদে ঋণ নিয়েছে। এর ফলে যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে।"
এছাড়াও বলা হয়, "পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বিদ্যুৎ সংযোগ, স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার না থাকার কারণে এসব প্রান্তিক শিশুরা শিক্ষার সুয়োগ থেকে বঞ্চিত। আগামীতে স্কুল খুললেও এই সব শিশুরা বিশেষ করে কন্যাশিশুরা আদৌ বিদ্যালয়ে ফিরতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। এই কন্যাশিশুরা বাল্যবিবাহের ঝুকিঁতে রয়েছে। দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে কন্যাশিশুরা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে জড়িয়ে পড়বে এবং অনেকেই সংঘবদ্ধ পাচারের ঝুঁকিতে পড়বে। লকডাউনের কারণে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও বয়োজ্যেষ্ঠরা স্বাস্থ্যসেবা পায়নি। এরমধ্যে সেখানে করোনার কারণে বিভিন্ন এলাকায় নারীরা বিশেষ করে গর্ভবর্তী নারীরা ঠিকমত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না।"
মূল প্রবন্ধে যে সুপারিশগুলো উঠে এসেছে তা হলো, "আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা এবং সহিংসতার শিকার আদিবাসী নারী ও শিশুদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা প্রদান করা।"