কুমিল্লায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনা থাকলেও ৪২টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা খনন বাকি
১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকার কুমিল্লায় ৫৬টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা চিহ্নিত করে। ১৯৫৬ সালে এখানে খনন শুরু হয়। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৪টি স্থাপনা খনন করা হয়েছে। বাকি ৪২টি স্থাপনার খনন কাজ শুরু করা যায়নি।
এসব প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা খনন করে টিকিটের আওতায় নিয়ে এলে এবং যে ১৪টি স্থাপনা এখন পর্যন্ত খনন হয়েছে, সেগুলোকেও পুরোপুরি টিকিটের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে সরকারের কোষাগারে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় যুক্ত হবে বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান।
কুমিল্লার লালমাই উপজেলার লালমাই পাহাড় থেকে বুড়িচং পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো রয়েছে। শনাক্তকৃত স্থানগুলো চিহ্নিত করে খনন করলে পাওয়া যাবে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ করে এ ২৫ কিলোমিটার জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক হাইওয়ে স্থাপন করা গেলে কুমিল্লার প্রতি সারা বিশ্বের দৃষ্টি পড়বে বলে জানান ড. আতাউর রহমান।
তিনি বলেন, 'এতে ভূমি অধিগ্রহণসহ ৫০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে। আর সব কাজ শেষ হলে সরকার প্রত্নতাত্ত্বিক খাত থেকে বছরে ১০০ কোটি টাকা আয় করতে পারবে। সেইসঙ্গে বড় বড় হোটেল ও রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠবে; কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার মানুষের।'
এদিকে, এসব প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা সংরক্ষণ করা গেলে বাংলাদেশের ইতিহাস আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাদেকুজ্জামান তনু। তিনি বলেন, 'দক্ষিণ পূর্ব বাংলার ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। কুমিল্লার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের। এসব স্থাপনা যখন খনন শুরু হয়, তখন তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মীয় নিদর্শন, নানা রকম মূর্তি, পোড়া মাটির ফলক ও ওই সময়ের মুদ্রা পাওয়া যায়- যা বাংলাদেশের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে।'
'সমকালীন ইতিহাস ও আদি ইতিহাস সম্পর্কে ভালো করে জানতে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো খনন করে সংরক্ষণের বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে কুমিল্লার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো খনন করে সংরক্ষণ করার যৌক্তিকতা অবশ্যই রয়েছে,' বলেন তিনি।
কুমিল্লায় ১৯৫৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৪টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা খনন করা হয়েছে। খননকৃত উল্লেখযোগ্য স্থানের মধ্যে রয়েছে শালবন বিহার, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, লতিকোট মুড়া, আনন্দ বিহার, কুটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবান কন্যা মুড়া (রূপবানী মুড়া), হাতিগাড়া মুড়া, ভোজ রাজার বিহার, রানি ময়নামতির প্রাসাদ ও সতেরো রত্নের মন্দির।
রাজস্ব আদায়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে তিনটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে শালবন বৌদ্ধ বিহার, রূপবান মুড়া ও ইটাখোলা মুড়া। আর বাকি স্থাপনাগুলোকে অবকাঠামোগত কারণ ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখনো রাজস্বখাতের আওতায় যুক্ত করা যায়নি।
শালবন বিহার শুরুর দিক থেকে টিকিটের আওতায় থাকলেও রূপবান মুড়া ও ইটাখোলা মুড়া থেকে রাজস্ব আদায় শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। এ পর্যন্ত দুটি বিহার থেকে ৫ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। আর শালবন বিহার থেকে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ পর্যন্ত আদায় হয়েছে প্রায় ১৭ লাখ টাকার রাজস্ব। পর্যটক এসেছেন ৮১ হাজার।
খনন কাজ না হওয়া উল্লেখযোগ্য বিহারগুলোর মধ্যে রয়েছে কর্নেলের মুড়া, বৈরাগী মুড়া, বালাগাজীর মুড়া, চণ্ডিমুড়া, গিলামুড়া, পাক্কামুড়া, উজিরপুর ঢিবি, কোটবাড়ি মুড়া, ময়নামতি মাউন্ড-১, ময়নামতি মাউন্ড-১/ক, ময়নামতি মাউন্ড-১/খ, ময়নামতি মাউন্ড-ক ও পাঁচথুবির পাঁচটি মুড়া। এর সবগুলোই কুমিল্লার লালমাই, সদর দক্ষিণ, আদর্শ সদর ও বুড়িচং উপজেলায় অবস্থিত এবং বেশিরভাগই লালমাই পাহাড় ঘেঁষা।
ঐতিহ্য কুমিল্লার পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বলেন, 'প্রত্ন পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় জনপদ কুমিল্লা। এখানে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। তা সত্ত্বেও সত্যিকার পর্যটন নগরী বলতে যা বোঝায়, কুমিল্লা এখনো তা হয়ে ওঠেনি। এর অন্যতম কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক নেতাদের উদাসীনতা। এজন্য প্রত্ন স্থাপনা খনন, হোটেল ও খাবার রেস্তোরাঁ স্থাপন করতে হবে। এতে লালমাই পাহাড় ঘিরে কুমিল্লা হয়ে উঠবে দেশের সেরা পর্যটন এলাকা।'
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, 'এই করোনায়ও এখানে দর্শনার্থীদের ভালো সমাগম হচ্ছে। প্রত্ন পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় অঞ্চল কুমিল্লা। এখানে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে, যা এখনো খননের বাকি। এগুলো খনন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাচ্ছি না।'